কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২২ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২২ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:৩৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ইনসুলিন: জীবন রক্ষায় শতবর্ষের সাফল্য এবং বাংলাদেশের আত্মনির্ভরতার গল্প

ডা. এম. এ. সামাদ
ইনসুলিন: জীবন রক্ষায় শতবর্ষের সাফল্য এবং বাংলাদেশের আত্মনির্ভরতার গল্প

১৯২১ সাল চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় বছর। কানাডার দুই তরুণ বিজ্ঞানী ফ্রেডরিক ব্যান্টিং ও চার্লস বেস্ট এমন এক আবিষ্কার করলেন, যা পরবর্তী সময়ে অগণিত মানুষের জীবন বাঁচাবে এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানের ধারা বদলে দেবে। সে আবিষ্কারটির নাম—ইনসুলিন।

এর আগে টাইপ-১ ডায়াবেটিস মানেই প্রায় নিশ্চিত মৃত্যু। রোগ নির্ণয়ের পর রোগীরা হয়তো কয়েক মাসের বেশি বাঁচতেন না। চিকিৎসার নাম করে দেওয়া হতো কঠোর উপোসের নিয়ম, যা শুধু সামান্য সময়ের জন্য জীবন বাড়াত কিন্তু সুস্থতা ফেরাতে পারত না। ডায়াবেটিসের কারণে অকালমৃত্যু তখন ছিল এক ভয়াবহ বাস্তবতা। কিন্তু ইনসুলিন আবিষ্কার সেই বাস্তবতা পাল্টে দিল। রোগীরা প্রথমবারের মতো নতুন করে বাঁচার আশা পেলেন। ডায়াবেটিস আর মৃত্যুদণ্ড নয়, এটি হলো এক দীর্ঘস্থায়ী কিন্তু নিয়ন্ত্রণযোগ্য রোগ।

ইনসুলিন আবিষ্কারের পরই আন্তর্জাতিক ওষুধ কোম্পানিগুলো দ্রুত শিল্প পর্যায়ে উৎপাদন শুরু করল। অল্প সময়ের মধ্যেই জীবনরক্ষাকারী এ ওষুধ পৌঁছে গেল বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের রোগীদের কাছে।

পরবর্তী কয়েক দশকে ইনসুলিনের গুণগত মান, নিরাপত্তা এবং কার্যকারিতায় এসেছে যুগান্তকারী অগ্রগতি। প্রথমদিকে ছিল প্রাণিজ উৎস থেকে সংগৃহীত অপরিশোধিত ইনসুলিন। পরে এলো রিকম্বিন্যান্ট ডিএনএ প্রযুক্তি থেকে তৈরি মানব ইনসুলিন, যা অনেক বেশি নিরাপদ ও বিশুদ্ধ। এর পরবর্তী ধাপে তৈরি হলো আধুনিক ইনসুলিন অ্যানালগ, যা শরীরের প্রাকৃতিক ইনসুলিনের মতো কাজ করে এবং রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রণে আরও কার্যকর।

এসব উন্নতি রোগীদের জীবন অনেক সহজ করে তুলেছে। এখন তারা খাবারের সময়, জীবনযাত্রা ও শারীরিক প্রয়োজন অনুযায়ী ইনসুলিন নিতে পারেন। তবে এসব অগ্রগতির পাশাপাশি বেড়েছে চিকিৎসার খরচও। উন্নত দেশগুলোতে ইনসুলিন চিকিৎসার খরচ অনেক সময় বছরে কয়েক হাজার ডলার পর্যন্ত পৌঁছে যায়, বিশেষ করে আধুনিক অ্যানালগ ইনসুলিনের ক্ষেত্রে। বীমা থাকায় ধনী দেশগুলোর অনেক রোগী এ চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারেন, কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলোতে একই চিকিৎসা অনেকের নাগালের বাইরে রয়ে যায়। খরচের কারণে কোনো কোনো ক্ষেত্রে রোগীরা চিকিৎসা বন্ধ করে দেন, যা তাদের স্বাস্থ্যের জন্য বড় ঝুঁকি তৈরি করে।

বাংলাদেশও দীর্ঘদিন ধরে ইনসুলিনের জন্য বিদেশি কোম্পানির ওপর নির্ভরশীল ছিল। দাম ছিল বেশি, সরবরাহ ব্যবস্থা ছিল অনিয়মিত, অনেক সময় বাজারে ওষুধের সংকট দেখা দিত। ইনসুলিনকে সবসময় ২-৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয়, যা ছিল একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

বাংলাদেশে ডায়াবেটিসের প্রকোপ দিন দিন বেড়েই চলেছে। ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফেডারেশনের তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ায় রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে দ্রুত বাড়ছে বাংলাদেশে। শহরায়ন, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন এবং বংশগত কারণ মিলিয়ে রোগীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। তাদের অনেকের জন্য ইনসুলিন জীবন বাঁচানোর একমাত্র উপায়। তাই দেশের ভেতরেই ইনসুলিন উৎপাদন ছিল সময়ের দাবি।

