ইতিহাস, ঐতিহ্য আর প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের এক লীলাভূমি সোনারগাঁ। ইতিহাস ছাড়াও লোকশিল্প ও কারুশিল্পসহ সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঈশা খাঁর স্বপ্নের এই নগরী। ঐতিহ্যে ভরপুর এই নগরীর প্রাচীন নাম ছিল সুবর্ণবীথি বা সুবর্ণগ্রাম। বর্তমানে এই নগরী বিশ্বের ভ্রমণপিপাসুদের প্রধান আকর্ষণ।
ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের বিভিন্ন লেখা থেকে জানা যায়, সুবর্ণগ্রাম থেকেই মুসলিম আমলে সোনারগাঁ নামের উদ্ভব ঘটে। আবার কেউ কেউ বলেন, বার ভূঁইয়া প্রধান ঈসা খাঁর স্ত্রী সোনাবিবির নামানুসারে এর নাম হয়েছে সোনারগাঁ।
ধারণা করা হয় ঐতিহ্যের ধারক-বাহক সোনারগাঁয়ের উদ্ভব প্রাক-মুসলিম যুগ থেকেই। পূর্ববঙ্গের রাজধানীখ্যাত সোনারগাঁয়ে সুলতানি আমল ও মোঘল আমলের অসংখ্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রয়েছে। এ অঞ্চলের চারু ও কারুশিল্প এবং বস্ত্রশিল্প সারা ভারতীয় উপমহাদেশে বিখ্যাত ছিল।
সোনারগাঁ অঞ্চলের মসলিন কাপড় মিশরীয় ও রোমান সাম্রাজ্যের অভিজাতদের মধ্যে ছিল খুব জনপ্রিয়। ১৩৩৮ খ্রিষ্টাব্দে ফখরুদ্দিন মোবারক শাহের আমলে সোনারগাঁ স্বাধীন বাংলার রাজধানীতে পরিণত হয়। পরে গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ্, শেরশাহ, ঈশা খাঁ পর্যায়ক্রমে সোনারগাঁয়ে রাজত্ব করেন। ইতিহাসের আবহমান ধারায় অনেক চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে সোনারগাঁ আজ এমন একটি নামে পরিণত হয়েছে। যার মাধ্যমে বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও লোকজ সংস্কৃতি একযোগে প্রকাশিত হয়।
সোনারগাঁ ছিল বাংলার মুসলিম শাসকদের অধীনে পূর্ববঙ্গের একটি প্রশাসনিক কেন্দ্র। এর আয়তন ১১৭.৬৬ বর্গ কিলোমিটার। এটি বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ জেলার একটি উপজেলা। এর অবস্থান ঢাকা থেকে ২৭ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে। এটি আগে মেঘনা, পশ্চিমে শীতলক্ষ্যা, দক্ষিণে ধলেশ্বরী ও উত্তরে ব্রহ্মপুত্র নদ দ্বারা বেষ্টিত একটি বিস্তৃত জনপদ ছিল।
সোনারগাঁ ছিল ব্যবসায়, শিক্ষা-দীক্ষায়, কৃষি, সাহিত্য-সংস্কৃতি, শিল্প ও কারুকার্যে বিশ্বসেরা।
জানা গেছে, ১৫ শতকে সোনারগাঁয়ের পূর্বে মেঘনা আর পশ্চিমে শীতলক্ষ্যা নদীপথে বিলেত থেকে আসত থান কাপড় আর দেশ থেকে যেত মসলিন। প্রায় ওই সময়ই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক কার্যক্রম ও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে ইউরোপীয় অনুপ্রেরণায় নতুন ঔপনিবেশিক স্থাপত্যরীতিতে গড়ে ওঠে পানাম নগরী। পরে ইংরেজরা দখল করে এখানে বসিয়েছিলেন নীলের বাণিজ্যকেন্দ্র। আর এই পানাম নগরী বর্তমানে বহির্বিশ্বে সোনারগাঁকে একটি পর্যটন নগরী হিসেবে তুলে ধরেছে।
ঔপনিবেশিক স্থাপত্যের নিদর্শন হিসেবে পানাম নগরীতে টিকে থাকা বাড়িগুলোর মধ্যে ৫২টি বাড়িই উল্লেখযোগ্য। পানাম সড়কের উত্তর পাশে ৩১টি ও দক্ষিণ পাশে ২১টি বাড়ি রয়েছে। প্রতিটি বাড়ির মেঝেতে রয়েছে লাল, সাদা, কালো মোজাইকের কারুকাজ। এর সঙ্গে আছে সিরামিক টাইলসের রূপায়ণ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১০-১৫ বছর ইজারা দেওয়া হলেও পরবর্তীতে স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে ২০০৯ সালে পানাম নগরীকে সম্পূর্ণভাবে দখলমুক্ত করা হয়। সরকারিভাবে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে নেওয়া হয় পানাম নগরীর (সোনারগাঁ) প্রাচীন স্থাপত্য। যা দেখতে দেশ-বিদেশ থেকে প্রতিদিন ছুটে যায় ভ্রমণপিপাসুরা।
