কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই (Artificial Intelligence) এখন আর ভবিষ্যতের কোনো কল্পনা নয়—এটি আজকের বাস্তবতা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এআই ব্যবহার করে রোগ শনাক্তকরণ, চিকিৎসা পদ্ধতির মানোন্নয়ন, মহামারি প্রাদুর্ভাবের পূর্বাভাস ও স্বাস্থ্যসেবার গতি বাড়ানো সম্ভব হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের মতো জনবহুল ও সীমিত সম্পদের দেশে স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়নে এআইয়ের বিশাল ভূমিকা রয়েছে। সঠিকভাবে কাজে লাগানো গেলে এটি দেশের স্বাস্থ্যসেবায় ব্যাপক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে—শহর ও গ্রামের মধ্যে সেবার মানে যে বৈষম্য রয়েছে, তা কমাতে পারে। সর্বোপরি চিকিৎসাকে আরও সহজলভ্য ও কার্যকর করতে পারে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার বর্তমান চিত্র
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ স্বাস্থ্য খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। গড় আয়ু বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৩.৭ বছরে, শিশু মৃত্যুহার কমে নেমেছে প্রতি হাজারে ২৪-এ এবং মাতৃমৃত্যুহার দাঁড়িয়েছে প্রতি এক লাখে ১৫৬-এ। জাতীয় টিকাদান কর্মসূচিও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। তবুও চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে বহুমাত্রিক। বর্তমানে দেশে প্রতি ১ হাজার ৪৯৩ জনের জন্য একজন চিকিৎসক রয়েছেন, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রস্তাবিত মানদণ্ডের (প্রতি এক হাজার জনের একজন চিকিৎসক) চেয়ে অনেক কম। নগর ও গ্রামের মধ্যে বৈষম্য আরও প্রকট—শহরে গড়ে ১ হাজার ৫০০ মানুষের জন্য একজন চিকিৎসক থাকলেও গ্রামে এ সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার। তদুপরি বিশেষায়িত চিকিৎসা প্রায় সম্পূর্ণরূপে সীমাবদ্ধ ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কয়েকটি বড় শহরে। ফলে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী প্রাথমিক সেবার বাইরে উন্নত চিকিৎসা পেতে নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়। এ ছাড়া ডায়াবেটিস, ক্যান্সার ও হৃদরোগের মতো অসংক্রামক রোগ দ্রুত বাড়ছে আর ডেঙ্গু ও যক্ষ্মার মতো সংক্রামক রোগও এখনো বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে আছে। এর সঙ্গে রয়েছে রোগ দেরিতে শনাক্তকরণ, দীর্ঘ অপেক্ষার সারি, উচ্চ চিকিৎসা ব্যয় ও সীমিত উন্নত সেবা—যা জনগণের ভোগান্তি আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। ঠিক এ প্রেক্ষাপটেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই স্বাস্থ্যসেবায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।
স্বাস্থ্য খাতে এআইয়ের সম্ভাবনা
এআই এমন এক কম্পিউটারভিত্তিক সিস্টেম, যা অল্প সময়ে বিপুল পরিমাণ তথ্য বিশ্লেষণ, প্যাটার্ন শনাক্তকরণ এবং ভবিষ্যৎ পূর্বাভাসের মতো জটিল কাজ অত্যন্ত নির্ভুলভাবে সম্পন্ন করতে সক্ষম। স্বাস্থ্য খাতে এর প্রয়োগও বহুমাত্রিক—রোগের প্রাথমিক শনাক্তকরণ, চিকিৎসা পদ্ধতির কার্যকারিতা মূল্যায়ন, রোগ ফের ফিরে আসার সম্ভাবনা নির্ধারণ থেকে শুরু করে নতুন ওষুধ আবিষ্কার, প্রিসিশন মেডিসিন এবং হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা পর্যন্ত বিস্তৃত এর ব্যবহার।
