আমজাদ হোসেন হৃদয়
প্রকাশ : ০৬ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০৬ আগস্ট ২০২৫, ০৮:০৫ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

দ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে

দ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে

২০২৪ সালের জুলাই—বাংলাদেশের এক নতুন ইতিহাস। ছাত্র-যুবক, শ্রমিক, নারী-পুরুষ—সবাই মিলেমিশে দাঁড়িয়েছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে, আর তাদের আত্মত্যাগ গড়ে দিয়েছিল এক অপ্রতিরোধ্য গণজাগরণ। শহর থেকে গ্রাম একেকটি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ছিল অন্যায়ের প্রতিবাদে মুখর। তবে তাদের কণ্ঠস্বর তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে যখন অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় বন্দুকের গুলিতে প্রাণ দিতে হয়। হাজারো কিশোর-তরুণ-যুবকের রক্তে লাল এ দেশের মাটি। আর সেই শহীদদের রক্তে লেখা হয়েছে জুলাই অভ্যুত্থানের বিজয়।

সরকারি তথ্য অনুযায়ী গত বছরের জুলাই-আগস্টে দেশে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থানে শহীদ ৮৪৪ জন এবং জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন (ওএইচসিএইচআর) প্রকাশিত ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং রিপোর্ট অনুযায়ী এ সংখ্যা ১ হাজার ৪০০ জন। তাদের রক্তেই লেখা হয় নতুন ইতিহাস।

এর মধ্যে রংপুরে আবু সাঈদের বুকে গুলি, ঢাকায় মীর মুগ্ধের শেষ নিঃশ্বাস, চট্টগ্রামে ওয়াসিম আকরামের লুটিয়ে পড়া, আর ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ফারহান ফাইয়াজের রক্তে পথ ভিজে যাওয়ার পর পাল্টে যায় আন্দোলনের গতিপথ। শোক পরিণত হয় প্রতিরোধে, প্রতিরোধকে এগিয়ে যায় অন্যায় অবসানের দ্বারপ্রান্তে।

আবু সাঈদ

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রথম শহীদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। ১৬ জুলাই বিকেলে পুলিশের গুলিতে বুক চিরে শেষ হয়ে যায় তার জীবন। বুক পেতে দাঁড়িয়ে থাকা সেই ছবি আজ আন্দোলনের প্রতীক। তার মৃত্যুর পর কোটা সংস্কার আন্দোলন আরও তীব্র হয়েছিল। তার মৃত্যুর ঘটনাটি আন্দোলনের গতিপথ পরিবর্তন করে দেয় এবং ব্যাপক জনবিক্ষোভের জন্ম দেয়। আবু সাঈদের মৃত্যুর পর তার ছবি এবং ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং এতে সাধারণ মানুষও আন্দোলনে যোগ দেয়, যা আন্দোলনকে আরও বেগবান করে তোলে। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে, সরকার কোটা সংস্কারের বিষয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু করতে বাধ্য হয় এবং আন্দোলন আরও বৃহত্তর রূপ নেয়। পরিস্থিতি দ্রুত সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। আন্দোলনের তীব্রতা এতটাই বাড়ে যে, সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খায়। ওইদিনের আন্দোলনকারী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, আবু সাঈদের লাশ নিয়ে বিকেল পৌনে ৪টা অথবা ৪টার দিকে জরুরি বিভাগের সামনে থেকে বের হন সংক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। তারা মেডিকেল কলেজ থেকে লাশ নিয়ে মিছিল করে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যাচ্ছিলেন। ওই সময়ের কয়েকটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা স্লোগান দিয়ে স্ট্রেচারে সাদা কাপড়ে ঢাকা আবু সাঈদের লাশ নিয়ে যাচ্ছিলেন। একটি ভিডিওতে দেখা যায়, আবু সাঈদের সহপাঠীরা ‘আমার ভাই মরল কেন, প্রশাসন জবাব চাই’, ‘পুলিশ কেন গুলি করল, প্রশাসন জবাব চাই’—ইত্যাদি স্লোগান দিচ্ছিলেন।

আবু সাঈদের বন্ধু রাইসুল ফারিদ বলেন, আবু সাঈদকে হত্যার পরই আমরা সবাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এ হত্যাকাণ্ডের বিচার রাজপথে হবে। যে সরকারের নির্দেশে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে গুলি করে হত্যা করা হলো, তার বিচার রাজপথে হবে। হত্যাকারীদের বিচার এ দেশের ছাত্ররাই করবে।

