কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার অন্তর্গত গোমতী নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা ৪০০ বছরের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী মালাপাড়া বাজার এখন শুধুই স্মৃতি। ঐতিহ্য হারিয়ে বাজারটি যেন হয়ে উঠেছে বিরানভূমি। এক সময় ওই অঞ্চলের অন্যতম বাণিজ্যিক প্রাণকেন্দ্র ছিল ওই বাজার। দোকানপাট জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে আছে, যা দেখে কে বলবে কোনো এক সময় এ বাজারকে কেন্দ্র করে ওই অঞ্চলের ব্যবসা বাণিজ্য পরিচালিত হতো। এক সময়কার কুমিল্লার প্রধান নদী গোমতী ছিল খরস্রোতা ও যৌবনা। কালের পরিক্রমায় নদী হারিয়েছে স্রোত এখন যেন মরা নদী। এ নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা মালাপাড়ার ঐতিহ্যবাহী বাজার এখন ঐতিহ্য হারিয়ে প্রায় বিলীন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, মালাপাড়া বাজার সরকারের ইজারাভুক্ত একটি বাজার। প্রতি বছর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে অন্যান্য ইজারাভুক্ত বাজারের সঙ্গে এই বাজারটিরও ইজারর জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। উপজেলার অন্যান্য বাজার নিতে ইজারাধারদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিযোগিতা থাকলেও ঐতিহ্যবাহী এই বাজারটি ইজারা নিতে কেউ আবেদন করে না।
সূত্রে আরও জানা গেছে, অন্য সকল বাজার স্থানীয় লোকজন ইজারা নিলেও মালাপাড়া বাজারটি গত কয়েক বছর ধরে কেউ ইজারা নেয় না।
জানা গেছে, নামডাকওয়ালা ঐতিহ্যবাহী মালাপাড়া বাজারটিতে সকল সুবিধা থাকলেও এখন মাত্র তিনটি চায়ের দোকানী আঁকড়ে ধরে আছে বাজারটি। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ অফিস, কৃষি পণ্য সংরক্ষণের গোডাউন, বরফ কল, চাল-আটার মিলসহ অনেক সুযোগ সুবিধা ছিল এই বাজারে। সপ্তাহে দুই দিন (শনিবার ও মঙ্গলবার) সাপ্তাহিক হাটবারে মাছ, সবজি, সোনালি আঁশ (পাট), গরু-ছাগল ও স্থানীয় কৃষকদের ফলানো ধান-গমসহ মৌসুমি নানা ফসলের আলাদা আলাদা বাজার বসতো বাজারে। সরকারের খাতায় ও নামডাকে থাকলেও বিশাল এই বাজারটি ঐতিহ্য হরিয়ে এখন ছোট্ট একটি জায়গায় তিনটি চায়ের দোকানের মধ্যে তার স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে আছে।
মালাপাড়া গ্রামের প্রায় শতবর্ষী বৃদ্ধা আব্দুল মজিদ তিতু মেম্বার স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে বলেন, এক সময় এ অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্যের একমাত্র বাজার ছিল মালাপাড়া বাজার। নদীতে ছোট বড় অনেক নৌকা চলতো। বহু দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ এ বাজারে আসতো পণ্য কেনাবেচার জন্য। এখানে ছিল এক সময়ের অর্থকরী ফসল পাটের বৃহত্তম বাজার। সেই সঙ্গে চাল, আলু ও মাছের বিশাল বাজার বসতো। আরও বসতো গরুর হাট। এমন কিছুই ছিল না যা মালাপাড়া হাটে পাওয়া যেত না। তিনি জানান, এই বাজারে তার নিজেরও একটা দোকান ছিল, আয়-রোজগার হতো অনেক। কিন্তু কালের বিবর্তনে সে হাট এখন পোড়াবাড়িতে পরিণত হয়েছে।