রোগ নির্ণয় ও স্ক্রিনিংয়ে এআই
চিকিৎসাবিজ্ঞানে এআইয়ের গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার হচ্ছে রোগের প্রাথমিক শনাক্তকরণ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষায় প্রাপ্ত ভিন্ন ভিন্ন রেজাল্টের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ। উন্নত দেশে এরই মধ্যে এক্স-রে, সিটি স্ক্যান, এমআরআই বা প্যাথলজি স্লাইড বিশ্লেষণে এআই ব্যবহার হচ্ছে, যা ক্যান্সার, যক্ষ্মা বা অন্যান্য জটিল রোগ প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করতে সাহায্য করছে। বাংলাদেশেও এর কার্যকর প্রয়োগের উদাহরণ রয়েছে। যেমন, আইসিডিডিআর,বি, সংযুক্ত আরব আমিরাতের আইজ ফর অল পিএলসি এবং কানাডার ডায়াগনস ইনকের যৌথ উদ্যোগে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি শনাক্তকরণের জন্য এআইভিত্তিক প্রযুক্তির প্রয়োগ, যা এ ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক। বাংলাদেশে বিশেষায়িত রেডিওলজিস্ট ও প্যাথলজিস্টের ঘাটতি একটি বড় চ্যালেঞ্জ আর এ ঘাটতি পূরণে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) হতে পারে কার্যকর একটি ‘ডিজিটাল সহকারী’। উদাহরণস্বরূপ, দূরবর্তী বা প্রান্তিক অঞ্চলে যক্ষ্মা কিংবা নিউমোনিয়ার মতো রোগের সম্ভাব্য লক্ষণ শনাক্ত করতে এক্স-রে বিশ্লেষণে এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে, যা দ্রুত সঠিক নির্ণয়ের মাধ্যমে মূল্যবান জীবন রক্ষা করতে সহায়তা করবে। একইভাবে, এআইচালিত ডিজিটাল প্যাথলজি ক্যান্সারের রিপোর্ট দ্রুত প্রস্তুত করতে পারে, ফলে রোগীদের আর দীর্ঘ সময় ধরে পরীক্ষার ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। এআই প্রযুক্তির সময় উপযুক্ত ও সঠিক ব্যবহার বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবায় গতি, নির্ভুলতা এবং সমতা নিশ্চিত করে চিকিৎসা ব্যবস্থাকে আরও কার্যকর ও রোগীবান্ধব করে তুলতে পারে।
জনস্বাস্থ্য ও মহামারি পূর্বাভাসে এআই
বাংলাদেশের মতো নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশের জন্য মহামারি অনেক সময় মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়ায়। এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) হতে পারে এক অনন্য হাতিয়ার। এআই বিভিন্ন রোগের মহামারির পূর্বাভাস দেওয়া ও নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। যেমন, প্রতি বছর ডেঙ্গু একটি বড় জাতীয় স্বাস্থ্য সংকটে পরিণত হয়। আবহাওয়া, তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, জনসংখ্যার ঘনত্ব, মানুষের চলাচলের ধরন এবং হাসপাতালের ভর্তি রিপোর্ট বিশ্লেষণ করে এআই আগেই বলে দিতে পারে কোন এলাকায় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ঘটতে পারে। সেই পূর্বাভাস অনুযায়ী আগে থেকেই মশা দমন কর্মসূচি চালানো, হাসপাতালের প্রস্তুতি নেওয়া এবং জনগণকে সচেতন করা সম্ভব হলে ডেঙ্গুর ক্ষতি অনেকাংশে কমানো যাবে। শুধু ডেঙ্গুই নয়, একইভাবে এআইভিত্তিক লগারিদম ব্যবহার করে অন্যান্য মহামারি যেমন ইনফ্লুয়েঞ্জা বা কভিড-১৯-এর সম্ভাব্য বিস্তারও অনুমান করা