বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়াদের একজন মো. নুরুল হক। জীবন বাজি রেখে তিনি অংশ নেন টাঙ্গাইলের কয়েকটি অভিযানে। যুদ্ধ করেন ফ্রন্ট লাইনে। তার সাহসী অভিযানে মারা যায় পাকিস্তানি বাহিনীসহ অনেক রাজাকার। কিন্তু সেই মুক্তিযোদ্ধা আজ অসহায়। দেশ স্বাধীনের ৫২ বছরেও মেলেনি তার স্বীকৃতি। সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরতে ঘুরতে আজ তিনি ক্লান্ত। নানা অসুখ ভর করেছে শরীরে, শুয়ে আছেন হাসপাতালের বিছানায়। তার শেষ চাওয়া, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি।
জানা যায়, টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতী থানার নাগবাড়ি গ্রামের মো. আজগর আলীর ছেলে নুরুল হক। যুদ্ধের পরে চাকরির কারণে তার বসবাস চট্টগ্রাম নগরীর চান্দগাঁও থানার কালুরঘাটের কেপিএম এলাকায়।
চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি নুরুল হক। মুক্তিযুদ্ধে তার কিছু স্মৃতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিজয়ের মাস ডিসেম্বর, উৎসাহ কিংবা খুশি থাকলেও মনে মনে অনেক কষ্ট পাচ্ছি। কারণ আমার মতো প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা অনেকে এখনও স্বীকৃতিই পাননি। যুদ্ধ শুরুর পর আমরা প্রশিক্ষণ নিই টাঙ্গাইলের জাওয়াল ভেঙ্গুলার ফজলু করিম সিদ্দিকীর বাড়িতে। তিনি তখন তৎকালীন মেম্বার ছিলেন। লাঠি দিয়ে কীভাবে যুদ্ধ করা যায় তার নানা কৌশল নিয়ে আমাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় সেখানে। সেই গ্রামের এক বাড়িতে আমাদের অবস্থানের খবর পাকিস্তানিদের কানে পৌঁছায় এক রাজাকার। তারা আমাদের ওপর আক্রমণ চালাতে আসে জাওয়াল ভেঙ্গুলার সেই বাড়িতে। কিন্তু ওই খবরও পেয়ে যাই আমরা। তিন দলে বিভক্ত হয়ে আমরাও আক্রমণ করার পজিশনে যাই। আমিসহ আমাদের কোম্পানি পাকিস্তানিদের পূর্বদিক থেকে আক্রমণ করি। ওই ঘটনায় আমার মামা শাহ জাহানসহ শহীদ হন প্রায় ছয়জন মুক্তিযোদ্ধা। আর ওই রাজাকারসহ পাকিস্তানিদের প্রায় ৩-৪ জন লোক মারা যায়। বেশকিছু পাকিস্তানি আত্মসমর্পণ করলেও পালিয়ে যায় অনেকে।
এর আগে টাঙ্গাইলের কালিহাতীর বল্লার একটি বাড়িতে অবস্থান নিই আমরা। সেই খবর চলে যায় পাকিস্তানিদের কানে। তারা এসে আক্রমণ চালায় আমাদের ওপর। আমরাও তিন দিক থেকে পাল্টা আক্রমণ চালাই। সেখানেও আমি পূর্বদিক থেকে আক্রমণ করি। ওই অভিযানে রাজাকারসহ প্রায় তিনজন পাকিস্তানি মারা যায়।
মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ নিয়ে দেশ স্বাধীন করলেও গত ৫২ বছরে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি না পাওয়ায় আক্ষেপ কাটছে না এই মুক্তিযোদ্ধার। তিনি বলেন, আমি যে মুক্তিযোদ্ধে অংশগ্রহণ করি তার প্রমাণসহ প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে জমা দিই। কিন্তু এখনো আমাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।
মুক্তিযোদ্ধার (লাল তালিকা) গেজেটভুক্ত হতে নুরুল হক যে আবেদন করেছেন সেই আবেদনে যুক্ত করা কাগজপত্র ঘেটে দেখা যায়, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে নুরুল হক ১১ নম্বর টাঙ্গাইল সেক্টরের হয়ে যুদ্ধ অংশ নেন। এই তথ্য নিশ্চিত করে স্বাধীনতা সংগ্রামের সনদপত্রে স্বাক্ষর করেন ১১ নম্বর সেক্টরের আঞ্চলিক অধিনায়ক কাদের সিদ্দিকী এবং বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর অধিনায়ক মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী।
নুরুল হক যুদ্ধে অংশ নেন ৩ নম্বর কোম্পানি (খ) থেকে। যার কমান্ডার ছিলেন আ. ছবুর মিয়া (গোলাপ)। নুরুল হক একজন নির্ভিক মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ১৯৭১ সালে তার সঙ্গে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে অংশ নেন বলে একটি প্রত্যয়নপত্রে উল্লেখ করেন কমান্ডার আ. ছবুর মিয়া।
অন্যদিকে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধ হিসেবে নুরুল হক যুদ্ধে অংশ নেন বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কালিহাতী উপজেলা কমান্ডের ডেপুটি কমান্ডার মো. কাশেম। এক প্রত্যয়নপত্রে তিনি জানান, নুরুল হক মুক্তিযুদ্ধে কাদেরিয়া বাহিনীর সক্রিয় সদস্য ছিলেন। অসীম সাহসের সঙ্গে অংশ নেন বিভিন্ন রণাঙ্গণে। দীর্ঘকাল তিনি চাকরির সুবাদে এলাকায় অবস্থান না করায় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত বা গেজেটভুক্ত হতে পারেননি।
মুক্তিযোদ্ধা নুরুল হকের ছেলে আসাদুজ্জামান আক্ষেপ নিয়ে কালবেলাকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আমরা এও বলেছি, আমার বাবা যদি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা না হন তাহলে আপনারা যে শাস্তি দিবেন, মাথা পেতে নিব। কিন্তু অনুগ্রহ করে সকল কাগজ ঘেটে, যদি তদন্তের দরকার হয় তা করে হলেও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিন। আমার বাবা প্রচণ্ড অসুস্থ। আমরা চাই, শেষ বয়সে হলেও আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাক।
মন্তব্য করুন