ইমেরিটাস অধ্যাপক কৃষি-অর্থনীতিবিদ ড. এম এ সাত্তার মণ্ডল বলেছেন, সাম্প্রতিক অর্থবছরগুলোতে বাংলাদেশে একদিকে- সিগারেটের দাম উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বাড়ানো হয়নি, অন্যদিকে- এই ক্ষতিকারক পণ্যের ওপর যথাযথ করারোপও সম্ভব হয়নি। ফলে সিগারেটের সহজলভ্যতার কারণে জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি যেমন বেড়েছে, তেমনি সরকার রাজস্ব থেকেও বঞ্চিত হয়েছে। তবে বাংলাদেশে বর্তমানে ব্যাপকভিত্তিক সংস্কারের সুযোগ তৈরি হয়েছে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে সিগারেটে কার্যকর করারোপ করতে হবে। আগামী বাজেটে সিগারেটে করারোপের ক্ষেত্রে কোনো অজুহাতেই আপসের সুযোগ নেই বলে মনে করেন তিনি।
বৃহস্পতিবার (৮ মে) ঢাকায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ভবনে উন্নয়ন সমন্বয়ের আয়োজনে প্রাক-বাজেট গোলটেবিল বৈঠকে তিনি এ কথা বলেন। ‘সিগারেটে কার্যকর করারোপের প্রস্তাবনা’ শীর্ষক প্রাক-বাজেট গোলটেবিল বৈঠকে তিনি প্রধান অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এ উপাচার্য বলেন, সিগারেটের চাহিদার কার্যকর পথটা কমানোই হচ্ছে বড় অস্ত্র। সিগারেটে স্বাস্থ্যের ঝুঁকি আছে। দেশে সিগারেটের কার্যকর চাহিদা কীভাবে কমানো যায় তা নিয়ে আরও আলোচনা করতে হবে। যেহেতু ধর্মীয় শাস্ত্র বা স্বাস্থ্য শাস্ত্রের আলোচনা করেও আমরা এর ব্যবহার কমাতে পারছি না। সেহেতু অর্থশাস্ত্র দিয়েই তা কমাতে হবে।
তিনি বলেন, ক্ষতিকর কোনো বস্তু যদি বাজারে আসে তার ওপর একটি পেনাল্টির ব্যবস্থা থাকতে হবে। উন্নয়ন সমন্বয় তাদের প্রস্তাবনায় নিম্নস্তর ও মধ্যস্তর এ দুটি স্তরকে একীভূত করার প্রস্তাবনা দিয়েছে তাতে একটি স্তর কমবে। ২০১৯ সালে তামাকজাত পণ্যের ওপর থেকে ২৫ শতাংশ রপ্তানি শুল্ক কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়, এরপর ২০২০ সালে তা পুরোপুরি উঠিয়ে দিয়ে রপ্তানি শুল্ক শূন্য করে দেওয়া হয়। এতে দেখা গেছে দিন দিন তামাকের চাষ বাড়ছে। তাই এবারের বাজেট প্রস্তাবনায় এই পণ্যে সেই আগের মতো ২৫ শতাংশ বা তার থেকেও বেশি রপ্তানি শুল্ক পুনর্বহালের প্রস্তাবনা দেওয়া হবে।
প্রেক্ষাপট উপস্থাপনায় উন্নয়ন সমন্বয়ের গবেষণা পরিচালক আব্দুল্লাহ নাদভী বলেন যে, চলতি অর্থবছরে মাঝামাঝি এসে সব স্তরের সিগারেটের দাম ৮ থেকে ২০ শতাংশ বাড়িয়েছে রাজস্ব বোর্ড। এতে করে একদিকে সরকারের বাড়তি রাজস্ব পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, অন্যদিকে সিগারেটে বিক্রির পরিমাণও কমেছে। আগামী অর্থবছরেও এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখার আহ্বান জানান তিনি। বাংলাদেশের বিভিন্ন তামাকবিরোধী নাগরিক সংগঠন আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বাজারে বিক্রিত সিগারেটের স্তর সংখ্যা চারটি থেকে কমিয়ে তিনটি করার দাবি জানিয়েছে। নিম্ন ও মধ্যম স্তরের সিগারেটকে একীভূত করে ওই নতুন স্তরের সিগারেটের একেকটি শলাকার দাম ৯ টাকা নির্ধারণের পরামর্শ এসেছে এই নাগরিক সংগঠনগুলোর দিক থেকে।
