আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডকে ‘পরিকল্পিত পুলিশি হত্যা’ হিসেবে উল্লেখ করে এর দায় স্বীকার করার বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
তাদের অভিযোগ, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কৌশলে পুলিশের সংশ্লিষ্টতা এড়িয়ে যাচ্ছে। তারা বলেন, হত্যায় জড়িত পুলিশ কর্মকর্তারা বহাল থাকলেও, একই মামলায় অন্য অভিযুক্তরা মাসের পর মাস ধরে কারাগারে বন্দি—এটি তদন্ত প্রক্রিয়ার ভয়াবহ বৈষম্য এবং ন্যায়বিচারের সঙ্গে প্রতারণা।
বৃহস্পতিবার (২৬ জুন) বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ আবু সাঈদ গেটে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব অভিযোগ তুলে ধরেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।
তারা দাবি করে বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল একাধিক প্রেস ব্রিফিংয়ে এ মামলার নানা দিক তুলে ধরলেও, বারবার কৌশলে পুলিশের নাম এড়িয়ে গেছে। এটি একটি পরিকল্পিত পুলিশি হত্যাকাণ্ড, যা জাতির সামনে স্বীকার করার জন্য চিফ প্রসিকিউটরের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে মামলার অন্যতম সাক্ষী ও রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার সোহাগ লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান। তিনি বলেন, আবু সাঈদ হত্যা মামলার প্রাথমিক তদন্তভার দেওয়া হয়েছিল পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ— পিবিআই-এর হাতে। পরে তদন্তকে আরও নিরপেক্ষ ও গতিশীল করার লক্ষ্যে তদন্তভার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তদন্ত চলাকালে বিভিন্ন সময়ে ট্রাইব্যুনাল আমাদের কাছ থেকে তথ্য ও প্রমাণ সংগ্রহ করেছে এবং আমরা সেই প্রমাণ দিয়ে তদন্তে সহযোগিতা করেছি।
তিনি আরও বলেন, তবে তদন্তের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ট্রাইব্যুনাল যেসব সংবাদ সম্মেলন করেছে, সেখানে আমরা লক্ষ করেছি—তারা অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে পুলিশের সম্পৃক্ততার বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। এই হত্যাকাণ্ডে অল্পবিস্তরভাবে যারা দায়ী তাদের সামনে উপস্থাপন করার মধ্য দিয়ে যারা এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাকারী এবং যাদের নির্দেশে গুলি করা হয়েছে তাদের দায়মুক্তি করার একটি প্রবণতা আমরা লক্ষ করেছি।
সোহাগ বলেন, আজ তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এক সংবাদ সম্মেলন করেছে। সেখানে তারা ৩০ জনের এ ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা উল্লেখ করেন। তবে এবারও অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে তারা পুলিশের সম্পৃক্ততার বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। তারা একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে প্রশাসনিক দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে অভিযুক্ত হিসেবে উল্লেখ করলেও, পুরো বক্তব্যে পুলিশের কোনো সংশ্লিষ্টতার কথা উল্লেখ করেননি। অথচ জাতিসংঘের একটি তদন্ত প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে—আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ড ছিল একটি পরিকল্পিত পুলিশি হত্যাকাণ্ড।
তিনি বলেন, দুটি বিষয়কে কেন্দ্র করে আমরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছি। প্রথমত, একটি পরিকল্পিত পুলিশি হত্যাকাণ্ডকে সচেতনভাবে ‘প্রশাসনিক হত্যাকাণ্ড’ হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, যেসব ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা এই ঘটনার জন্য দায়ী—তাদের তদন্ত থেকে সূক্ষ্মভাবে পাশ কাটিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
এ ছাড়া, গত ২৩ জুন রংপুরে ট্রাইব্যুনালের একটি বিশেষ টিমের গণশুনানি আয়োজনের কথা থাকলেও, শেষ মুহূর্তে তা বাতিল করে দেওয়া হয়। এই ঘটনাও তদন্ত প্রক্রিয়া নিয়ে আমাদের মধ্যে গভীর সন্দেহ ও অনাস্থা সৃষ্টি করেছে।
সোহাগের দাবি, আমরা লক্ষ করেছি, আমাদের দেওয়া তথ্য-প্রমাণের সঙ্গে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের বক্তব্যে বেশ কিছু অসামঞ্জস্য রয়েছে। অতীতেও একাধিকবার দেখা গেছে, তিনি বিভিন্ন বিষয়ে বিভ্রান্তিকর ও ভুল তথ্য উপস্থাপন করেছেন এবং কিছু ব্যক্তির পরিচয়ও ভুলভাবে উল্লেখ করেছেন। এই বিষয়গুলো আমরা গুরুত্বসহকারে সামনে আনছি এবং ট্রাইব্যুনাল ও চিফ প্রসিকিউটরকে আহ্বান জানাচ্ছি—আপনারা যে ধোঁয়াশা সৃষ্টি করেছেন, তা দূর করবেন। আমরা জোর দিয়ে বলতে চাই, এটি একটি পরিকল্পিত পুলিশি হত্যাকাণ্ড, এই সত্যটি জাতির সামনে স্বীকার করতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এস এম আশিকুর রহমান ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়ে বলেন, ‘আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রংপুরে ঘটনাস্থলে এসে হামলার প্রত্যক্ষদর্শী, আহত ও সংশ্লিষ্টদের অংশগ্রহণে গণশুনানির আয়োজন করতে হবে। সেখান থেকে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত নিশ্চিত করে দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। তা না হলে আমরা আবারও আন্দোলনে নামব।’
আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গত বছরের ১৮ আগস্ট মামলা করেন তার বড় ভাই রমজান আলী। মামলায় ১৭ জনের নাম উল্লেখ করে এবং আরও ৩০ থেকে ৩৫ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। পরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ নেতা ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক প্রক্টর শরিফুল ইসলামসহ সাতজনের নাম মামলায় নথিভুক্ত করার জন্য সম্পূরক এজাহার দায়ের করেন তিনি। আদালতের আদেশে তাদেরও ওই মামলায় নামীয় এজাহারভুক্ত আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
মন্তব্য করুন