যেতে পারে, যা সংক্রমণ বিস্তারের ধরন নির্ধারণে সাহায্য করতে পারে। এ ছাড়া বর্তমানে দেশে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ (রেজিস্ট্যান্স) জনস্বাস্থ্যের জন্য বিরাট হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এআই হাসপাতালের প্রেসক্রিপশন ও ল্যাব রিপোর্ট বিশ্লেষণ করে কোন এলাকায় কোন অ্যান্টিবায়োটিক ধীরে ধীরে অকার্যকর হয়ে পড়ছে, তা আগে থেকেই শনাক্ত করতে পারে। যেমন, কোনো অঞ্চলে টিবি রোগীর প্রচলিত ওষুধ কাজ না করলে এআই সেই অঞ্চলকে ‘ড্রাগ-রেজিস্ট্যান্ট জোন’ হিসেবে চিহ্নিত করবে। এতে দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে নতুন চিকিৎসা কৌশল প্রয়োগ করা সম্ভব হবে। সব মিলিয়ে, জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় এআই শুধু মহামারি আগে থেকে ধরতেই নয়, বরং কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধমূলক কৌশল বাস্তবায়নে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম।
টেলিমেডিসিন ও ভার্চুয়াল স্বাস্থ্য সহকারী
বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে টেলিমেডিসিন স্বাস্থ্য খাতে বিপ্লবী ভূমিকা পালন করতে পারে। কভিড-১৯ মহামারির সময় সঠিকভাবে টেলিমেডিসিন ব্যবহারের মাধ্যমে দেশটি ব্যাপক প্রাণহানির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহার করে মানুষ ঘরে বসেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে সক্ষম হয়েছেন। একইরকমভাবে, ভার্চুয়াল স্বাস্থ্য সহকারী বা চ্যাটবটের মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এ ব্যবস্থাকে আরও কার্যকর ও সুনির্দিষ্ট করে তুলতে পারে, বিশেষত প্রান্তিক ও দুর্গম অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর জন্য। এআইভিত্তিক ভার্চুয়াল স্বাস্থ্য সহকারী এমন একটি অ্যাপ, যার মাধ্যমে রোগী মোবাইল ফোনে তার উপসর্গ জানাতে পারেন। এআই তা শুনে রোগের সম্ভাব্য প্রকোপ ও গুরুত্ব সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দেয় এবং গুরুতর রোগীকে সরাসরি চিকিৎসকের কাছে পাঠানোর পরামর্শ প্রদান করে। উদাহরণস্বরূপ, কেউ যদি কাশি, জ্বর বা শ্বাসকষ্টের উপসর্গ জানান, তবে অ্যাপটি তাৎক্ষণিকভাবে সম্ভাব্য রোগ নির্ণয়ের প্রাথমিক পরামর্শ দিতে পারে—যেমন সাধারণ সর্দি, ফ্লু বা কভিড-১৯ এবং রোগের মাত্রা নিরূপণ করতে সাহায্য করে। এর ফলে রোগী দ্রুত প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পেতে পারেন। দীর্ঘস্থায়ী রোগ যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ বা ক্যান্সারের ব্যবস্থাপনায় ভার্চুয়াল স্বাস্থ্য সহকারী কার্যকরভাবে বিভিন্ন কাজ করতে পারে। যেমন, এটি রোগীর দৈনন্দিন তথ্য যেমন রক্তে শর্করা বা রক্তচাপ সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করতে পারে এবং হঠাৎ অস্বাভাবিক বৃদ্ধি দেখা দিলে স্বয়ংক্রিয় সতর্কবার্তা পাঠাতে পারে। ক্যান্সার রোগীর উপসর্গ পর্যবেক্ষণ করে কোনো ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি শনাক্ত হলে