এ ছাড়া আবহমান গ্রাম বাংলার লোক সাংস্কৃতিকে বিকশিত করার উদ্যোগে ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের উদ্যোগে সরকার সোনারগাঁয়ের ঐতিহাসিক পানাম নগরীর একটি পুরোনো বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন। পরবর্তীতে ১৯৮১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন বড় সরদার বাড়িতে স্থানান্তরিত হয়।
প্রায় ৬শ বছরের পুরোনো সোনারগাঁয়ের ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারক ঐতিহাসিক বড় সরদার বাড়ি। ২৭ হাজার ৪০০ বর্গফুট আয়তনের এ ভবনটির নিচতলায় ৪৭টি ও দ্বিতীয় তলায় ৩৮টি কক্ষ রয়েছে। প্রায় ১৬ হেক্টর জায়গাজুড়ে লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন বিস্তৃত। এই ফাউন্ডেশনে আছে গোপীনাথ সাহা সরদার বাড়ি, জয়নুল আবেদিনের ঐতিহাসিক সংগ্রাম ভাস্কর্য, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের আবক্ষ ভাস্কর্য, জয়নুল আবেদিনের ভাস্কর্য, জয়নুল আবেদিন স্মৃতি জাদুঘর, লোকজ মঞ্চ, সেমিনার রুম, কারুশিল্প গ্রাম এবং সবুজে মোড়া সুবিশাল উদ্যান। সংরক্ষিত রয়েছে ৪ হাজার ৫০০-এর অধিক প্রাচীন নিদর্শন। গ্রাম বাংলার প্রাচীন শিল্পীদের সুনিপুণ হাতের তৈরি বিভিন্ন শৈল্পিক ও দৈনন্দিন ব্যবহার্য নানা পণ্যসামগ্রী।
এ ছাড়া জাদুঘরের বিভিন্ন গ্যালারিগুলোতে দেখা মিলবে কাঠে খোদাই করা বিভিন্ন কারুশিল্প, পটচিত্র, মুখোশ, আদিম জীবনভিত্তিক নিদর্শন, লোকজ বাদ্যযন্ত্র, পোড়ামাটির ফলক, লোহা তামা-কাসা পিতলের তৈজসপত্র, লোকজ অলংকারসহ বৈচিত্র্যপূর্ণ অনেক প্রাচীন নিদর্শন। এরই ধারাবাহিকতায় প্রাচীন বাংলার এ রাজধানীকে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ওয়ার্ল্ড কমিউনিকেটরস কাউন্সিল (ডাব্লিউসিসি) বিশ্ব কারুশিল্প শহরের মর্যাদা প্রদান করেন।
ঐতিহাসিক এই পর্যটন নগরী সোনারগাঁ দেখতে যেভাবে যেতে পারেন—ঢাকার গুলিস্তানে অবস্থিত মওলানা ভাষানী স্টেডিয়াম থেকে বোরাক এসি, দোয়েল কিংবা স্বদেশ এই তিনটি বাসযোগে সরাসরি মোগরাপাড়া চৌরাস্তা নেমে সিএনজি, রিকশা কিংবা মিশুক দিয়ে বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনে আসতে পারবেন। এখান থেকে অল্পকিছু দূরেই পানাম নগরী, পোদ্দার বাড়ি, টাঁকশাল বাড়ি এবং প্রাচীন বিদ্যাপিঠ সোনারগাঁ জি আর ইনস্টিটিউশন অবস্থিত। এরপর রিকশাযোগে গোয়ালদী শাহি মসজিদ।
অন্যদিকে মোগরাপাড়া চৌরাস্তা নেমে ফুটওভার ব্রিজ পার হয়ে পায়ে হেঁটে কিংবা রিকশাযোগে মোগরাপাড়া বাজারে গেলেই পাবেন হজরত শাহ্, মুন্না শাহ্ ও শরফউদ্দিন আবু তাওয়ামার মাজার এবং ৭০০ পুরোনো উপমহাদেশের প্রথম ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসাবশেষ। এরপর ভাগলপুরে অবস্থিত সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ্ ও পাঁচপীরের মাজার অবস্থিত।
মন্তব্য করুন