মানুষের দুই রকমের ব্যাধি হয়ে থাকে, সংক্রামক ও অসংক্রামক। সংক্রামক ব্যাধি সাধারণত রোগজীবাণুর মাধ্যমে হয়ে থাকে, যেমন—কলেরা, ডায়রিয়া, বসন্ত, যক্ষ্মা, হাম, ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড, প্যারা-টাইফয়েড, পোলিও, ডিপথেরিয়া, টিটেনাস ইত্যাদি। বিজ্ঞানের অবিস্মরণীয় উন্নতির ফলে চিকিৎসা বিজ্ঞানেরও অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে। বিভিন্ন সংক্রামক ব্যাধি সহজেই চিকিৎসায় নিরাময় এবং প্রতিরোধযোগ্য। এমনকি অধিকাংশ সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়েছে। অনেক সংক্রামক ব্যাধি দ্রুত নিরাময় করা সম্ভব আধুনিক চিকিৎসার কল্যাণে; কিন্তু বর্তমানে বিশ্বে অসংক্রামক ব্যাধি নীরব ঘাতকের মতো ধেয়ে আসছে এবং এসব ব্যাধি আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে।
অসংক্রামক ব্যাধি কোনো জীবাণুর মাধ্যমে হয় না এবং একজন থেকে আরেকজনে ছড়ায় না। অর্থাৎ ছোঁয়াচে না এবং প্রাণী থেকে অন্য প্রাণীতে ছড়ায় না। অসংক্রামক ব্যাধি বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। যেমন—হৃদরোগ, স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, অস্টিওপোরোসিস, অস্টিওআর্থ্রাইটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ক্যান্সার, কিডনি ও লিভারের প্রদাহ, দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসতন্ত্রেও রোগ এবং মানসিক রোগ ইত্যাদি। মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে এবং বয়সজনিত কারণে বার্ধক্যজনিত রোগও বাড়ছে। এ ধরনের রোগের প্রকোপ মারাত্মক হারে বাড়ছে, হয়ে উঠছে বড় ঘাতক। ফলে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও মানুষের পারিবারিক, সামাজিক এবং অর্থনীতির ওপর প্রভাব ও চাপ পড়তে শুরু হয়েছে। ২০১০ সালে অনুষ্ঠিত বিশ্ব অর্থনৈতিক সম্মেলনে অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, যেভাবে অসংক্রামক ব্যাধি বেড়ে চলছে, তাতে অর্থনীতির ওপর বিরাট প্রভাব পড়ছে। এর মূল কারণ এ ধরনের রোগের চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। গরিব বা নিম্নবিত্ত, এমনকি অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষেও এ রোগের চিকিৎসার ব্যয় বহন করা অসম্ভব। এর আরেকটি অন্যতম কারণ হলো, এ ধরনের রোগে দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসা চালাতে হয়, এমনকি আজীবন পর্যন্ত।
এ ধরনের ব্যাধিতে আক্রান্ত মানুষের মধ্যে তাদের পূর্বপুরুষের রোগের পারিবারিক ইতিহাস থাকে। পারিবারিক বা জিনগত (জেনেটিক) ইতিহাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তার সঙ্গে যোগ হয় পরিবেশগত উপাদান, যেমন পরিবেশ দূষণ, অস্বাস্থ্যকর ও বাজে খাদ্যাভ্যাস, কায়িক শ্রমের অভাব, ধূমপান, মানসিক চাপ ইত্যাদি। সবকিছু মিলিয়ে বর্তমান সময়ে অনেক কম বয়সেই মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, সারা পৃথিবীতে অনেকেই কর্মক্ষমতা হারাচ্ছে এবং চিকিৎসা ব্যয় বাড়ছে। সময়মতো সচেতন হলে বংশ পরম্পরায় থাকা এসব রোগ প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