আগাম সতর্কবার্তা দিতে পারে এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের কাছে রোগীকে রেফার করতে পারে। এটি রোগীকে নিয়মিত ওষুধ সেবনের জন্য স্মরণ করিয়ে দিতে পারে এবং স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কিত পরামর্শ প্রদান করতে সক্ষম। গ্রামীণ ও দুর্গম অঞ্চলে, যেখানে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার পাওয়া কঠিন, সেখানে এআইচালিত ভার্চুয়াল স্বাস্থ্য সহকারী বিশেষভাবে কার্যকর। উদাহরণস্বরূপ, অন্তঃসত্ত্বারা যদি কোনো জটিল উপসর্গ অনুভব করেন, তবে এআই ঝুঁকির মাত্রা নির্ধারণ করে এবং গুরুতর পরিস্থিতি হলে নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়ার পরামর্শ ও আগেই সতর্কতা পাঠাতে পারে।
হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় এআই
ধারণা করা হয়, বাংলাদেশে সরকারি হাসপাতাল, কমিউনিটি ক্লিনিক এবং বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক মিলিয়ে স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৩০ হাজারেরও বেশি। এই বিশাল স্বাস্থ্যব্যবস্থার কাঠামো দক্ষভাবে পরিচালনা করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ, যেখানে এআই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা, রোগীর ভর্তির পূর্বাভাস, বিদ্যমান বেডের সর্বোচ্চ ব্যবহার, অপারেশনের সময়সূচি এবং ওষুধ বা চিকিৎসা সরঞ্জামের সরবরাহ ব্যবস্থাপনা—এসব ক্ষেত্রেই এআইকে ব্যবহার করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, সরকারি হাসপাতালগুলোয় প্রায়ই বেড সংকট দেখা দেয়, বিশেষ করে শহুরে এলাকায়। এআইনির্ভর সিস্টেম রোগীর আগমন ও ভর্তি প্রবণতা বিশ্লেষণ করে নির্ধারণ করতে পারবে কোন সময়ে কোন বিভাগে কোন ধরনের বেডের বেশি প্রয়োজন হবে এবং সে অনুযায়ী স্থানীয় প্রশাসন আগাম প্রস্তুতি নিতে পারবে। একইভাবে, প্রত্যন্ত অঞ্চলের কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো থেকে প্রাপ্ত রোগীর তথ্য বিশ্লেষণ করে এআই অনুমান করতে পারে কোন এলাকায় সংক্রামক রোগের ঝুঁকি বাড়ছে, ফলে শহরের রেফারেল হাসপাতালগুলো আগেভাগে প্রস্তুতি নিতে পারবে। বাংলাদেশের সরকারি হাসপাতালগুলোয় শল্যচিকিৎসা বা সার্জারি রোগীদের দীর্ঘসূত্রতা দীর্ঘদিনের সমস্যা। সার্জারির ধরন, রোগীর অগ্রাধিকার ও চিকিৎসা সরঞ্জামের প্রাপ্যতা বিবেচনা করে এআই স্বয়ংক্রিয়ভাবে সার্জারির সময়সূচি তৈরি করতে পারে, যা সময় ও সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করবে। এ ছাড়া, এআইচালিত ইনভেন্টরি ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম প্রতিটি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জামের মজুত পর্যবেক্ষণ করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো জেলায় ইনজেকশন, অক্সিজেন সিলিন্ডার বা জরুরি ওষুধ দ্রুত শেষ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি দেখা দেয়, তবে এআই তা আগাম সতর্ক করবে এবং সরবরাহের ব্যবস্থা করতে সহায়তা করতে পারে। মোট কথা, সীমিত সম্পদের এই দেশে এআই ব্যবস্থাপনা বিদ্যমান ব্যবস্থাকে আরও দক্ষ, সমন্বিত ও তথ্যভিত্তিক করতে পারে। এতে রোগীর অপেক্ষার সময় কমবে, চিকিৎসকরা অগ্রাধিকার অনুযায়ী রোগী সেবা দিতে পারবেন এবং নীতিনির্ধারকরা দেশের স্বাস্থ্যসম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারবেন।
এআইভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবার সম্ভাবনায় কেন বাংলাদেশ এগিয়ে?
