পর্যটন ক্ষেত্রে অপার সম্ভাবনাময় মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলায় ২০টিরও বেশি পর্যটনকেন্দ্র রয়েছে। জীববৈচিত্র্যে ভরপুর কমলগঞ্জ বাংলাদেশের বৃহৎ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী মণিপুরী সম্প্রদায়ের নিরাপদ আবাসস্থল। এ ছাড়া প্রকৃতির পূজারী খাসিয়া নৃ-গোষ্ঠীসহ গারো, সাঁওতাল, মুসলিম মণিপুরী, টিপরা ও গারোদের নিরাপদ আবাসস্থলও রয়েছে এ উপজেলায়। এখানে আসা পর্যটকদের কাছে তাই এসব ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জীবনযাপন ও তাদের নানা উৎসব বরাবরই আকর্ষণ করে। সারা বছরই নানা অনুষ্ঠানে মেতে ওঠেন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা। তবে প্রধান উৎসবগুলো হয় শীতেই।
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নভেম্বর মাসেই খাসি (খাসিয়া) ও মণিপুরিদের পৃথক বড় দুইটা উৎসব রয়েছে। যে উৎসবগুলো দেখতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পর্যটকসহ স্থানীয়রা ভিড় জমান। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের যে দুটি প্রধান উৎসব মূলত সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয় তা হলো খাসিদের (খাসিয়া) খাসি সেং কুটস্নেম উৎসব ও কমলগঞ্জে মণিপুরীদের মহারাস লীলা উৎসব।
খাসি (খাসিয়া) জনগোষ্ঠীর প্রধান উৎসব খাসি সেং কুটস্নেম। এ উৎসবের মধ্য দিয়ে খাসিয়ারা তাদের পুরাতন বছরকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানায়। আগামী ২৩ নভেম্বর খাসি (খাসিয়া) জনগোষ্ঠীর এ ‘খাসি সেং কুটস্নেম’ উৎসব আয়োজন করা হয়েছে। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জির মাঠে দিনব্যাপী এ উৎসব অনুষ্ঠিত হবে। উৎসব উপলক্ষে খাসি সোশ্যাল কাউন্সিল বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে ঐতিহ্যগত খেলা, ঐতিহ্যগত পোশাক পরিধান, সাংস্কৃতিক পরিবেশনা, ঐতিহ্যবাহী খাবারসহ আরও অনেক আয়োজন রয়েছে। মেলায় বাহারি পণ্যের পসরা নিয়ে বসবেন খাসিয়া জনগোষ্ঠীর মানুষ। বিভিন্ন স্টলে খাসিয়াদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক, পান, তীর, ধনুকসহ বাঁশ-বেতের জিনিসপত্র থাকবে। সিলেট বিভাগের প্রায় প্রত্যেকটি পুঞ্জি থেকেই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর লোকজন এ উৎসবে যোগ দেবেন।
অন্যদিকে নিজস্ব ভাষা, বর্ণমালা, সাহিত্য ও সমৃদ্ধ সংস্কৃতির দিকে এগিয়ে থাকা মণিপুরিদের প্রধান উৎসব মহারাস লীলা উৎসব। আগামী ২৭ নভেম্বর কমলগঞ্জের মাধবপুরের শিব বাজারে (জোড়া মণ্ডপে) ও আদমপুরের তেতইগাঁওয়ে আয়োজন করা হয়েছে এ উৎসবের। রাস উৎসবের দুটি পর্ব থাকে। দিনের বেলায় রাখাল নৃত্য আর রাতে মহারাস। এবার বসছে মহারাস লীলা উৎসব ১৮১তম আসর।
রাখাল নৃত্যে শ্রীকৃষ্ণের শিশুকালের নানা লীলা তুলে ধরা হয়। রাতের বেলা শুরু হয় মহারাস লীলা। ভোর পর্যন্ত রাধাকৃষ্ণের নানা কাহিনি ফুটিয়ে তোলেন মণিপুরিরা।
মাধবপুর মণিপুরি মহারাসলীলা সেবা সংঘের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্মল এস পলাশ বলেন, আগামী ২৭ নভেম্বর প্রতি বছরের ন্যায় ঐতিহ্য ও ধর্মীয় ভাবধারায় ১৮১তম শ্রীকৃষ্ণের মহারাসলীলা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এ মহোৎসব উপলক্ষে সবাইকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। মণিপুরী সম্প্রদায়ের শ্রীকৃষ্ণের মহারাসলীলা একটি প্রধান ধর্মীয় উৎসব। রাসলীলা মণিপুরীদের আয়োজন হলেও সবার আগমনে মানুষের মানবিক মূল্যবোধ বৃদ্ধির পাশাপাশি অপরাপর সকল জাতিগোষ্ঠীর মাঝে সম্প্রীতির বাঁধনে বেঁধে চলেছে। রাসলীলা বা রাসনৃত্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ঐতিহ্যময় লীলার এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মণিপুরী সম্প্রদায়ের এ রাসলীলা গভীর ধর্মীয় ভাব আবেগিত ও অন্যদিকে এক নির্মল সংস্কৃতি। তাই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এ উৎসবে লাখো লাখো ভক্ত, সংস্কৃতি অনুরাগী, গবেষক ছুটে আসেন। কাগজের কারুকার্য খচিত তৈরি শিল্পসমৃদ্ধ রাসকুঞ্জ, বৈচিত্র্যময় রাজকীয় পোশাক আবরণে ধ্রুপদী নৃত্য দর্শন ও শ্রুতিমধুর গীত শ্রবণের মানসসহ নানা আয়োজন থাকে এ উৎসবে। রাসলীলা আজ একটি সর্বজনীন উৎসব হিসেবে সর্বজনের কাছে সুপরিচিতি লাভ করেছে। এ উৎসব ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনা বৃদ্ধি করে সম্প্রীতির বন্ধন সুদৃঢ় করে তুলে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
মাধবপুর মণিপুরি মহারাসলীলা সেবা সংঘের সাধারণ সম্পাদক শ্যাম সিংহ বলেন, ‘এবারের রাসোৎসব আমরা বড় পরিসরে আয়োজনের প্রস্তুতি নিয়েছি।’
মন্তব্য করুন