ব্যবসায়ী আমির হোসেন বলেন, আমার বাব-দাদার কাছ থেকে শুনেছি এই মালাপাড়া বাজার নাকি ৩০০ বছরেরও বেশি পুরোনো বাজার। গোমতী নদীর পাড়ে অবস্থিত এক সময়ের নামডাকওয়ালা বাজার এখন মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। সপ্তাহে দুদিন হাটবারে কোনো হাট বসে না। এই বাজারে কেউ এখন আর দোকান নিয়ে ব্যবসা করতে আসে না। আমার বাব দাদারা এই বাজারে ব্যবসা করেছেন। বাবার স্মৃতিকে ধরে রেখে আমিও এই বাজারে ব্যবসা করছি। বর্তমানে এই বাজারে আমার দোকানসহ তিনটি চায়ের দোকান আছে। যা শুধু সকাল-বিকেল খোলা হয়।
ষাট বছরের বৃদ্ধা আব্দুল আজিজ ছিলেন পাইকারদের মাল বাহক। তিনি জানান, এক সময় দূর-দূরান্ত থেকে এ বাজারে অনেক পাইকার আসতো পাট, আলু, চাল, ডাল ও মাছ, গরু ছাগল বেচাকেনা করতে আসতো। তিনি নিজে এ সকল মাল বহন করে সংসার চালিয়েছেন। কিন্তু বর্তমানে বাজারটি বিলুপ্ত হওয়ায় তার মতো অনেকেই কাজ হারিয়েছেন।
এলাকাবাসীদের দাবি, তিন-চারশো বছরের ঐতিহ্যবাহী ব্যবসা কেন্দ্রটি যেন আবারো চালু করা হয়। অন্তত সপ্তাহে দুদিন এখানে হাট বসলে ধীরে ধীরে বাজারটি আবারো পুরনো রূপে ফিরে যেতে পারে।
স্কুল শিক্ষক কাজী আব্দুল আলীম বলেন, গত ১৭-১৮ বছর ধরে এই বাজারটির বাজারটির করুণ অবস্থা দেখা দিয়েছে। ওই সময় হাট বারে বাজারে আসা বহিরাগত ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে খাজনা বেশি নেওয়া ও স্কুল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক স্কুলের মাঠে গরু ছাগলের হাট বসতে না দেওয়ার ফলে বাজারটির উপরে একটি প্রভাব পড়েছে। এছাড়া বাজারটি নদীর পাড়ে হওয়ায় পানি পথেই এই বাজারে দূর-দূরান্ত থেকে সাপ্তাহিক হাট বারে ব্যবসায়ী ও ক্রেতারা আসতেন। এখন আগের মতো গোমতী নদীতে ভরা মৌসুমেও পানি হয় না। আমি মনে করি এই বাজারের যৌবন হারানোর পেছনে এটিও একটি কারণ।
মালাপাড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শেখ আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, এখন যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো। পাশ্ববর্তী কংশনগর বাজারের এদিক দিয়ে গোমতী নদীর উপরে সেতু হয়েছে। ফলে এলাকার মানুষজন এখন সামান্য কিছু কিনার প্রয়োজন হলেও কংশনগর বাজারসহ ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট ও কুমিল্লা শহরে চলে যায়। এ ছাড়া ইউনিয়নের রামনগরে, আসাদনগর কলেজ গেইটে, অলুয়া মোড়ে ও চৌমহনীতে সকাল-বিকেল বাজার বসে। যার ফলে এসব গ্রামের লোকজন ওই বাজারের আর যায় না।
তিনি আরও বলেন, আমি চেষ্টা করছি এই বাজারটিতে নির্ধাতি দিনের সাপ্তাহিক হাট বসানোর জন্য। আমার সাথে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যাক্তিরা যদি এগিয়ে এসে উদ্যোগ নেন এবং আগের মতো ক্রেতা-বিক্রেতারা এই বাজারে আসেন, তাহলে হয়তো এই বাজারের কিছুটা ঐতিহ্য ফেরানো যাবে। আমি মনে করি কয়েক গ্রামের সাধারণ মানুষের সুবিধার লক্ষ্যে ও কয়েকশ’ বছরের পুরোনো এই মালাপাড়া বাজারের ঐতিহ্য ফেরাতে স্থানীয় লোকজন এগিয়ে আসবেন।
মন্তব্য করুন