রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার ওসমানপুর। এখানকার বদরগঞ্জ-মধ্যপাড়া মহাসড়কের পাশে এখন চোখে পড়বে বাড়িঘর ও আবাদি জমি। অথচ এক সময় এ এলাকায় ছিল বিস্তীর্ণ বনভূমি। ওসমানপুরের মতো সামাজিক বনায়নের অনেক জমি এখন দখলদারদের কব্জায়। এভাবে রংপুরজুড়ে কমে গেছে এ অঞ্চলের সরকারি বনভূমির পরিমাণ।
এ ছাড়া গাছপালা ধ্বংস করে বসতি নির্মাণ ও নগরায়ণের ফলে কমেছে বৃক্ষ আচ্ছাদিত জমি। এতে বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় বেড়েছে উষ্ণায়ন। একই সঙ্গে বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ।
রংপুর আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, গত কয়েক বছরে এ অঞ্চলের গড় তাপমাত্রা শূন্য দশমিক ৭ থেকে ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়েছে। স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৩৪-৩৫ ডিগ্রি থাকার কথা থাকলেও তা বেড়ে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠে যাচ্ছে।
বদরগঞ্জ উপজেলার লোহানীপাড়া গ্রামের মোকছেদুল আলম বলেন, ‘এর আগে এত গরম দেখিনি। প্রতি বছর খালি গরম বাড়ে আর বাড়ে। যেভাবে গাছপালা কমে যাচ্ছে, তাতে গরম আরও বাড়বে।’ একই এলাকার কৃষক ইদ্রিস আলী বলেন, ‘আগে যে পরিমাণ গাছগাছালি ছিল, এখন তো অনেক কমে গেছে। বনজঙ্গল সাফ করে মানুষ বাড়িঘর বানিয়েছে। এজন্য এখন গরমও বেশি আর অল্প ঝড় হলেই ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়।’
প্রাণ-প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে ভূখণ্ডের মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা অপরিহার্য হলেও রংপুরে এর পরিমাণ মাত্র ১২ শতাংশ। বিভাগের অন্য জেলাগুলোয়ও এর পরিমাণ আরও কম। গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচের তথ্য অনুযায়ী, শুধু ২০২৩ সালে রংপুরে ১ হাজার ১৯০ একর বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা কমে গেছে। এ হিসেবে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের পরেই রংপুরের অবস্থান।
রংপুর বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, রংপুরে গাছপালা রয়েছে ২৮১ দশমিক ৭২ বর্গকিলোমিটার, যা ভূমির মোট আয়তনের ১১ দশমিক ৯৪ শতাংশ। নীলফামারীতে ১১১ দশমিক ১২ বর্গকিলোমিটার, যা ৬ দশমিক ৯৭ শতাংশ। গাইবান্ধায় গাছপালা রয়েছে ১৮১ দশমিক ২৭ বর্গকিলোমিটার অংশে, যা মোট ভূমির ৮ দশমিক ১১ শতাংশ। এ ছাড়া কুড়িগ্রামে ১০ দশমিক ৩২ শতাংশ ও লালমনিরহাটে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে গাছপালা রয়েছে।
এদিকে রংপুর বিভাগে সরকারি সামাজিক বন বিভাগের বনভূমি রয়েছে ৭ হাজার ২৪০ একর, যা মোট ভূখণ্ডের অর্ধ শতাংশেরও কম। এর মধ্যে রংপুরে সংরক্ষিত বনভূমি রয়েছে ১ হাজার ৬৯০ একর, রক্ষিত বনভূমি ৪৯৩ একর, অর্পিত ১ হাজার ৭৬৬ একর, অর্জিত ২৭ দশমিক ৩০ একর এবং হস্তান্তরিত হয়েছে শূন্য দশমিক ৫২ একর।
