শাহ জামাল শিশির, ঝিকরগাছা (যশোর)
প্রকাশ : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৭:৫৯ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

‘ইউরোপ যাত্রায় মৃত্যুকূপে কেটেছে জীবনের দেড় বছর’

অভিযুক্ত নজরুল ইসলাম রিপন। ছবি : সংগৃহীত
অভিযুক্ত নজরুল ইসলাম রিপন। ছবি : সংগৃহীত

কথা ছিল স্বল্প খরচে ইউরোপে পৌঁছে দিয়ে উন্নত জীবন-যাপনে সহায়তা করবেন। কিন্তু দালালের সেই মিষ্টি কথায় নিঃস্ব হয়েছে পরিবার। ভুক্তভোগীর ভাষ্যমতে, জীবিত অবস্থায় জাহান্নাম দেখে এসেছেন। মৃত্যুর খুব কাছ থেকে ফিরে এসেছেন।

যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার দোস্তপুর গ্রামের মৃত মোশারেফ হোসেনের ছেলে সাদ্দাম হোসেন। উন্নত জীবনের আশায় দালালের প্রলোভনে পড়ে লিবিয়া থেকে সমুদ্রপথে ইতালি হয়ে বর্তমানে স্পেনে বসবাস করছেন। তবে এই যাত্রায় মৃত্যুকূপে কাটিয়েছেন জীবনের দেড় বছর। সার্বক্ষণিক মাফিয়া চক্রের নির্মম অত্যাচার সহ্য করে অন্তত ৫৪ লাখ টাকা খরচ করে তিনি বেঁচে ফিরেছেন।

ভুক্তভোগীর দাবি, মনিরামপুর উপজেলার কাশিপুর গ্রামের আমজেদ হোসেনের ছেলে আদম ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম রিপনের প্রলোভনে তারা নিঃস্ব হয়েছেন।

ভুক্তভোগী সাদ্দাম জানান, ২০২৩ সালে রিপনের সঙ্গে তার পরিবারের ১১ লাখ ৫০ হাজার টাকায় চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী তাকে বিমানপথে ইউরোপের দেশ ইতালি পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেটা না করে তাকে দুবাই, মিসর, কুয়েত হয়ে লিবিয়া নিয়ে যাওয়া হয়। তবে মিসর পৌঁছানোর পরে চুক্তির সব টাকা নিয়ে নেয় দালাল। এরপর শুরু হয় নানা অজুহাতে বাড়তি টাকা নেওয়া। চুক্তির বাইরেও দালাল হাতিয়ে নেয় আরও ১০ লাখ টাকা।

তিনি জানান, লিবিয়ায় নিয়ে তাকে ইতালি যাওয়ার কথা বলে রুম থেকে বের করা হয়। পরে সাগরে ৩০/৪০ মিনিট যাওয়ার পরে পুলিশ এসে ধরে ফেলে। পরে বুঝতে পারেন, দালালের যোগসাজশে মাফিয়ার কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। সেখানে এক মাস আটকে রেখে নির্যাতন করে নেওয়া হয় বাড়তি ১৫ লাখ টাকা।

সাদ্দাম জানান, লিবিয়ায় বাংলাদেশিদের বিশাল মাফিয়া বাহিনী রয়েছে। দালাল রিপনের গ্যাং লিডার ছিল কুষ্টিয়ার শাহীন ওরফে জাদু দালাল। পুরো ঘটনায়, শাহিনুর রহমান জাদু, তৌহিদুল ইসলাম পিন্টু, তার স্ত্রী, আমজেদ মাস্টার এবং লিটন নামের এক ব্যক্তি জড়িত।

তিনি জানান, লিবিয়ার ত্রিপোলিতে তাকেসহ অন্তত ৮০ বাংলাদেশিকে আটকে নির্যাতন চালানো হতো। ঠিকমতো খাবার দেওয়া হতো না। নির্যাতনের ভিডিও ধারণ করে দেশে আত্মীয়স্বজনের কাছে পাঠিয়ে মুক্তিপণ দাবি করা হতো। প্রথম ধাপে ১৫ লাখ টাকা দেওয়ার পরও মাফিয়াদের অত্যাচার থামেনি।

নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে সাদ্দাম বলেন, অন্তত এক বছর বন্দি জীবন পার করেছি। অন্ধকার ঘরে আমাদের বেঁধে রাখা হতো। সূর্যের আলো চোখে দেখিনি কোনোদিন। লোহার রড দিয়ে সারাক্ষণ পেটানো হতো। এমনকি নির্যাতনের ভিডিও ধারণ করে পাঠানো হতো দেশে আত্মীয়স্বজনের কাছে। আমাদের সারা শরীরে ঘা হয়ে গিয়েছিল। অনেকেই নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে মারা গেছে। মরুভূমিতে মৃত ভেবে ফেলে দেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, ১৫ লাখ টাকার বিনিময়ে মাফিয়াদের কাছ থেকে মুক্তি পেলেও একটা ঘরে আটকে রেখেছিল দালাল। সেখান থেকে বাইরে যাওয়ার উপায় ছিল না। সবকিছুই ঘরের মধ্যে, একপ্রকার জেলখানা। অনেকের কাছ থেকে মুক্তিপণ নেওয়ার পরে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। সেখানে কয়েক মাস জেল খাটার পরে বাংলাদেশ দূতাবাস ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) সহায়তায় দেশে ফিরতে পারি।

ভুক্তভোগী সাদ্দামের মামা তরিকুল ইসলাম জানান, লিবিয়ায় যাওয়ার পরে সাদ্দামের কোনো খোঁজ ছিল না। দালাল রিপন জানায়- সে মাফিয়ার কাছে ধরা পড়েছে। তবে তারা ছাড়ানোর ব্যবস্থা করছে। পরে একদিন হঠাৎ একটা নম্বর থেকে কল আসে। তারা সাদ্দামকে কিনেছে বলে জানায় এবং তার মুক্তির জন্য ২০ লাখ টাকা দাবি করে এবং ভিডিও কলে রেখেই অত্যাচার করতে থাকে। পরে তাদের সঙ্গে দেনদরবার করে বাংলাদেশ থেকে মোট ১৫ লাখ টাকা পাঠানো হয়। বিষয়টি দালাল রিপনকে জানালে সে কিছু করতে পারবে না বলে জানায় আমাদের।

তরিকুল বলেন, দুটি বেসরকারি ব্যাংকের ৮টি অ্যাকাউন্টে মোট ১২ লাখ টাকা পাঠানো হয়। এ ছাড়া মোবাইল ব্যাংকিংয়ে দেওয়া হয় আরও তিন লাখ টাকা। এসব ব্যাংক অ্যাকাউন্ট কারা পরিচালনা করে সেটা বের করলেই মাফিয়াদের খুঁজে পাওয়া যাবে।

তরিকুল জানান, দালাল রিপনের সঙ্গে তিনি তার ভাগনেকে ইতালি পৌঁছানোর চুক্তি করেন ১১ লাখ ৫০ হাজার টাকায়। তবে দালাল তার ভাগ্নে সাদ্দামকে আটকে রেখে ব্ল্যাকমেইল করে বাড়তি ৯ লাখ ২০ হাজার টাকাসহ সর্বমোট ২০ লাখ ৭০ হাজার টাকা নিয়েছেন। এসব টাকা দালাল রিপনের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পাঠানো হয়েছে। এর বাইরে মাফিয়াকে দিয়েছেন ১৫ লাখ টাকা। মাফিয়ার কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে ইতালি পৌঁছাতে অন্য মাধ্যমে খরচ করা হয়েছে আরও ১৫ লাখ টাকা।

তিনি জানান, রিপনের যোগসাজশের কারণেই তাদের এই করুণ পরিণতি হয়েছে। তিনি আদালতে মামলা করবেন বলে জানান। এতদিন তার ভাগ্নে সাদ্দামের নিরাপত্তাজনিত কারণে তিনি আইনগত ব্যবস্থা নেননি।

স্বপ্নের ইউরোপ যাত্রায় শুধু সাদ্দাম হোসেন নয়; আরও ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তারা সবাই দালাল রিপনের খপ্পরে পড়ে সর্বস্বন্ত হয়েছেন। সবকিছু হারিয়ে, এক বছর লিবিয়ায় মানবেতর জীবন পার করে মুক্তিপণের টাকা দিয়ে দেশে ফিরেছেন।

জানা যায়, মনিরামপুর উপজেলার কাশিপুর গ্রামের মৃত নওশের আলী বিশ্বাসের ছেলে সোহেল রানা মিলন মুক্তিপণের টাকা শোধ করেও জেল খেটেছেন। এরপর আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএমের মাধ্যমে ফিরে এসেছেন দেশে।

