মায়ের কণ্ঠে কান্না, বাবার চোখে নিস্তব্ধতা—এ দুই দৃশ্যই যেন আজ কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলার জিনারী গ্রামকে ঘিরে রেখেছে। এক সময় হাসিখুশিতে ভরা ছিল গ্রামের বাড়িটি।
সকালবেলা রামেলের হাসির শব্দে ঘুম ভাঙত মা যমুনা আক্তারের। আজ সেখানে শুধু শোকের নিস্তব্ধতা। গ্রামের বাতাসেও যেন শোক। গ্রামের শান্তিপ্রিয় রফিকুল ইসলামের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সন্তান রামেল আর নেই।
যে একসময় পরিবারের আশার আলো ছিল, এখন সে ছেলেটি মাটির নিচে চিরনিদ্রায় শায়িত। রামেল (২২) ছিল এক দরিদ্র পরিবারের সন্তান। বাবা রফিকুল ইসলাম দিনমজুর, মা যমুনা আক্তার গৃহিণী। অভাবের সংসারে হাসি ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিল রামেল। কয়েক মাস পর প্রবাসে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। পাসপোর্ট করেছে, মেডিকেল শেষ। প্রতিদিনই নতুন নতুন পরিকল্পনা করত—বিদেশে গিয়ে প্রথমেই মায়ের জন্য একটা ভালো ঘর বানাবে। কিন্তু সেই সব স্বপ্ন থেমে গেছে ৩০ সেপ্টেম্বরের রক্তাক্ত বিকেলে।
জানা গেছে, সেদিন বিকেলে বেলতৈল স্কুল মাঠে বন্ধুদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলতে গিয়েছিল রামেল। খেলা শেষে রাস্তার পাশের দোকান থেকে ঠান্ডা পানীয় কিনে ফেরার সময় ওত পেতে থাকা জিনারী ইউনিয়নের তেঁতুলিয়া গ্রামের লাল মিয়ার ছেলে মো. নাঈম (২২), ছিদ্দিক মিয়ার ছেলে তারেক (২২), সোহরাফ উদ্দিনের ছেলে লাল মিয়া (৫০), আ. রওফের ছেলে সুমন মিয়া (৪০), চান মিয়ার ছেলে হুমায়ুন (২২), বেলতৈল গ্রামের সুনু মিয়ার ছেলে সাগর (২০), মৃত আব্দুল বারেকের ছেলে রায়হানসহ (১৯) অজ্ঞাত আরও ছয়জন তার পথরোধ করে।
নাঈমের নেতৃত্বে দুর্বৃত্তরা রামেলের ওপর হামলে পড়ে। ধারালো ছুরি দিয়ে আঘাত করে তার পেটে ও হাতে। রড দিয়ে পেটানো হয় মাথায় ও পিঠে। ঘটনাস্থলেই রক্তে ভেসে যায় তরুণের দেহ। স্থানীয়রা ছুটে আসে, চিৎকার শুরু হয়। রিফাত ফোন করে খবর দেয় রামেলের পরিবারকে। সবাই মিলে তাকে গফরগাঁও হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। পরে রাত ৩টার দিকে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
হত্যাকারীদের উদ্দেশ্য ছিল একটাই— প্রতিশোধ। প্রায় ১৫ দিন আগে এই একই ছেলেরা গ্রামের রিফাত নামের এক তরুণের বাড়ির পাশে বসে গাঁজা খাচ্ছিল। রিফাতের সঙ্গে ছিল রামেলও। তারা মাদক সেবনে বাধা দিলে তখন থেকেই হুমকি পেতে থাকে দুজন। রামেল জানত, ঝুঁকি আছে। তবুও সে ভয় পায়নি। কারণ, সে চেয়েছিল তার গ্রাম মাদকমুক্ত হোক। কিন্তু সে সাহসই তার মৃত্যুর কারণ হলো।
স্থানীয় বাসিন্দা মো. বুলবুল বলেন, আমরা এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার চাই। এখন পর্যন্ত কেন আসামিদের ধরা হলো না। স্থানীয় পর্যায়ে কিছু কিছু নেতাকর্মী আসামিদের পক্ষ নিয়েছে। তাদেরকে সতর্ক করে বলছি কাজটা ভালো করছেন না। মাদকব্যবসায়ীদের পক্ষে যাবেন না। রামেল ছিল সবার প্রিয়। ওর মতো ছেলে খুব কম দেখা যায়।
তিনি আরও বলেন, মাদকবিরোধী হয়ে নিজের জীবন দিয়ে দিল। রামেল আর ফিরবে না। অদৃশ্য ক্ষমতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা সেই খুনিরা যতদিন মুক্ত থাকবে, ততদিন কান্না থামবে না এ ঘরে, এ গ্রামে, এ সমাজে।
রামেলের বাবা রফিকুল ইসলাম বলেন, আমি গরিব মানুষ। ছেলেটাই ছিল ভরসা। সংসার চালাত, আমার ও মায়ের দেখাশোনা করত। এখন ঘরটাই ফাঁকা। আসামিরা সবাই স্থানীয়ভাবে চিহ্নিত মাদকসেবী ও বখাটে। মামলা হওয়ার পরও কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। আমার ছেলেটা অন্যায়ের প্রতিবাদ করত বলেই ওকে মেরে ফেলেছে। আমি কোনো রাজনীতি চাই না, শুধু আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই। যেন কোনো বাবাকে এমনভাবে ছেলেকে হারাতে না হয়।
স্থানীয় জিনারী ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ড ইউপি সদস্য মো. মনসুর আহম্মেদ বলেন, রামেল ছিল শান্ত ও পরিশ্রমী একটা ছেলে। এলাকায় মাদকবিরোধী প্রচারে সবসময় এগিয়ে থাকত। তাকে হত্যা করা মানে একজন ভালো তরুণকে হারানো। আমরা চাই, যারা এটা করেছে তারা যেন দ্রুত ধরা পড়ে। না হলে মানুষ আইনের ওপর বিশ্বাস হারাবে।
অভিযুক্তরা ঘটনার পর থেকে গা ঢাকা দিয়েছে। যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তাদের পাওয়া যায়নি।
হোসেনপুর থানার ওসি মারুফ হোসেন বলেন, গত ৩ অক্টোবর রামেলের বাবা একটি হত্যা মামলা করেছে। মামলা দায়েরের পর থেকে অভিযুক্তদের ধরতে কাজ করছে পুলিশ।
মন্তব্য করুন