অসংক্রামক ব্যাধির কারণ: সংক্রামক রোগ ধীরে ধীরে কমছে আর দ্রুত বাড়ছে অসংক্রামক রোগ। আর্থিক অসচ্ছলতা, অশিক্ষা এবং চিকিৎসার অপ্রতুলতা এ সমস্যা আরও প্রকট করে তুলছে। এসব রোগের চিকিৎসা অনেক ক্ষেত্রেই ব্যয়বহুল হয়ে থাকে। মানুষের জীবনযাত্রার মান, সামাজিক অস্থিরতা, খাদ্যাভ্যাস, যান্ত্রিক জীবন সবকিছু মিলিয়েই অসংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধির জন্য দায়ী। নিম্নে কিছু কারণ উল্লেখ করা হলো—
(১) কায়িক শ্রম ও হাঁটাচলা বা নিয়মিত ব্যায়াম না করা। ফলে শরীরের ওজন বেড়ে যেতে পারে।
(২) অলস জীবনযাপন করা, স্থূলতা বা অতিরিক্ত মোটা হওয়া। অধিক ওজনসম্পন্ন লোকদের উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, স্ট্রোক ও হৃদরোগসহ কোলেস্টেরলও বেড়ে যেতে পারে।
(৩) খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন, শাকসবজি, ফলমূল কম খাওয়া, অধিক ক্যালরিসমৃদ্ধ ও অধিক চর্বি-শর্করা জাতীয় খাদ্য গ্রহণের অভ্যাস, ফাস্টফুডে আসক্তি, চিনি ও মিষ্টি জাতীয় এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার, চকলেট, আইসক্রিম, অতিরিক্ত মাত্রায় কোমল পানীয় গ্রহণ।
(৪) অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ, এর ফলে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ে। খাদ্যে কেমিক্যাল ও ভেজাল খাদ্য গ্রহণ।
(৫) ধূমপান, তামাকপাতা, জর্দা, গুল লাগানো এবং মাদক সেবন।
(৬) খেলার মাঠের অভাব, বিদ্যালয়ে শরীরচর্চা বা খেলাধুলার সংস্কৃতির বিলোপ। গাড়ি-লিফট-চলন্ত সিঁড়ি ব্যবহারের প্রবণতা।
(৭) মোবাইল, ইউটিউব, টিকটক, ইন্টারনেট, টেলিভিশন, কম্পিউটার গেম ও ফেসবুকের অপব্যবহার। এগুলো ব্যবহারে বাচ্চাসহ যে কোনো বয়সের মানুষের অলস জীবনযাপনের প্রবণতা বাড়ছে।
(৮) বায়ুদূষণ: ফলে শ্বাসজনিত রোগ, যেমন হাঁপানি, ব্রংকাইটিস, এমফাইছিমা বা সিওপিডি, এমনকি জন্মগত ত্রুটি, ক্যান্সার ও হৃদরোগ বাড়ছে।
(৯) অতিরিক্ত টেনশন, মানসিক চাপ, অতিরিক্ত রাগ, উত্তেজনা ও ভয়ভীতি। এগুলো উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগসহ স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
(১০) মানুষের মধ্যে সচেতনতার ঘাটতি রয়েছে। শারীরিকভাবে অসুস্থতাবোধ না করলে কেউ চিকিৎসকের কাছে যায় না এবং নিয়মিত চেকআপ করায় না। এ কারণেই অসংক্রামক ব্যাধি মানুষের ওপর ভর করছে।
প্রতিরোধে করণীয়: বর্তমানে দেশের শতকরা ৭০ ভাগই হচ্ছে অসংক্রামক রোগ, তাই এসব রোগ প্রতিরোধে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। এসব অনেক ব্যাধি অনিরাময়যোগ্য এবং চিকিৎসা অনেক ক্ষেত্রেই ব্যয়বহুল। তাই প্রাথমিক পর্যায়ে প্রতিকার-প্রতিরোধ করার বিষয়ে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে।
(১) আমাদের সামাজিক জীবনযাত্রা ও খাদ্যাভ্যাসে ব্যাপক পরিবর্তন আনা দরকার। খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। কম চর্বি ও কম কোলেস্টেরলযুক্ত খাবার গ্রহণ করতে হবে। অধিক ক্যালরিযুক্ত খাবার, ফাস্টফুড, কোমল পানীয়, প্রক্রিয়াজাত খাবার, চকলেট, আইসক্রিম, চিনি ও মিষ্টি জাতীয় খাবার যেমন শরবত, গ্লুকোজ, পায়েস ইত্যাদি পরিহার বা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
