রাঙ্গুনিয়া (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি
প্রকাশ : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯:০২ পিএম
আপডেট : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯:২৩ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
রাঙ্গুনিয়ার জুটমিল

পাট সংকটে মিল, কর্মহীন ৫শ শ্রমিক

পাট সংকটে মিল, কর্মহীন ৫শ শ্রমিক

বেসরকারি খাতে ইউনিটেক্স গ্রুপের কাছে লিজ দেওয়ার পর উৎপাদনে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল রাঙ্গুনিয়ার কর্ণফুলী জুটমিল। তবে গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর ব্যাংক থেকে নগদ টাকা সংকট এবং বন্যার কারণে উত্তরবঙ্গ থেকে পাট আনতে না পারায় ধুঁকে ধুঁকে চলছে মিলটি।

তিন শিফটে উৎপাদন হওয়া মিলটিতে এখন মাত্র চালু আছে এক শিফট। দৈনিক ১৮ টন সুতা উৎপাদন থেকে কমে এখন হচ্ছে মাত্র ৩ টন। এরই মধ্যে ছাঁটাই করা হয়েছে ৫০০ শ্রমিক। যেসব স্থানীয় শ্রমিক এখনো রয়েছেন, তারাও পাট সংকটে ঠিকমতো কাজ পাচ্ছেন না। এতে চরম বেকায়দায় দিন কাটছে শ্রমিকদের।

অন্যদিকে এই সংকটে ক্রমাগত ক্ষতির মুখে পড়া মিল কর্তৃপক্ষ সরকারকে মাসে ২২ লাখ টাকা ভাড়া চুক্তি থেকে কমিয়ে ১০ লাখ টাকা করার আবেদন করেছে।

জানা যায়, ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় কর্ণফুলী জুটমিলস লিমিটেড। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ২০ বছরের জন্য বেসরকারি খাতে লিজ পায় ইউনিটেক্স গ্রুপ। ৪৭ একর আয়তনের এই প্রতিষ্ঠানটি ইউনিটেক্স গ্রুপ লিজ পাওয়ার পর সুতা উৎপাদনের পাশাপাশি কার্পেট, জুট ব্যাগসহ আরও বিভিন্ন উপকরণ উৎপাদনের প্রক্রিয়া চালাচ্ছিল। মিলে তিন শিফটে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছিল ৭০০ থেকে ৮০০ শ্রমিকের, উৎপাদন হতো দৈনিক ১৮ থেকে ৩০ টন সুতা। উৎপাদিত সুতা রপ্তানি হতো বিশ্বের ১২টি দেশে। যেখান থেকে আসত কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা।

কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের বন্যার কারণে পাটের ঘাটতি আর ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলনে সমস্যার কারণে উৎপাদনে ধস নেমেছে মিলটিতে। তিন শিফটে উৎপাদন হওয়া মিলটিতে বর্তমানে কোনোরকম এক শিফট চালু রয়েছে। অনেকে মিল বন্ধ হওয়ার গুজবও তুলেন। তবে শিগগির মিলটি ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে সংশ্লিষ্টরা সরকারের কাছে সহায়তা কামনা করেছেন।

সরেজমিন গিয়ে জানা যায়, মিলটি বর্তমানে কোনোরকম এক শিফট চালু রয়েছে। যেখানে বর্তমানে স্থানীয় ৭০ থেকে ৮০ জন শ্রমিক দৈনিক কর্মরত রয়েছেন। এক মাস আগেও উৎপাদনের জন্য যেখানে মিলের স্পিনিং মেশিন চলত ২২টি, সেখানে চলছে মাত্র ৬টি। ডায়িং মেশিন ১৮টির মধ্যে চলে ৩টি। বেচিং মেশিন চলে ৩টি, ফাইভেনার চলছে ৫টি। মিলে পূর্বের কেনা ১২০ টন মতো পাট মজুত আছে। এসব দিয়ে এভাবে আগামী এক মাস মিল চালু রাখা যাবে।

