হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলা সদরে অবস্থিত ‘দীননাথ ইনস্টিটিউশন সাতকাপন সরকারি মডেল হাইস্কুল’-এর ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক প্রণয় চন্দ্র দেবের বিরুদ্ধে শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণের নিমিত্তে স্কুলের শিক্ষকদের নিকট থেকে ধাপে ধাপে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে কয়েক লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ করেছেন শিক্ষক ও অভিভাবক।
জানা যায়, ২০১৬ সালে সারা দেশের যেসব উপজেলায় সরকারি কলেজ ও হাইস্কুল নেই সেসব প্রতিটি উপজেলায় একটি করে সরকারি কলেজ ও হাইস্কুল করার ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কারণ ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় আসার পর থেকেই শিক্ষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেন। দীর্ঘ পরিক্রমা অতিক্রম করে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরের বছর ২০১৭ সালে সেই সরকারিকরণের কার্যক্রম শুরু হয়। সেই সময় বাহুবল উপজেলার দীননাথ হাইস্কুল, পুটিজুরী এসসি হাইস্কুল ও মিরপুর ফয়জুন্নেছা হাইস্কুল সরকারিকরণের দাবিতে স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ছাত্র-শিক্ষক অভিভাবক আন্দোলনে নামেন। এই আন্দোলনে পুলিশের সাথে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ভাঙচুরও হয়। অবশেষে দীননাথ ইনস্টিটিউশন সাতকাপন হাইস্কুলটি জাতীয়করণের জন্য নির্বাচিত হয় সরকারের কাছে। শুরু হয় আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া।
এ সুযোগে স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক প্রণয় চন্দ্র দেব বিভিন্ন ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়ে স্কুলকে জাতীয়করণের জন্য সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে দৌড়ঝাঁপ করতে হবে এবং প্রতিটি দপ্তরেই সালামী টাকা-পয়সা ছাড়া হবে না। তিনি প্রতিটি ধাপেই প্রতিজন শিক্ষক থেকে সময়ে সময়ে অদ্যাবদি পর্যন্ত চাঁদা তুলে নেন। গড়ে প্রতি শিক্ষক থেকে আদায় হয় প্রায় ১৪ লাখ টাকা। এর মাঝে ১১ জন শিক্ষকের চাকরি জাতীয়করণের প্রক্রিয়া প্রায় সম্পন্ন। ৩ শিক্ষকের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত কিছু হয়নি এখনো। তাদের ফাইল কোনো অবস্থায় আছে তাও বলতে পারছেন না ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। তারাও তো টাকা দিয়েছেন বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষকরা জানান। তাহলে এতসব টাকা কোথায় ব্যয় করা হয়েছে? এর কোনো সদোত্তর নেই।
এদিকে যাদের চাকরি জাতীয়করণ হয়েছে তাদের বেতনভাতা গত আগস্ট মাস থেকে বন্ধ করেছে সরকার। এর মাঝে খুব শিগগিরই সেইসব শিক্ষকের ২০১৭ সাল থেকে এরিয়ার হিসাবে বেতনভাতা ছাড় করে নিয়ে আসার জন্য ঢাকায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ১২টি দপ্তরে তদবির করতে আরো জনপ্রতি লাখ খানেক টাকা শিক্ষক থেকে চাঁদা উঠানোর প্রস্তুতি চলছিল। অনেক শিক্ষককে চাঁদা দেওয়ার জন্য ইঙ্গিতও দেওয়া হয়।
অনুসন্ধানকালে অনেক শিক্ষক শিক্ষিকা ও তাদের অভিভাবক চাঁদাবাজির কথা স্বীকার করেন। বেরিয়ে আসে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ও তার সিন্ডিকেটের কারসাজি। এর মাঝে গোপন অনুসন্ধানে নামেন স্কুলের সিনিয়র শিক্ষক শাহ কামরুন্নাহারের স্বামী জাকিরুল ইসলাম চৌধুরী ওরফে মুকুল চৌধুরী।
তিনি গত ২৮ আগস্ট মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগীয় উপপরিচালকের সাথে সরাসরি সাক্ষাতে অফিসে গেলে অভিযোগ শুনে ক্ষেপে যান ডিডি। সাথে সাথেই তার সামনেই ফোন দেন প্রণয় চন্দ্র দেবকে। তিনি ২০১৭ সাল থেকে শিক্ষকদের কাছ থেকে যত টাকা চাঁদা নেওয়া হয়েছে তা ফেরত দিয়ে সকল ঝামেলা নিষ্পত্তির নির্দেশ দেন। এই নির্দেশ পেয়েই দৌড়ঝাঁপ শুরু হয় প্রধান শিক্ষকের মাঝে। তিনি সকল শিক্ষককে ম্যানেজ করার চেষ্টা করেন। ওইদিনই প্রণয় চন্দ্র দেব স্কুলের স্বার্থে সকল শিক্ষকের স্বাক্ষরিত একটি রেজুলেশন কপি নিয়ে ৩০ আগসট সিলেট ডিডি অফিসে যান। এদিকে জাকিরুল ইসলাম চৌধুরী মুকুল টাকা ফেরত আনার জন্য ৩০ আগস্ট স্কুলে যান। স্কুলে প্রধান শিক্ষককে না পাওয়ায় সহকারী প্রধান শিক্ষক আবুল ফজলকে জানালে তিনি প্রধান শিক্ষক আসলে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন। পর দিন ৩১ আগস্ট মুকুল চৌধুরীকে বিকাল সাড়ে ৪টায় স্কুলের আসার জন্য মোবাইল ফোনে অনুরোধ করেন। তিনি যথাসময়ে স্কুলে গেলে শিক্ষক মিলনায়তনে একটি গোপন বৈঠকে বসেন প্রধান শিক্ষক প্রণয় চন্দ্র দেব। সেখানে মুকুল চৌধুরীসহ উপস্থিতি ছিলেন শিক্ষক আবু নাসের, তাজউদ্দিন, ক্লার্ক সালেহ আহমদ।
এসময় মুকুল চৌধুরী চাঁদার মোট লক্ষাধিক টাকা ফেরত চাইলে প্রণয় চন্দ্র দেব টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করে টাকা ফেরতের অসামর্থ্য দেখিয়ে মুকুল চৌধুরীর কাছে হাতে পায়ে ধরে টাকা মাফের অনুরোধ করেন। তখন মুকুল চৌধুরী বলেন লক্ষাধিক টাকা মাফ করে দেওয়া সম্ভব নয় বলে জানান।
এ ব্যাপারে মুকুল চৌধুরী এ প্রতিনিধির কাছে ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরেন। এর দুদিন অপেক্ষার পর বিষয়টি মুকুল চৌধুরী স্থানীয় এমপি, উপজেলা ও জেলা শিক্ষা অফিসারকেও অবগত করেন বলে জানান মুকুল চৌধুরী।
জানতে চাইলে জেলা শিক্ষা অফিসার মো. রুহুল্লাহ বলেন, আমি অভিযোগ শুনেছি। তবে লিখিত অভিযোগ পেলে অবশ্যই তদন্তের ব্যবস্থা হবে। এদিকে চাঁদাবাজির বিষয়য়ে স্কুলে কর্মরত কয়েকজন শিক্ষক শিক্ষিকা ও তাদের অভিভাবক সত্যতা স্বীকার করে বলেন- স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আমাদের সাথে প্রতারণা করে চাঁদা তুলেছেন। আমাদের টাকা ফেরত চাই।
মন্তব্য করুন