নীলফামারীতে সংরক্ষিত কোনো বনভূমি নেই। রক্ষিত রয়েছে ৬৪৮ দশমিক ১৬ একর, অর্পিত ৫৬১ দশমিক ৫৩ একর। অর্জিত বনভূমি একেবারেই শূন্য। আর হস্তান্তরিত বনভূমি রয়েছে ১ হাজার ৫২৮ একর এবং প্রস্তাবিত রয়েছে ৩২৩ একর। লালমনিরহাটে সংরক্ষিত বনভূমি রয়েছে ৮২ দশমিক ৬২ একর। এ জেলায় অর্পিত, অর্জিত, রক্ষিত, হস্তান্তরিত এবং প্রস্তাবিত বনভূমি নেই। কুড়িগ্রাম জেলায় সংরক্ষিত বনভূমি রয়েছে ১২৮ দশমিক ৫৯ একর। এ জেলাও অর্পিত, অর্জিত, রক্ষিত, হস্তান্তরিত এবং প্রস্তাবিত বনভূমি নেই।
এ বছরে এখন পর্যন্ত দুটি কালবৈশাখী ঝড়ে লন্ডভন্ড হয়েছে এ অঞ্চলের শতশত মানুষের ঘরবাড়ি। ক্ষতিগ্রস্তদের দাবি, বনজঙ্গল ও গাছপালা উজাড় হয়ে যাওয়ায় ঝড়ে ক্ষতির পরিমাণ বেড়েছে।
গত ২৬ এপ্রিল রাতে রংপুরে কালবৈশাখী ঝড় ও শিলাবৃষ্টির তাণ্ডবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তারাগঞ্জ ও গঙ্গাচড়া উপজেলার হাজারো মানুষ। ঝড়ের তাণ্ডবে ঘড়বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও খামারের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া গত ১৪ মে লালমনিরহাটের আদিতমারী ও কালীগঞ্জ উপজেলার ঝড়ের তাণ্ডব চলে ১৫ থেকে ২০ মিনিট। এতে দুই শতাধিক কাঁচা ও আধা-পাকা ঘরবাড়ি লন্ডভন্ড হয়ে যায়। দুই উপজেলার ওপর দিয়ে আকস্মিক শক্তিশালী ঝড়ে মানুষের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
তারাগঞ্জের ইকরচালী ইউনিয়নের ফকিরপাড়া গ্রামের তোফাজ্জল হোসেনের থাকার ঘরসহ দুটি ঘর উড়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘আগের মতন পুরাতন বড় বড় গাছ তো আর নাই যে, বাতাস আটকাইবে। বাড়ির সামনোত গাছপালা থাকলে ঘরগুলো বাঁচিল হয়। এখন অল্প ঝড়ে বেশি ক্ষতি হয়।’
এদিকে বনবিভাগের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, রংপুরের মিঠাপুকুর, বদরগঞ্জ, পীরগঞ্জ, নীলফামারীর ডোমার, ডিমলা, জলঢাকা, কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী, লালমনিরহাটের হাতিবান্ধায় ৭ হাজার ২৪০ দশমিক ৫ একর সরকারি বনভূমি রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় দেড় হাজার দখলদার বনভূমির ১ হাজার ২৩০ দশমিক ১৯ একর জমি দখল করেছে। অবৈধ দলখদারদের বেশিরভাগই স্থানীয় প্রভাবশালী। বন বিভাগ এসব জমি উদ্ধারে মামলা করলেও আইনের দীর্ঘসূত্রিতার কারণে সেটি সম্ভব হচ্ছে না। তবে বনবিভাগের দাবি, প্রায় ২০০ একর বনভূমি অবৈধ দখলদারদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।
পরিবেশবাদী সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, ‘সরকারি বনের দখল হয়ে যাওয়া জমিগুলো উদ্ধার করে সেগুলোতে পুনর্বনায়ন করতে হবে। এ ছাড়া পড়ে থাকা সরকারি জমিগুলোতে গাছ লাগিয়ে পরিচর্যার মাধ্যমে বনায়ন গড়ে তোলা সম্ভব। এখনই এ উদ্যোগগুলো নেওয়া না হলে পরিবেশ মারাত্মক বিপর্যয়ে পড়বে।’
রংপুর বন বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘অবৈধ দখলদারদের কাছ থেকে বনভূমি উদ্ধারে অভিযান চলমান রয়েছে। ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকার কথা থাকলেও রংপুরে সরকারি বন রয়েছে ১ শতাংশের নিচে এবং বেসরকারি পর্যায়ে বৃক্ষ আচ্ছাদিত বনভূমি রয়েছে ১১ শতাংশ।’
মন্তব্য করুন