বাংলাদেশে এআইভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবার সম্ভাবনা অত্যন্ত উজ্জ্বল হওয়ার পেছনে রয়েছে একাধিক অনুকূল কারণ। প্রথমত, দেশের দ্রুত বর্ধমান আইসিটি খাত, যেখানে বিপুলসংখ্যক দক্ষ তরুণ আইটি পেশাজীবী রয়েছেন—যারা কোডিং, ডাটা সায়েন্স এবং মেশিন লার্নিংয়ে পারদর্শী। যদি এই তরুণ উদ্ভাবকদের স্বাস্থ্য খাতে যুক্ত করা যায়, তবে বাংলাদেশের নিজস্ব প্রেক্ষাপটের উপযোগী এআই সমাধান তৈরি করা সম্ভব হবে, যা হবে আরও কার্যকর ও টেকসই। দ্বিতীয়ত, সরকার এরই মধ্যে ই-হেলথ রেকর্ড, মোবাইল স্বাস্থ্যসেবা ও টেলিমেডিসিনের মতো ডিজিটাল স্বাস্থ্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, যা এআই প্রয়োগের জন্য শক্তিশালী অবকাঠামো ও তথ্যভিত্তি তৈরি করেছে। তৃতীয়ত, বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি খাতের অংশীদারত্ব বা পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) মডেলের মাধ্যমে এরই মধ্যে বিভিন্ন বৃহৎ প্রকল্প সফলভাবে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। একইভাবে, বেসরকারি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ও সরকারি হাসপাতাল একসঙ্গে কাজ করলে রোগ নির্ণয়, ডাটা বিশ্লেষণ ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় বাস্তবসম্মত এআই সমাধান তৈরি করা সম্ভব। সর্বশেষে, গবেষণা ও প্রযুক্তি উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ব্যয় উন্নত দেশের তুলনায় অনেক কম, যা বিদেশি বিনিয়োগ ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে। মূলত এ চারটি কারণই বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ায় এআইনির্ভর স্বাস্থ্যসেবার অগ্রদূত হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এগিয়ে রেখেছে। এখন শুধু প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ এবং রাজনৈতিক দূরদর্শিতা।
চ্যালেঞ্জ ও আগামীর পথচলা
বাংলাদেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবার সম্ভাবনা বিশাল হলেও, এই প্রযুক্তি কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের পথে একাধিক কাঠামোগত ও নীতিগত চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত, দেশের স্বাস্থ্য খাতে গুণগত তথ্যভান্ডারের অভাব সবচেয়ে বড় বাধা। বর্তমানে অধিকাংশ সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রোগীর চিকিৎসা ইতিহাস কাগজে সংরক্ষিত হয়, ফলে মানসম্মত ও সমন্বিত ডিজিটাল ডাটা সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এর ফলে এআই অ্যালগরিদম প্রশিক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় বিশ্লেষণযোগ্য ডাটাসেট পাওয়া যায় না। দ্বিতীয়ত, দক্ষ মানবসম্পদের ঘাটতিও একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। চিকিৎসক ও তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের মধ্যে সহযোগিতা এখনো সীমিত এবং স্বাস্থ্য খাতের জন্য বিশেষভাবে তৈরি ডাটা সায়েন্স, বায়োইনফরমেটিক্স ও এআই প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামের অভাব প্রকট। তৃতীয়ত, বাস্তবায়নের প্রাথমিক খরচ, প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও প্রযুক্তির সহজপ্রাপ্যতা গ্রামীণ ও নিম্নআয়ের মানুষের জন্য সীমিত। এটি সমাধানের জন্য সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব (Public-Private Partnership) মডেল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। চতুর্থত, নৈতিকতা ও আইনগত কাঠামো যথাযথভাবে উন্নত না হওয়ায় তথ্যের গোপনীয়তা, ডাটা নিরাপত্তা, পক্ষপাতদুষ্ট ফলাফল এবং এআই সিদ্ধান্তের দায়বদ্ধতা নিয়ে জটিলতা দেখা দিতে পারে। এর সমাধানে একটি স্পষ্ট, প্রযুক্তিবান্ধব জাতীয় নীতি প্রণয়ন অপরিহার্য, যেখানে রোগীর তথ্য সুরক্ষা, ডাটা ব্যবহারের নৈতিক সীমা এবং অ্যালগরিদমিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হবে। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় ধাপে ধাপে সমন্বিত বাস্তবায়ন কৌশল প্রণয়ন করা প্রয়োজন। প্রথম ধাপে স্বাস্থ্য তথ্যের ডিজিটালাইজেশন করতে হবে—বিদ্যমান সব স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানকে এক প্ল্যাটফর্মে এনে ইলেকট্রনিক হেলথ রেকর্ড (ইএইচআর) ব্যবস্থা চালু করে তথ্যের মান ও অ্যাকসেস যোগ্যতা বাড়াতে হবে। দ্বিতীয় ধাপে চিকিৎসক, নার্স ও আইটি পেশাজীবীদের জন্য যৌথ প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়ন প্রোগ্রাম চালু করতে হবে, যাতে তারা এআই টুলের সঙ্গে কার্যকরভাবে কাজ করতে পারেন। তৃতীয় ধাপে যক্ষ্মা শনাক্তকরণ, ডেঙ্গু পূর্বাভাস ও ক্যান্সার স্ক্রিনিংয়ের মতো অগ্রাধিকারভিত্তিক সমস্যা চিহ্নিত করে টেলিমেডিসিনে এআইয়ের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ চালু করে এর কার্যকারিতা যাচাই করা যেতে পারে। চতুর্থ ধাপে, নৈতিক ও আইনগত নীতিমালা প্রণয়ন এবং রোগীর তথ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। সবশেষে, সফল উদ্যোগগুলোকে জাতীয় পর্যায়ে সম্প্রসারণ করে সারা দেশে সমানভাবে এআইভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে।
সমতাভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবায় এআইয়ের বিকল্প কী?
