নীলফামারীর ডিমলায় দাদন ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। ফাঁকা ব্যাংক চেক ও স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর দিয়ে চড়া সুদে টাকা নিয়ে অনেকেই সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। সুদে-আসলে জমা টাকা পরিশোধ করতে না পেরে অনেকেই হচ্ছেন ঘর ছাড়া। অনেকে সুদের টাকা পরিশোধ করার পরেও চেক ও স্ট্যাম্পের মিথ্যা মামলায় হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
তেমনি একজন ভুক্তভোগী উপজেলার নাউতারা এলাকার লাভলী আক্তার খুশী। তিনি ওই এলাকার সহির উদ্দিনের মেয়ে। প্রায় ২ বছর আগে লাভলীর বড় ভাই তরিকুল ইসলাম একই এলাকার আইনুল নামে এক দাদন ব্যবসায়ীর কাছে ২০ হাজার টাকার সুদের ওপর নেন। সে সময় জামিনদার হিসেবে লাভলীর কাছ থেকে দুটি ফাঁকা ব্যাংক চেক ও স্ট্যাম্প নেন ওই দাদন ব্যবসায়ী। পরে লাভলীর বড় ভাই সময়মতো সেই সুদের টাকা দিতে না পারায় চাপ প্রয়োগ করে ১১ শতক জমি লিখে নেন দাদন ব্যবসায়ী আইনুল ইসলাম। আর জামিনদার হিসেবে ফাঁকা ব্যাংক চেক ও স্ট্যাম্প জমা থাকায় লাভলীর পরিবারের লোকজনের কাছে আরও ২৩ শতক জমি লিখে নেন ওই দাদন ব্যবসায়ী। জমি লিখে নিয়েও ব্যাংক চেক ও স্ট্যাম্প নিজের কাছে রেখে প্রতিনিয়ত লাভলীর বিরুদ্ধে মামলার হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন আইনুল। পরে এসব হয়রানি থেকে মুক্তি পেতে বিভিন্ন দপ্তরে আইনুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগী লাভলী আক্তার খুশী।
শুধু লাভলীই নয়, দাদন ব্যবসায়ী আইনুলের চাপে গ্রাম ছেড়েছেন শতাধিক পরিবার। এসব ভুক্তভোগী পরিবারের দাবি দাদন ব্যবসায়ী আইনুল ফাঁকা ব্যাংক চেক ও স্ট্যাম্প নিয়ে চড়া সুদে টাকা দেন। পরে সুদে-আসলে জমা টাকা পরিশোধ করার পরও ব্যাংক চেক ও স্ট্যাম্প ফেরত পান না তারা। এরপর শুরু হয় নানা হুমকি-ধামকি।
ভুক্তভোগী লাভলী আক্তার খুশী বলেন, আমার ভাই সুদখোর আইনুলের কাছে ২০ হাজার টাকা নিয়েছিল। এ জন্য জামিনদার হিসেবে আমাকে দুটি ফাঁকা ব্যাংক চেক ও স্ট্যাম্প দিতে হয়েছিল। আমার ভাই কিছুদিন টাকা দিতে না পারায় তার কাছ থেকে চাপ প্রয়োগ করে ১১ শতক জমি লিখে নিয়েছে আইনুল। আমি জামিনদার থাকায় আমার পরিবারের লোকজনের কাছে আরও ২৩ শতক জমি লিখে নেয় এই আইনুল। জমি লিখে নেওয়ার পরও বিভিন্ন ধরনের হুমকি-ধামকি দিয়ে আসছে। আমরা গ্রামবাসী এই আইনুলের জন্য অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছি। এই গ্রামের শতাধিক পরিবার বাড়ি ছাড়া তার একমাত্র কারণ এই সুদখোর আইনুল। আমরা তার কাছ থেকে মুক্তি চাই, তার একটা দৃষ্টান্তমূলক বিচার হোক আমরা সেটাই চাই। এ আইনুল দৈনিক লাভে মানুষের কাছে টাকা দিয়ে থাকে। এক দুই দিন টাকা দিতে না পারলে তার বাড়িতে গিয়ে চেক স্টাম্পের মামলার হুমকি দেয়। আমি আমার ইউনিয়ন পরিষদ, ইউএনও, থানা, ডিসি ও এসপিকে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। তারা তার বিচার করার আশ্বাস দিয়েছে। আমি চাই আইনুলের কারণে গ্রাম ছাড়া পরিবারগুলো গ্রামে ফিরে আসুক তাদের সন্তানদের কাছে এক সঙ্গে পরিবারের থাকুক।
আরেক ভুক্তভোগী একই এলাকার সাইদুল ইসলাম। মেয়ের চিকিৎসার জন্য আইনুলের কাছ থেকে সুদের ওপর ১০ হাজার টাকা নিয়েছিলেন। সুদে-আসলে ৫০ হাজার টাকা পরিশোধ করার পরও সাইদুলের কাছে আরও টাকা দাবি করছেন আইনুল। দাবিকৃত টাকা না দেওয়ায় চাপ প্রয়োগ ও ভয়ভীতি দেখান ওই দাদন ব্যবসায়ী। এসব সহ্য করতে না পারায় গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় পাড়ি জমান তিনি।