অন্যদিকে দেশের অস্থিরতার কারণে বিদেশেও উৎপাদিত সুতা রপ্তানি করা যাচ্ছে না। পূর্বের অর্ডারও সংশ্লিষ্ট দেশের ক্রেতারা বাতিল করে দিচ্ছেন। দেশের অভ্যন্তরে কিছু সংখ্যক উৎপাদিত সুতা রপ্তানি করে কোনোরকম সচল রয়েছে মিলটি।

নাজমা আক্তার নামে এক নারী শ্রমিক জানান, গত তিন বছর ধরে মিলে কর্মরত রয়েছি। আমরা সব মিলিয়ে ৭০ থেকে ৮০ জনের মতো শ্রমিক রয়েছি। দৈনিক এক শিফট উৎপাদন হচ্ছে। যেখানে প্রতিদিন সবাই কাজ পান না। আমি গত সপ্তাহ কাজ পেয়েছি মাত্র তিন দিন, এই সপ্তাহে দুদিন। দিনে ২৮০ টাকা করে পাঁচ দিনের টাকা দিয়ে নিজে চলব, নাকি সংসার চালাব। মিলে কর্মরত সব শ্রমিক এই নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে যাচ্ছেন।

দিলু আক্তার নামে একজন জানান, এই মিলটি নতুন উদ্যোমে চালু হওয়ার পর বাইরের শ্রমিকদের পাশাপাশি স্থানীয় অনেকের কাজের জোগান দিয়েছে। নিয়মিত বেতনের পাশাপাশি ওভার টাইম, হাজিরা বোনাসসহ নানা সুবিধা নিয়ে সুন্দরভাবেই সংসার চলছিল। কিন্তু তিন শিফট থেকে উৎপাদন এক শিফটে চলে আসায় কাজ মিলছে না।

জ্যোৎস্না আক্তার নামে একজন বলেন, এখন মিলে চাকরি করে আর পোষাচ্ছে না। তার পরও পেটের দায়ে থাকছেন। স্বামী নেই। একটা ছেলে নিয়ে কষ্টে আছেন। মিলটি পুরোদমে চালু করা গেলে স্থানীয় শ্রমিকরা কোনোভাবে সংসার নিয়ে বাঁচবেন।

মিলের প্রশাসন সূত্র জানায়, ২০২২ সালে লিজ পাওয়ার পর ইউনিটেক্স গ্রুপ মিলের মেশিনগুলো সংস্কার করে। এরপর বিদেশ থেকে নতুন মেশিন আনার চেষ্টায় ১০ মাস অপেক্ষা করেও এলসি বন্ধ থাকায় তা সম্ভব হয়নি। এর মধ্যে মিলে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। প্রচুর র-ম্যাটেরিয়ালস পুড়ে যায়। যার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে চলে যায় আরও ছয় মাস। এর মধ্যে বিজেএমসি কর্তৃপক্ষ সীতাকুণ্ডের একটি বন্ধ হয়ে যাওয়া মিল থেকে কিছু বস্তা বানানোর মেশিন আনার পরামর্শ দেয়। তাদের পরামর্শ অনুযায়ী আবেদন করে এক বছর অপেক্ষা করেও সেগুলো আর পাওয়া যায়নি।

এদিকে মেশিনগুলো পাওয়ার আশ্বাসে মিলের বাইরে থেকে শ্রমিক নিয়োগ করা হয়। তাদের জন্য ৩০টি পরিবার থাকার উপযোগী কোয়ার্টার নির্মাণ করা হয়, মেরামত করা হয় পরিত্যক্তগুলো। আরও ২৫টি নির্মাণ করার জন্য মালপত্র আনা হয়। মিলে আনা শ্রমিকদের বসিয়ে বসিয়ে বেতন, খাবার, রমজানে ইফতার, ঈদে কাপড়, কোরবানির মাংসসহ নানা সুবিধা দিয়ে মেশিন না পাওয়ায় দুই বছরের বেতন-বোনাস দিয়ে তাদের ফেরত পাঠাতে হয়েছে।