তিনি বলেন, বড় জাহাজে করে ইতালি নিয়ে যাবে সেই প্রলোভন দেখিয়েছিল রিপন। চুক্তির ১১ লাখ টাকা শোধ করার পরও অতিরিক্ত দুই লাখ টাকা নিয়ে কাঠের ছোট বোটে করে সাগর পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করেন তারা, কিন্তু ধরা পড়ে যান। পরে তাদের মাফিয়ার কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। সেখান থেকে অতি কষ্টে পালিয়ে গেলেও ইউরোপ যাত্রার জন্য মুক্তিপণের ৫ লাখ টাকা দিতে হয় দালালকে। পরে আবারও দ্বিতীয়বার কাঠের বোটে করে সাগর পাড়ি দিতে গেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ধরা পড়েন। সেখান থেকে লিবিয়ার ত্রিপোলিতে জেল খেটে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএমর মাধ্যমে দেশে ফিরে আসেন। এই পুরো প্রক্রিয়ায় অন্তত এক বছর পার হয়ে যায়। লিবিয়ায় তাদের ওপর অত্যাচার করা হতো, ঠিকমতো খেতে দেওয়া হতো না বলে জানান মিলন। সব মিলিয়ে মিলন ১৮ লাখ টাকা দিয়েছেন দালালকে।

মিলন অভিযোগ করেন, মানব পাচার ছাড়াও এই দালালচক্রের আরেকটি ব্যবসা আছে। ভূমধ্যসাগরে যারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ধরা খায় তাদের অল্প টাকা খরচ করে তারা ছাড়িয়ে আনে। এরপর নিজেদের জিম্মায় নিয়ে চলে অত্যাচার। দেশে তাদের আত্মীয়স্বজনের কাছে নির্যাতনের ভিডিও পাঠিয়ে মুক্তিপণ দাবি করে তারা। এরপর মুক্তিপণ নিয়ে আবার পুলিশের কাছে দিয়ে দেওয়া হয়। সেখান থেকে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএমের মাধ্যমে তাদের দেশে পাঠানো হয়।

এ বিষয়ে অভিযুক্ত দালাল নজরুল ইসলাম রিপন জানান, তিনি পুরো প্রক্রিয়ায় জড়িত নয়। ভুক্তভোগীদের প্রকৃত দালাল কুষ্টিয়ার শাহিনুর রহমান জাদু। তিনি শুধু আর্থিক লেনদেন করে সেই টাকা দালালের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন।

তিনি বলেন, লিবিয়ায় নিয়ে যাওয়া কিংবা মাফিয়ার কাছে বিক্রি করে দেওয়ার কাজে আমার কোনো হাত নেই। শুধু আমার মাধ্যমে লেনদেনের কারণে আমি ফেঁসে গেছি। অভিযোগ করলেও আমার কিছু করার নেই।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে দালাল শাহিনের ব্যবহৃত বাংলাদেশের তিনটি নম্বর এবং লিবিয়ার একটি নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সংযোগ পাওয়া যায়নি।

যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) আবুল বাশার বলেন, মানব পাচার প্রতিরোধে পুলিশ কাজ করছে। এই চক্রের সন্ধান পেলেই তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ভুক্তভোগীদের তিনি আইনগত সহায়তা নেওয়ার পরামর্শ দেন।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামানের প্রতিষ্ঠানে দুদকের হানা

ঢাবিতে ডাকসুর নতুন উদ্যোগ

বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর আ.লীগের হামলা, আহত ৩০

জয়ের জন্য বাংলাদেশের দরকার ১৬৯ রান

‘বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার রোধে সতর্ক র‌্যাব’

ভারতের বিপক্ষে মোস্তাফিজের ঐতিহাসিক কীর্তি

মুসলিম দেশগুলোর নেতাদের সঙ্গে ট্রাম্পের বৈঠক, কী সিদ্ধান্ত হলো

চট্টগ্রামে ৭০ শতাংশ মোটরসাইকেলচালকই মানেন না গতিসীমা

শিক্ষকদের রাজনীতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে : মোস্তফা জামান 

মাদ্রাসায় পূজার ছুটি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টাকে চিঠি

১০

খুনিদের দৃশ্যমান বিচার আমরা দেখতে চাই : সারজিস

১১

চোখের পলকে টাকা গায়েব করে দিলেন ‘দুই বিদেশি’

১২

যেসব খাবার খেলে হু হু করে কমে যাবে শুক্রাণু, বলছে গবেষণা

১৩

অভিষেক ঝড়ের পর ধীরে ধীরে ম্যাচে ফিরছে বাংলাদেশ

১৪

অটোরিকশা গ্যারেজে অভিযান, বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন

১৫

এবার বিক্ষোভে উত্তাল ভারতের লাদাখ, পুলিশের গুলি

১৬

অগ্নিদগ্ধ ফায়ার ফাইটার শামীমকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন

১৭

উপাচার্যের অগোচরে জবির রেজিস্ট্রার দপ্তরে বড় রদবদল

১৮

অবাধ নির্বাচনের জন্য উৎসবমুখর পরিবেশ জরুরি : চসিক মেয়র

১৯

জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষার্থীদের ৬ নির্দেশনা

২০
X