ওয়াসিম আকরাম

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যখন উত্তাল হয়ে ওঠে সারা দেশ। রংপুরের আবু সাঈদের শহীদ হওয়ার কিছুক্ষণ পরই বন্দর নগরী চট্টগ্রামে ঘটে আরেক হৃদয় বিদারক ঘটনা। সন্ত্রাসীদের গুলিতে মুরাদপুরে সেদিন তিন তিনটি প্রাণ ঝরে পড়ে। স্বৈরাচার হাসিনার দোসর ছাত্রলীগ, যুবলীগের গুলিতে ওইদিন আহত হয়ে শহীদ হন চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ওয়াসিম আকরাম। তিনি ছিলেন চট্টগ্রামের প্রথম শহীদ। মুহূর্তেই বন্দর নগরীতে আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে। বুলেটের ভয় উপেক্ষা করে ছাত্র-জনতা স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের একদফা দাবিতে রাজপথে নেমে আসে। ‘চলে আসুন ষোলশহর’—ওয়াসিমের এই ডাক ছিল বিদ্রোহের বজ্রনিনাদ, অবরুদ্ধ জনপদে ফ্যাসিবাদের শিকল ভাঙার হুংকার।

জুলাই গণঅভুত্থ্যানে চট্টগ্রামে নিহত ওয়াসিম আকরামের পরিবার এখনো শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি। বাবা শফিউল আলম ছেলের মৃত্যুর মাসখানেকের মধ্যে সৌদি আরব থেকে দেশে চলে আসেন। এরপর আর বিদেশ যাননি। মা জ্যোৎস্না বেগম হারিয়েছেন শ্রবণশক্তি। এখনো বিশ্বাস করতে পারেন না ওয়াসিম নেই। দিনের বেশিরভাগ সময় ছেলের কবরের পাশে কাটান বাবা শফিউল আলম। ওয়াসিমের স্মৃতি হাতড়ে বেড়ান দুজনই।

ওয়াসিমের সহপাঠী তৌহিদুল ইসলাম বলেন, “আন্দোলনের শুরু থেকেই দৃপ্ত পদক্ষেপে সক্রিয় ছিলেন ওয়াসিম। কখনো পিছু হটেননি, বরং আরও দৃঢ়চেতা হয়ে উঠেছিলেন। মৃত্যুর আগের দিন নিজের ফেসবুক স্ট্যাটাসে ওয়াসিম লিখেছিলেন, ‘সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশে আছে আমার প্রাণের সংগঠন। আমি এই পরিচয়েই শহীদ হব।’ পোস্টটি দেওয়ার মাত্র ১৬ ঘণ্টা পর সেই ভবিষ্যদ্বাণীই সত্যি হয়ে যায়।”

মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ

১৮ জুলাই সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) শিক্ষার্থী মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ। ফেসবুকে নিহত মুগ্ধর ৩৮ সেকেন্ডের একটি ভিডিও শেয়ার করেন তার যমজ ভাই মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ। তাতে দেখা যায়, মৃত্যুর আগে শেষ মিছিলেও মুগ্ধ আন্দোলনকারীদের হাতে ওয়াটারকেস থেকে পানি তুলে দিচ্ছেন। তাকে বারবার বলতে শোনা যায়, ‘এই পানি লাগবে, পানি।’ এ সময় সবুজ ফিতায় বুকে ঝুলছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয়পত্র। মুগ্ধর কণ্ঠের ‘পানি লাগবে, পানি?’ এই বাক্য কানে বেজেছে দেশের কোটি মানুষের। এ সহযোগিতার বাক্যটি হয়ে ওঠে অনুপ্রেরণার, অন্যায়ের প্রতিবাদের। গ্রাফিতিতে ছেয়ে যায় দেশের বহু দেয়াল। মুগ্ধর মৃত্যু শুধু বাংলাদেশকে কাঁদায়নি, কাঁদিয়েছে বিশ্ববাসীকেও। যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যম সিএনএনও সেই ভিডিও প্রকাশ করেছে। তাদের ওয়েবসাইটে লেখা হয়েছিল বিস্তারিত প্রতিবেদনও।