সিগারেটের দাম বাড়ানো এবং এর ওপর কার্যকর করারোপের প্রস্তাব এলেই স্বার্থান্বেষী মহল নানা রকম অপতথ্য প্রচার করে থাকে বলে জানান ইউএনডিপি-এর সিনিয়র অ্যাডভাইজার এস এম মঞ্জুর রশিদ। কর আরোপের মাধ্যমে রাজস্ব বৃদ্ধি আমরা সবাই চাই। রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি যেমন জরুরি অর্জিত রাজস্বকে জনকল্যাণমুখী করাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
গবেষণায় উঠে এসেছে যে, নিম্নস্তরে মানুষের মধ্যে তামাক, জর্দা, বিড়ি ও গুলের ব্যবহার কমেছে এবং সিগারেটের ব্যবহার বেড়েছে। কিন্তু আমরা যারা পাহাড় পর্বতে কাজ করি আমরা দেখি যে, নিম্নস্তরে তামাক, জর্দা, বিড়ি ও গুলের ব্যবহার আরও বেড়েছে। এরসঙ্গে আমরা লক্ষ করছি যে পুরুষের পাশাপাশি নারী ধূমপায়ীর সংখ্যা দিন দিন আরও বাড়ছে।
তিনি আরও বলেন, তামাকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের কীভাবে বিকল্প ব্যবস্থা করা যায় তা নিয়ে ভাবতে হবে। সিগারেট বিক্রি কমে গেলে কর্মসংস্থানের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করা হলেও প্রকৃত পক্ষে তামাক শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকরা দেশের মোট কর্মে নিয়োজিত নাগরিকের সংখ্যার মাত্র দশমিক ২ শতাংশ।
অনুষ্ঠানে আলোচকের বক্তব্যে একাত্তর টেলিভিশনের বিশেষ প্রতিনিধি এবং তামাক-বিরোধী গবেষক-সাংবাদিক সুশান্ত কুমার সিনহা বলেন, সিগারেটের ওপর কার্যকর করারোপের পাশাপাশি সিগারেট কোম্পানিগুলোর কর ফাঁকি ঠেকানোর দিকেও বিশেষ নীতি-মনোযোগ নিশ্চিত করা একান্ত প্রয়োজনীয়। সচেতনতা দিয়ে পৃথিবীতে কোথাও কোনো কিছু হয়নি। শাস্তি ছাড়া পৃথিবীতে কোনো কিছু হবে না।
ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের সিনিয়র ডিরেক্টর চন্দন জেড গোমেজ বলেন, উন্নয়ন সমন্বয় যে গবেষণা করেছে তা কারও পক্ষে বা বিপক্ষে না। এটা মানুষ বাঁচানোর পক্ষে। আমি পাহাড়ি অঞ্চলে গিয়ে দেখেছি সেখানে নারী পুরুষ উভয়েই সিগারেট খাচ্ছে। তাই সেই অঞ্চলগুলোতেও গবেষণা চালানো প্রয়োজন যে, যারা প্রতিনিয়ত তামাক সেবন করে তাদের গড় আয়ু কেমন। যুবক যুবতীদের তামাক থেকে বিরত রাখতে ওয়ার্ল্ড ভিশন ৬০ হাজার ব্যক্তি নিয়ে কাজ করছে। আমাদের প্রত্যেকের জায়গা থেকে জনসচেতনতা বাড়ানো উচিত। বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে শুধু ধূমপানের জন্য ৩ বার সময় ব্যয় করে।
গোলটেবিল বৈঠকে আরও আলোচনা করেন- আদিবাসী অধিকার কর্মী দীপায়ন খীসা, আরডিএফ-এর সদস্য সচিব এম গোলাম মোস্তফা এবং দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বৈঠক সঞ্চালনা করেন উন্নয়ন সমন্বয়ের সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট ড. মাহবুব হাসান।
মন্তব্য করুন