বৈষম্যহীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) বাংলাদেশের জন্য এক যুগান্তকারী সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় বিদ্যমান গ্রাম ও শহরের চিকিৎসাসেবার মানের পার্থক্য, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাব এবং প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ শনাক্তকরণের সীমাবদ্ধতা—সবই এআইয়ের মাধ্যমে অনেকাংশে দূর করা সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, একটি এআইভিত্তিক ডায়াগনস্টিক সিস্টেম গ্রামীণ ক্লিনিকেই একজন প্রাথমিক চিকিৎসককে রোগীর এক্স-রে বা রক্তের রিপোর্ট বিশ্লেষণ করে দ্রুত ও নির্ভুল প্রাথমিক নির্ণয় করতে সহযোগিতা করতে পারে, যা আগে শুধু শহরের বড় হাসপাতালেই সম্ভব ছিল। একইভাবে, একজন গ্রামীণ রোগী যদি মোবাইল ফোনে নিজের উপসর্গ জানান, তাহলে এআইচালিত ভার্চুয়াল হেলথ অ্যাসিস্ট্যান্ট তাৎক্ষণিকভাবে উপসর্গ বিশ্লেষণ করে সম্ভাব্য রোগের ধারণা দিতে পারে, ওষুধ সেবনের সময় স্মরণ করিয়ে দিতে পারে, এমনকি প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সঙ্গে ভিডিও পরামর্শের ব্যবস্থাও করে দিতে পারে। এর ফলে ধনী-দরিদ্র, শহর-গ্রাম নির্বিশেষে সব নাগরিক বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আসতে পারবেন। আধুনিক বিশ্ব এরই মধ্যে স্বাস্থ্যসেবায় এআই প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করেছে এবং এর সুফলও পাচ্ছে। যেমন—যুক্তরাষ্ট্রে ক্যান্সার ও হৃদরোগ শনাক্তকরণে এআই ব্যবহারে রোগীর মৃত্যুহার কমেছে, আবার ইউরোপের দেশগুলোয় টেলিমেডিসিনে এআই-সহায়ক সিস্টেমের মাধ্যমে দূরবর্তী অঞ্চলেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা পৌঁছে যাচ্ছে। সীমিত সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে চাইলে বাংলাদেশকেও এখনই স্বাস্থ্য খাতে এআইয়ের বাস্তব প্রয়োগে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ, এটি শুধু প্রযুক্তিগত অগ্রগতি নয়, বরং এটি সামাজিক ন্যায়, মানবিক সেবা ও বৈষম্যহীন স্বাস্থ্যসেবার প্রতীক। এআইয়ের কার্যকর প্রয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশ এমন এক স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে, যেখানে প্রযুক্তি শুধু চিকিৎসাকে ‘স্মার্ট’ করবে না, বরং ‘সমতাভিত্তিক’ ও ‘সহজলভ্য’ করবে। এজন্য প্রয়োজন শক্তিশালী নীতি-নেতৃত্ব, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব, গবেষণা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং সর্বোপরি একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি, যাতে প্রযুক্তির সুফল দেশের প্রত্যেক মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছায়। এখনই সময়—সঠিক পরিকল্পনা, দ্রুত বাস্তবায়ন ও দীর্ঘমেয়াদি প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে বৈষম্যহীন ও ন্যায়ভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবার হাতিয়ারে পরিণত করার।
ডা. মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম
পোষ্ট-ডক্টোরাল স্কলার, ইন্সিটিউট ফর পপুলেশন এন্ড প্রেসিসন হেলথ, ইউনিভারসিটি ওফ শিকাগো, ইউ এস এ
মন্তব্য করুন