নোয়াখালী মুক্ত দিবস আজ ৭ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের এই দিনে নোয়াখালী হানাদারমুক্ত হয়েছিল। দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনের লক্ষ্যে নোয়াখালী জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন সংগঠন নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। মুক্তিযোদ্ধা ও গণমানুষের প্রতিরোধের মুখে একাত্তরের এই দিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নোয়াখালী থেকে বিতাড়িত হয়। জেলা শহর মাইজদীতে অবস্থিত রাজাকারদের প্রধান ঘাঁটি প্রাইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে (পিটিআই) দখলের মধ্য দিয়ে নোয়াখালীকে মুক্ত করে লাল সবুজের বিজয় নিশান উড়িয়েছিল মুক্তিকামী জনতা।
দিবসটিকে স্মরণীয় করে রাখতে নোয়াখালী টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের (পিটিআই) দক্ষিণ গেটের কাছে ‘মুক্ত স্কয়ার’ নামে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে।
এর আগে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর মুক্তিযোদ্ধারা প্রায় এক মাস নোয়াখালীকে মুক্ত রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। এখানে ২২ এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশের পতাকা উড়েছিল এবং এখানকার প্রশাসন নোয়াখালীর কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের বাধা অতিক্রম করে পাকিস্তানী সেনারা ২৩ এপ্রিল প্রথম নোয়াখালী জেলা শহরে ঢুকে পড়ে। এরপর তারা নোয়াখালী পিটিআই ও নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের চৌমুহনী চৌরাস্তার কাছে অবস্থিত বেগমগঞ্জ সরকারি কারিগরি উচ্চ বিদ্যালয়ে ঘাঁটি স্থাপন করে।
সদ্য প্রয়াত তৎকালীন নোয়াখালী জেলা মুজিব বাহিনীর প্রধান মাহমুদুর রহমান বেলায়েতের সহধর্মিণী ও স্থানীয় সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা ফরিদা খানম সাকি বলেন, ২৫ মার্চের পর মুক্তিযোদ্ধারা প্রায় ১ মাস নোয়াখালী মুক্ত রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ঢাকা থেকে নোয়াখালীতে এসে প্রথম দিকে আমি নানার বাড়িতেই ছিলাম। হানাদার বাহিনী নোয়াখালী আসার পরপরই আমার নানা বাড়িতে হামলা করে। পরবর্তী সময়ে আমার মামা সাহাবুদ্দিন ইস্কান্দার ভুলুকে হত্যা করা হয়। আমরা তখন আমার মামানির বাপের বাড়িতে চলে যাই। এরপর নেতাদের চিঠি পেয়ে আমি আগরতলায় প্রশিক্ষণ নিতে চলে যাই। সেখানে থেকে নোয়াখালীর বিভিন্ন গ্রুপের সাথে আমার বোনসহ দেশে এসে লড়াই করে আবার আগরতলায় চলে যেতে হয়েছে। মেয়ে হওয়ার কারণে ভালো প্রশিক্ষণ নেওয়ার পরেও সম্মুখ যুদ্ধে খুব বেশি অংশগ্রহণের সুযোগ পাইনি। এই আফসোসটা আজীবন থেকে যাবে।
মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, নোয়াখালীকে হানাদারমুক্ত করার লক্ষ্যে ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর গভীর রাতে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি ইউনিট মাইজদী শহরের বিভিন্ন স্থানে রাজাকারদের ক্যাম্পে সাঁড়াশি অভিযান চালায়। অল্প সময়ে সবগুলো মুক্তি সেনাদের দখলে চলে আসে। কিন্তু, পিটিআই ক্যাম্পের রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যায়।
গভীর রাতে মাইজদী পিটিআই ও বেগমগঞ্জ টেকনিক্যাল হাইস্কুল ক্যাম্প ছেড়ে কুমিল্লা সেনানিবাসের উদ্দেশে পালিয়ে যেতে থাকে পাকিস্তানি সেনারা। এ সময় সুবেদার লুৎফুর রহমান ও শামসুল হকের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীরা বেগমগঞ্জ-লাকসাম সড়কের বগাদিয়া ব্রিজ অতিক্রম করে পাকিস্তানি আর্মিদের ওপর হামলা করে।
এর আগে মুক্তিযোদ্ধারা পাক হানাদার ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে প্রশিক্ষণ নিয়ে অস্ত্র হাতে মাঠে নামে। কোম্পানীগঞ্জের বামনী, তালমাহমুদের হাট, ১২ নম্বর স্লুইস গেট, সদরের উদয় সাধুর হাট (ওদারহাট), করমবক্স, বেগমগঞ্জের ফেনাকাটা পোল, রাজগঞ্জ ও বগাদিয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় সম্মুখ যুদ্ধে শহিদ হন অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা।
নোয়াখালী জেলা স্কুলের রাস্তার পাশ থেকে রাজাকাররা ৭ ডিসেম্বর সকাল ১০টার দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর হামলা চালায়। সেসময় একজন মুক্তিযোদ্ধা গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। এ ঘটনার পর মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে বেশ কয়েকজন রাজাকারকে আটক করে। তারা রাজাকারদের প্রধান ঘাঁটি পিটিআই ক্যাম্পের দিকে অগ্রসর হন। শত শত মুক্তিযোদ্ধা রাজাকারদের ক্যাম্প পিটিআই ক্যাম্পাসের চারপাশ ঘিরে ফেলেন। শুরু হয় দফায় দফায় সংঘর্ষ ও গুলিবর্ষণ।
সেদিন রাজাকারদের গুলিতে বেশ কয়েকজন বেসামরিক লোক নিহত হন। এরপর আক্রমণের তীব্রতা বাড়িয়ে দেয় বীরযোদ্ধারা। এতে বেশ কয়েকজন রাজাকার নিহত হয়। তীব্র আক্রমণের মুখে রাজাকারেরা মুক্তিবাহিনীদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। এর মাধ্যমে শত্রুমুক্ত হয় নোয়াখালী। শহরের কোর্ট বিল্ডিংয়ে ওড়ানো হয় লাল সবুজের পতাকা। বিজয়ের আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠে এই অঞ্চলের হাজারো মুক্তিকামী মানুষ।
মুক্তিযোদ্ধা ও বিএলএফসহ সম্মিলিত বাহিনীর বীর যোদ্ধাদরে চরম আত্রুমণে পাক হানাদার ও তাদের দোসর বাহিনীর পরাজয় ও পশ্চাদগমনের মধ্য দিয়ে ৭ ডিসেম্বরে ১৯৭১ নোয়াখালী পাক হানাদারমুক্ত হলে গ্রামগঞ্জ থেকে অজস্র বিজয় মিছিল এসে নোয়াখালী টাউনকে মিছিলে মিছিলে মুখরতি করে তোলে। অবশেষে ৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসে রচিত হলো নোয়াখালী মুক্তির অবিস্মরণীয় ইতিহাস। একাত্তররে মুক্তিযুদ্ধ হাজার বছরের বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক অসাধারণ ও অবস্মিরণীয় ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধে নোয়াখালীবাসীর অনন্য ভূমিকা ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদান ইতিহাসের পাতায় চিরদিন অম্লান হয়ে থাকবে।
মন্তব্য করুন