সাইদুল ইসলাম বলেন, আমি সুদখোর আইনুলের কাছ থেকে আমার মেয়ের চিকিৎসার জন্য ১০ হাজার টাকা নিয়েছিলাম। সুদে-আসলে ৫০ হাজার টাকা দিয়েছি তাকে। এখন সে আরো টাকা দাবি করছে তার জন্য আমি বাড়িতে থাকতে পারছি না। এ কারণে স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে ঢাকা চলে এসেছি। আমি চাই স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে এই গ্রামে বসবাস করতে। কিন্তু আইনুলের কারণে পারছি না। এই আইনুলের কাছ থেকে যে টাকা নিয়েছে সে সর্বস্বান্ত হয়েছে। আমি তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি
সাইদুলের মেয়ে সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, আমার বাবা আমার চিকিৎসার জন্য আইনুলের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা নিয়েছিল। সেটি সুদে-আসলে ৫০ হাজার টাকা পরিশোধ করেছে। কিন্তু আইনুল যে আমার বাবার কাছ থেকে চেক এবং স্ট্যাম্প নিয়েছে সেগুলো ফেরত দেয়নি। তিনি বিভিন্ন কৌশলে চেক এবং স্ট্যাম্প আটকে রেখেছেন। এখন সে আরো টাকা দাবি করে তার বিভিন্ন আমার পরিবারের কেউই এই বাড়িতে থাকতে পারে না। তার ভয়ে ঢাকায় পালিয়ে আছে শুধু আমার বাবা-মা না শুধু এই এলাকার অনেক পরিবারেরই এমন দশা করেছেন আইনুল। সে কখনোই কারও যে স্ট্যাম্প ফেরত দেয় না এবং জোর করে টাকা দাবি করে। তার ভয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে বেড়ায় অনেকেই।
একই এলাকার পরিনা বেগম বলেন, আমার ছেলে ও মেয়ে আইনুল এর কাছে টাকা নিয়েছিল এবং সেটি পরিশোধ ও করেছিল। কিন্তু চেক স্ট্যাম্প ফেরত না দেওয়ায় আইনুল বিভিন্ন ধরনের হুমকি প্রয়োগ করে। আমার ছেলে ও মেয়ের কাছে চাপ দিয়ে জমি রেজিস্ট্রি করে নিয়েছে। এখন আমার ছেলে মেয়েকে বাড়িছাড়া করেছে আমি চাই এই আইনুলের একটা বিচার হোক।
আইনুলের কাছ থেকে টাকা নিয়ে গ্রাম ছাড়া সাইদুল ইসলামের মেয়ে নাসিমা আক্তার বলেন, আমরা গরিব পরিবার, সংসারের অভাবের কারণে আমার বাবা আইনুলের কাছে ৫ হাজার টাকা নিয়েছিল। তার জন্য দৈনিক লাভ দিতে হয় আমার বাবা যা ইনকাম করে তা থেকে দৈনিক লাভ দেয় এবং আমাদের সংসার চালায়। টাকা পরিশোধ হয়ে গেলেও আইনুল দাবি করে আরও টাকা পাবে সে। যদি টাকা দেওয়া না হয় তাহলে চেক স্ট্যাম্প দিয়ে আমার বাবার নামে থানায় মামলা করবে এমন ভয়ভীতি দেখায়। তার ভয়ে আমার বাবা-মা এখন বাড়িছাড়া। আমি একাই বাড়িতে থাকি আমার পড়াশোনা ও খাওয়াদাওয়ার খুব কষ্ট হচ্ছে।
স্থানীয় বাসিন্দা সাকিব ইসলাম বলেন, আইনুল এলাকায় সুদখোর মাস্টার হিসেবে পরিচিত। তিনি একজন পেশাদার সুদখোর। তার যে নির্দিষ্ট কোনো ইনকামের পথ নেই। সে এই সুদেরই ব্যবসা করে চলে। আমাদের প্রতিবেশী যারা তার কাছ থেকে টাকা নিয়েছে তাদের সে বাড়িছাড়া করেছে। এ রকম মানুষের একটা বিচার হওয়া উচিত যাতে করে আমাদের এই এলাকা শান্ত থাকে আমরা এর একটা দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই।
তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করে আইনুল ইসলাম বলেন, আমি মুরগি ব্যবসা করি, কোনো সুদের ব্যবসা করি না। কেউ বলতে পারবে না। তাদের কাছ থেকে জমি কিনে নিয়েছি। আমার বিরুদ্ধে আনা সকল অভিযোগ মিথ্যা।
নীলফামারী পুলিশ সুপার মোকবুল হোসেন বলেন, এ বিষয়ে অভিযোগের কপি এখনো পাইনি। অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
নীলফামারীর জেলা প্রশাসক পঙ্কজ ঘোষ বলেন, অভিযোগ যদি দিয়ে থাকেন তাহলে অভিযোগ দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।