অন্যদিকে শুধু সুতা উৎপাদনের ক্ষেত্রেও বিপাকে পড়তে হয় মিল কর্তৃপক্ষের। পাটের দাম মনপ্রতি ২২০০ টাকা থেকে বেড়ে হয়ে যায় ৩৬০০ টাকা। পরে মিলে মজুতকৃত পাট দিয়ে ১০ মাস চালানো হয়। এর মধ্যে দেশের এ অবস্থায় চরম বিপাকে পড়তে হয়েছে মিলটিকে। ফলে শুরু থেকে বিভিন্ন মেশিন ক্রয়, পুরোনো মেশিন সংস্কার, রাস্তাঘাট সংস্কার, শ্রমিকদের আবাসন ব্যবস্থা করাসহ প্রায় ২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে ফেলে মিল কর্তৃপক্ষ। এখন ক্রমাগত লোকসান দিতে থাকা মিলটি টিকিয়ে রাখতে মিলের মাসিক ভাড়ার চুক্তি ২২ লাখ টাকা থেকে কমিয়ে ১০ লাখ টাকা করার আবেদন করা হয়।

ইউনিটেক্স জুট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের সহকারী পরিচালক রায়হান আহমেদ কালবেলাকে বলেন, আমরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকদের থেকে সরাসরি পাট সংগ্রহ করি। কিন্তু সাম্প্রতিক বন্যার কারণে কৃষকদের থেকে পাট কেনা যাচ্ছে না। তার ওপর ব্যাংক থেকে টাকা উঠাতে না পারায় নগদ টাকার অভাবও রয়েছে। তার পরও ক্রমাগত লোকসান দিয়ে হলেও মিল চালু রেখেছি। সরকারি সহায়তায় শিগগির এ পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে বলে আশা করি।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

অসুস্থ মেয়ের জন্য ত্রাণ নিতে গিয়ে প্রাণ হারালেন গাজার সাবেক খেলোয়াড়

দিল্লিতে মাথায় চুল গজানোর চেষ্টায় ঢাকার সাবেক পলাতক এমপি

কালিগঞ্জে হিন্দু পরিবারের জমি দখলের অভিযোগ, পুলিশের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ

রাকসুর চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ, মনোনয়ন বিতরণ ২৪ আগস্ট

টয়লেটে বসে দীর্ঘ সময় কাটান? যে ভয়াবহ রোগের ঝুঁকির কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা

শেখ হাসিনার সঙ্গে ছবি প্রকাশ করে স্মৃতিচারণ করলেন বাঁধন 

বেতন বৃদ্ধির দাবিতে পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের মেহেরপুরে পৌরসভা ঘেরাও

বিশ্ব মশা দিবস / মশা দমনে সচেতনতাই আনবে কাঙ্ক্ষিত সফলতা

কালীগঞ্জে স্বেচ্ছাসেবক দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা

চার্টার্ড সেক্রেটারি : ব্যতিক্রমধর্মী ও সময়োপযোগী এক পেশা 

১০

সিজিএসের সংলাপে বক্তারা / রাজউক দুর্নীতিমুক্ত না হলে ঢাকা বাঁচবে না

১১

যাদের নিয়ে উমামার প্যানেল ঘোষণা

১২

বিয়ের পর স্বাস্থ্য ও ভুঁড়ি বাড়ে কেন? যা বলছেন পুষ্টিবিদ

১৩

বাংলাদেশ-নেদারল্যান্ডস সিরিজে ম্যাচ অফিসিয়াল হিসেবে থাকছেন যারা

১৪

ছাগল হত্যার অভিযোগে যুবক কারাগারে

১৫

ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি প্রকল্পে বিশাল নিয়োগ, ৮ম শ্রেণি পাসেও আবেদন

১৬

ড. সরোয়ার ও আসিফ মাহতাবকে হত্যার হুমকি ইস্যুতে হেফাজতের বিবৃতি 

১৭

গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্নের হুমকি, গ্রাহকদের যে বার্তা দিল তিতাস

১৮

পাকিস্তানি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পেলেন বাংলাদেশি চিকিৎসক

১৯

আরও শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র বানিয়েছে ইরান

২০
X