(২) লবণ নিয়ন্ত্রণ: তরকারিতে প্রয়োজনীয় লবণের বাইরে অতিরিক্ত লবণ পরিহার করতে হবে।
(৩) কায়িক শ্রম ও নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। সকাল-সন্ধ্যা নিয়মিত হাঁটাচলা, হাটে-বাজারে কোথাও গেলে অল্প দূরত্বে রিকশা বা গাড়ি ব্যবহার না করা, অল্প কয়েক তলার জন্য লিফট ব্যবহার না করা। সম্ভব হলে সাঁতার বা জগিং করা, ব্যায়ামাগারে গিয়ে ব্যায়াম করা।
(৪) অতিরিক্ত মোবাইল, ইউটিউব, ফেসবুক, টেলিভিশন আর কম্পিউটার ব্যবহারের প্রবণতা কমাতে হবে।
(৫) যারা বয়স্ক বা অবসরপ্রাপ্ত তারাও নিয়মিত হাঁটাচলা করতে পারেন। এর সঙ্গে বাগান করা এবং পরিচর্যা করতে পারেন।
(৬) নগরবাসীর জন্য ব্যায়াম ও হাঁটার জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা এবং স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য খেলার মাঠের ব্যবস্থা করতে হবে।
(৭) বাড়তি ওজন কমাতে হবে। এর জন্য খাদ্য নিয়ন্ত্রণ ও নিয়মিত ব্যায়াম ও কায়িক পরিশ্রম করতে হবে।
(৮) ধূমপান, মদপান, মাদকদ্রব্য, তামাকপাতা ও জর্দা খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে হবে।
(৯) বায়ুদূষণের কারণগুলো চিহ্নিত করে এগুলো প্রতিরোধে বাস্তবসম্মত ব্যবস্থা নিতে হবে। সবুজায়ন বৃদ্ধির জন্য প্রচুর গাছপালা লাগাতে হবে।
(১০) মানসিক ও শারীরিক চাপ সামলাতে হবে। নিয়মিত বিশ্রাম, সময়মতো ঘুমানো, নিজের শখের কাজ করা, নিজ ধর্মের চর্চা করা ইত্যাদির মাধ্যমে মানসিক শান্তি বেশি হবে।
(১১) শিক্ষা ও সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। এসব রোগ প্রতিরোধে জনসচেতনতা, পাঠ্যপুস্তকে এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা, মিডিয়ার ব্যবহার, শিক্ষক, ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব এবং সামাজিক নেতাদের প্রশিক্ষণ, সমাজকর্মীদের সচেতন করে তোলা, সচেতনতা ক্যাম্প ইত্যাদির ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
(১২) নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনে অভ্যস্ত হওয়া, নিয়মিত ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি পরীক্ষা করা জরুরি। এমনকি বয়স ৪০ পার হলে প্রতি বছর মেডিকেল চেকআপ করা উচিত।
অসংক্রামক রোগ আজ মারাত্মক জনস্বাস্থ্য সমস্যা, যেগুলো কখনো নির্মূল করা যাবে না। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতিকার ও প্রতিরোধযোগ্য। আমাদের স্বাস্থ্য খাতে সফলতা আছে, সীমাবদ্ধতাও আছে। অসংক্রামক ব্যাধি প্রতিরোধে আমাদের সঠিক পরিকল্পনা করে সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে, কারণ এসব ব্যাধি আজ মারাত্মক জনস্বাস্থ্যের সমস্যা, তাই রোগের প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধের ব্যাপারে বেশি যত্নবান হতে হবে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এসব রোগ প্রতিরোধে জনসচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন। যেহেতু একবার আক্রান্ত হলে এ ধরনের ব্যাধি থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না, তাই সচেতনতা ছাড়া প্রতিরোধের বিকল্প নেই।
ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ
ইমেরিটাস অধ্যাপক, বিএমইউ
মন্তব্য করুন