২০০৭ সালে বাংলাদেশের স্থানীয় ওষুধ কোম্পানিগুলো দেশে ইনসুলিন উৎপাদনের উদ্যোগ নেয়। শুরুতে মানের নিশ্চয়তা, রোগীর আস্থা এবং চিকিৎসকদের সমর্থন—সবকিছু নিয়েই ছিল নানা প্রশ্ন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রমাণিত হয়েছে, আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখেই দেশীয়ভাবে ইনসুলিন তৈরি করা সম্ভব এবং তা সাশ্রয়ী মূল্যে রোগীদের হাতে পৌঁছে দেওয়াও সম্ভব।

বাংলাদেশে ১০ মিলি হিউম্যান ইনসুলিনের দাম যেখানে প্রায় ৪১৫ টাকা; Times of India-এর তথ্য অনুযায়ী, ভারতে ১০ মিলি হিউম্যান ইনসুলিনের দাম প্রায় ৬৫০ টাকা। Diabetes.co.uk জানাচ্ছে, যুক্তরাজ্যে একই পরিমাণ ইনসুলিনের দাম প্রায় ১০৮৫ টাকা। আর Medscape-এর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে এটি প্রায় ৯৩০০ টাকা পর্যন্ত পৌঁছে যায়, যা উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে দামের বিশাল বৈষম্য স্পষ্টভাবে তুলে ধরে।

আজ বাংলাদেশের মানুষ স্বল্প-কার্যকরী, মাঝারি-কার্যকরী, প্রিমিক্সড এবং আধুনিক অ্যানালগ—সব ধরনের ইনসুলিনই পাচ্ছেন আগের তুলনায় অনেক সুলভ দামে। এর ফলে রোগীরা এখন তাদের প্রয়োজন, জীবনধারা এবং আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী চিকিৎসা বেছে নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন, যা আগে শুধু উন্নত দেশের জন্যই সীমাবদ্ধ ছিল।

এখন চিকিৎসা বিজ্ঞানে আরেকটি বিপ্লব ঘটছে। সেমাগ্লুটাইড ও টিরজেপাটাইডের মতো আধুনিক ওষুধ ডায়াবেটিসের পাশাপাশি স্থূলতার চিকিৎসায়ও আশার আলো দেখাচ্ছে। এ ওষুধগুলো রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমাতেও সাহায্য করছে, যা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য বিশাল সুবিধা।

তবে ধনী দেশগুলোতে এ ওষুধের দাম এত বেশি যে, সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে থেকে যাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ আবারও স্থানীয়ভাবে এ ওষুধ উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছে। এর ফলে ভবিষ্যতে শুধু দেশের রোগীরাই নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও অনেক দেশ সুলভ মূল্যে এসব চিকিৎসা পেতে পারবে।

বাংলাদেশের ইনসুলিন উৎপাদনের যাত্রা শুরু হয়েছিল স্বাবলম্বী হওয়ার প্রত্যয় থেকে। এখন সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে দেশটি নতুন প্রজন্মের ওষুধেও আত্মনির্ভর হতে যাচ্ছে এবং আন্তর্জাতিক বাজারেও সাশ্রয়ী মূল্যে ওষুধ সরবরাহ করতে পারছে।

এটি শুধু চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাফল্য নয়, বরং একটি দেশের আত্মনির্ভরতার গর্বিত গল্প, যা অন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্যও এক অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।

ডা. এম. এ. সামাদ

এমবিবিএস, ডিএমসি, ডিইএম (ডিইউ), এমএসিইউ (ইউএসএ), চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার অ্যান্ড কনসালট্যান্ট, এন্ডোক্রিনোলজিস্ট

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বিকেলে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করবে এনসিপি

অবশেষে মেয়েকে প্রকাশ্যে আনলেন রণবীর-দীপিকা

শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে বিএনপি নেতা বহিষ্কার

বিশ্বরেকর্ড গড়ল বাংলাদেশ-ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচ

ডেঙ্গুর ছোবলে উপকূল, কিট সংকটে ঝুঁকিতে রোগীরা

পাকিস্তানে ভূমিকম্প, রাতভর আতঙ্ক

নির্বাচনে কোনো চাপের কাছে নতি স্বীকার না করার নির্দেশ সিইসির

কুমিল্লায় যুব অধিকার পরিষদের দুই নেতা গ্রেপ্তার

বাংলাদেশের কেউই যা করতে পারেননি, রিশাদ সেটি করলেন

স্কিন কেয়ারের বেসিক গাইড

১০

প্রবাসীর স্ত্রীকে মারধরের পর সালিশে ‘তালাক’

১১

আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে সেনা কর্মকর্তারা আত্মসমর্পণ করেছেন : আইনজীবী

১২

ফুটবল মাঠে বিমান বিধ্বস্ত

১৩

দেশে কত দামে স্বর্ণ বিক্রি হচ্ছে আজ

১৪

অ্যাটলির বিজ্ঞাপনচিত্রে রণবীর-শ্রীলীলা

১৫

একটি রক্ত পরীক্ষা দিয়েই ৫০ রকম ক্যানসার শনাক্ত সম্ভব!

১৬

বাংলাদেশের প্রথম ‘কার্বন-নিউট্রাল শিশু’ রুহাব

১৭

যেসব সেনা কর্মকর্তাকে কারাগারে পাঠানো হলো

১৮

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফেরাতে দ্বিতীয় দিনে আপিল শুনানি চলছে

১৯

নাইজেরিয়ায় পেট্রোলবাহী ট্যাংকারে বিস্ফোরণ, নিহত ৩৫

২০
X