রংপুরের পীরগাছায় বসেছে ২৪০ বছরের পুরোনো ঐতিহাসিক ‘নাপাই চণ্ডীর মেলা’। যে মেলাটি শুধু বিনোদন নয়, এক বিপ্লবী নারীর স্মৃতিকে ঘিরে হাজারো মানুষের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ। যার মূল কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন ইতিহাস বিখ্যাত বীর নারী ‘দেবী চৌধুরানী’। যিনি প্রজাদের কাছে দেবীমাতা, লোককথায় চণ্ডীদেবী বা চন্ডীমাতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। আর ব্রিটিশদের চোখে যিনি ছিলেন ‘দস্যুরানি’।
একজন নারী হয়েও যিনি অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে—বাংলার ইতিহাসে তিনিই প্রথম ব্রিটিশবিরোধী নারী যোদ্ধা। যাকে নিয়ে রচিত হয়েছে অসংখ্য নাটক, উপন্যাস, ছবি। তার আত্মত্যাগকে ঘিরেই শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তার জন্মভূমিতে প্রতিবছর বসে এই মেলা।
মুঘলপন্থী জমিদার থেকে বিদ্রোহী নেত্রী
দেবী চৌধুরানী, যার প্রকৃত নাম ‘জয়দূর্গা দেবী’। ছিলেন রংপুরের পীরগাছার তৎকালীন মন্থনা এস্টেটের একজন প্রভাবশালী মুঘলপন্থী জমিদার। জমিদার হয়েও তিনি প্রজাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বিপদের সময়, দান করতেন খাদ্য ও অর্থ, লড়তেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে। তার প্রজারা তাকে ডাকত ‘দেবীমাতা’ বলে। লোকমুখে তিনি ‘চণ্ডীদেবী’ বা ‘চন্ডী মা’ নামেও পরিচিত ছিলেন। ছিলেন সাহস, স্নেহ আর প্রতিবাদের এক প্রতিচ্ছবি।
বিদ্রোহের আগুনে দগ্ধ ইতিহাস
ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে তিনি গড়ে তোলেন সশস্ত্র প্রতিরোধ। ফকির মজনু শাহ, ভবানী পাঠক ও শিবচন্দ্র রায়ের মতো বিপ্লবীদের সঙ্গে গড়ে তোলেন গোপন ঘাঁটি—পীরগাছার চণ্ডীপুরের আলাইকুমারি নদীর তীরে। সেখানে বসত গোপন বৈঠক, প্রশিক্ষণ, অস্ত্রচর্চা। নদীপথে আগত ফকির-সন্ন্যাসীরা ইংরেজদের জাহাজ লুট করে বিতরণ করত খাদ্য ও সম্পদ—যার মূলে ছিলেন এই নারী নেত্রী। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে ফকির-সন্ন্যাস ও প্রজা বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি।
শহীদ হওয়ার পর ‘দস্যুরানি’ অভিধান
১৭৮৩ সালে বৈশাখের এক বৃহস্পতিবার সকালে বর্তমান চণ্ডীপুরে ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে তিনি শহীদ হন। তার এই প্রতিরোধ দেখে ইংরেজরা তাকে আখ্যা দেয় ‘Bandit Queen’। অথচ সেই নারী ছিলেন উত্তর বাংলার নিঃস্ব মানুষের ভরসা, রক্তমাংসের দেবীমাতা।
মেলার নাম ও উৎস
লোকমুখে শোনা যায়, তার মৃত্যুতে সেসময় হতাশাগ্রস্ত মানুষ বলেছিল— ‘নাপাই চণ্ডী’, অর্থাৎ আর ফিরে পাব না আমাদের চণ্ডী মাকে। সেখান থেকেই মেলার নামকরণ— ‘নাপাই চণ্ডী মেলা’। রংপুরের আঞ্চলিক ভাষায় ‘নাপাই’ মানে অপূর্ণতা বা শূন্যতা। আর চণ্ডী ছিল তার আত্মার নাম। এই ব্যথা থেকেই জন্ম নেয় শতাব্দী প্রাচীন এক স্মৃতি-মেলা।
২৪০ বছরের ঐতিহ্য বহনকারী উৎসব
বর্তমানে চণ্ডীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে প্রতি বছর বৈশাখ মাসের প্রতি বৃহস্পতিবার বসে এই মেলা। বৃহস্পতিবার (১ মে) বিকেলে মেলায় গিয়ে দেখা যায়, প্রাণের স্পন্দনে মুখরিত চারপাশ। ৩-৪ শতাধিক দোকানে বিক্রি হচ্ছে খেলনা, গৃহস্থালি সামগ্রী, চুরি, ফিতা, কসমেটিকস, মুড়ি-মুড়কি, বাতাসা, মিস্টি, জিলাপিসহ বিভিন্ন খাবার। শিশুদের জন্য রয়েছে নাগরদোলা, রেলগাড়ি, ইলেকট্রিক বোট। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো।
ঐতিহাসিক নিদর্শন আজও অবহেলায়
মেলা মাঠের পাশে এখনও রয়েছে তিন গম্বুজবিশিষ্ট একটি পুরোনো অবকাঠামো। যাকে কেউ বলেন মসজিদ, কেউ মন্দির। পাশেই রয়েছে একটি বিশাল পুকুর। আশপাশে ধ্বংসপ্রাপ্ত আরও কিছু স্থাপনা রয়েছে—যা গবেষকদের মতে মোঘল আমলের নিদর্শন। মন্থনার জমিদারবাড়ি, যেখানে দেবী চৌধুরানীর বসবাস ছিল, সেটিও এখন অযত্নে ধ্বংসপ্রায়। নেই সংরক্ষণের উদ্যোগ।
সংরক্ষণের জোর দাবি
স্থানীয় গবেষক ও ইটাকুমারী শিবচন্দ্র রায় কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানী কালবেলাকে বলেন, দেবী চৌধুরানী ছিলেন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে প্রথম অস্ত্রধারী নারী যোদ্ধা। এ যাবত কোন সরকারই তার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও স্মৃতি সংরক্ষণে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। তার জীবনী, কীর্তি ও স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলো যদি সরকার সংরক্ষণ করত, তবে তা জাতীয় চেতনা ও শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। এগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে পারত ইতিহাসভিত্তিক পর্যটনও। সেই সাথে নতুন প্রজন্মের কাছে দেবী চৌধুরানী চিরজাগরুক হয়ে থাকতো।
ইতিহাসকে ধারণ করা আমাদের দায়িত্ব
নাপাই চণ্ডীর মেলা কেবল একটি স্থানীয় মেলা নয়—এটি উত্তরবঙ্গবাসীর ইতিহাসবোধ, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। দেবী চৌধুরানী শুধু ইতিহাসের পাতায় নন, তিনি বেঁচে আছেন এই মেলার ধুলোমাটি, দোকানের শব্দ, মানুষের স্মৃতিতে। সময়ের দাবি—এই ইতিহাসকে সংরক্ষণ, উপস্থাপন ও উত্তরসূরিদের জন্য জাগ্রত করে রাখা।
মন্তব্য করুন