শহীদ মুগ্ধর বাবা মীর মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘দেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতার জন্য মুগ্ধ শহীদ হয়েছে। তার অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে। দেশের মানুষের কাছে সে অমর হয়ে থাকবে।’

ফারহান ফাইয়াজ

জুলাই মাসের গণঅভ্যুত্থানে ঢাকার ধানমন্ডি ২৭ নম্বর এলাকায় ১৮ জুলাই বিকেল সাড়ে ৩টার পর থেমে থেমে সংঘর্ষ চলছিল। সে সময় আহত হন ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ফারহান ফাইয়াজ। সেখান থেকে আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে মোহাম্মদপুর সিটি হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে তার মৃত্যু হয়। তার শরীরে রাবার বুলেটের ক্ষত ছিল। শহীদ ফারহান ফাইয়াজের মৃত্যু ছিল এক মর্মস্পর্শী ঘটনা, যা পুরো আন্দোলনের গতিপথকে বদলে দিয়েছে। মাত্র একাদশ শ্রেণির একজন তরুণ শিক্ষার্থী, স্বপ্নে ভরা এই কিশোরের জীবন যেন হঠাৎ করেই থেমে গেল পুলিশি গুলিতে। কিশোর এ প্রাণের চিরবিদায়ে সারা দেশ জেগে ওঠে, তরুণ-যুবকদের মধ্যে প্রতিরোধের শিখা জ্বলতে শুরু করে। ফাইয়াজের আত্মত্যাগ আন্দোলনকে আরও তীব্র ও সংগঠিত করে তোলে, যা শেষ পর্যন্ত নতুন বাংলাদেশ গঠনের পথে এক মাইলফলক হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

শহীদ ফারহান ফাইয়াজের বাবা শহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, ‘ফারহান ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিল। তার স্বপ্ন ছিল নাসায় গবেষণা করার। সে অত্যন্ত সম্ভাবনাময় ছেলে ছিল। কিন্তু তার স্বপ্ন এবং আমাদের স্বপ্নকে আর পূরণ হতে দেয়নি ঘাতকরা।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

জনগণকে আবার জাগিয়ে তুলতে হবে : মির্জা ফখরুল

মুরাদনগরে পুরুষশূন্য গ্রামে চুরি-ডাকাতির শঙ্কা, বিক্ষোভ

হাসপাতালের পার্কিংয়ে ২ মরদেহ, আদম ব্যবসায়ীরা হত্যা করেছে অভিযোগ

আইএল টি-টোয়েন্টিতে দল পেলেন মোস্তাফিজ

ভারতে ২০০ লোকের ধর্ষণের শিকার বাংলাদেশি কিশোরী উদ্ধারে মিলল চাঞ্চল্যকর তথ্য

কাল নিজের জানাজার ঘোষণা দিলেন হিরো আলম

ডিবি অফিসে সারজিস-হাসনাতকে যে কথা বলে সাহস জুগিয়েছিলেন এ্যানি

সাতক্ষীরা সীমান্ত থেকে বিভিন্ন চোরাচালান পণ্য জব্দ

কুষ্টিয়ায় বজ্রপাতে দুই কৃষকের মৃত্যু

কুয়েত-দুবাইগামী দুটি ফ্লাইট বাতিল বিমানের 

১০

রাজধানীতে শুরু হচ্ছে হজ ও ওমরাহ মেলা

১১

বিএনপি মিলে-মিশে দেশ পরিচালনা করবে : তারেক রহমান

১২

কুমিল্লায় ছিনতাইয়ের কবলে কালবেলার কর্মকর্তা, ৫ দিনেও গ্রেপ্তার হয়নি কেউ

১৩

প্রধান বিচারপতির বাসভবন ও সুপ্রিম কোর্ট এলাকায় সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ

১৪

নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে হবে না, বললেন নাসীরুদ্দীন 

১৫

‘আমরা অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে মানহানি মামলা হয়’

১৬

ব্রেভিসের ব্যাটে রেকর্ডের ঝড়, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রোটিয়াদের ইতিহাস

১৭

আকিজ গ্রুপে কাজের সুযোগ, থাকছে না বয়সসীমা

১৮

প্রধান বিচারপতির সঙ্গে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদূতের সৌজন্য সাক্ষাৎ

১৯

নার্স নিয়োগে বড় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, নেবে ৮০০ জন

২০
X