মেধাবী ছাত্র সাব্বির হোসেন মুন্না (২৪)। গত ১৫ বছর ধরে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের কাঁচপুরে পরিবারের সঙ্গে বসবাস করছেন। দুই ভাই-বোনের মধ্যে মুন্না ছিল বড়। বাবা ও মায়ের স্বল্প বেতনের চাকরি করে সংসার চালানো কষ্টকর হওয়ায় পড়াশোনায় ইতি টেনে পরিবারের হাল ধরতে স্থানীয় একটি কারখানায় চাকরি নেন তিনি।
গত বছরের ৫ আগস্ট ঢাকার লং মার্চে গিয়ে আর ফিরে আসেননি মুন্না। এখন একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে শোকে হতবিহ্বল বাবা-মা। বেঁচে আছেন নাকি শহীদ হয়েছেন এ নিয়ে অনিশ্চয়তায় তার পরিবার।
জানা গেছে, স্বৈরাচারখ্যাত আওয়ামী লীগ সরকার পতনের একদফা দাবিতে গত বছরের ৫ আগস্ট ঢাকার লংমার্চে গিয়েছিলেন সাব্বির হোসেন মুন্না। তখন থেকে আর ফিরে আসেননি তিনি। আন্দোলনে যাওয়া মুন্না এখনো বেঁচে আছেন নাকি শহীদ হয়েছেন, এ নিয়ে অনিশ্চয়তায় তার পরিবার। এখনো মুন্নাকে বিভিন্ন স্থানে খুঁজে বেড়াচ্ছেন তারা। গণঅভ্যুত্থানের এক বছরেও খোঁজ না পাওয়ায় চোখের পানিতে প্রতিনিয়ত বুক ভাসাচ্ছেন মুন্নার বাবা-মা ও একমাত্র ছোট বোন সুমাইয়া আক্তার। এ বছর সুমাইয়ার দাখিল পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার কথা থাকলেও মুন্না নিখোঁজ হওয়ার পর বন্ধ হয়ে গেছে তার পড়াশোনা। ভেঙে পড়েছে পুরো পরিবারটি।
ছেলে নিখোঁজ হওয়ার পর থেকেই মা মুক্তা বেগম ও বাবা শফিকুল ইসলাম রাজধানীর প্রায় সব হাসপাতাল, মর্গ ও থানায় খোঁজ করলেও নিখোঁজ মুন্নার সন্ধান মেলেনি আজও। এ ঘটনার পরেই মুন্নার মা গত বছরের ১৮ আগস্ট সোনারগাঁ থানায় জিডি করেন। এরপর জিডির কপি নিয়ে আড়াইহাজার সেনাবাহিনীর ক্যাম্পেও লিখিতভাবে বিষয়টি জানান। বহু ছাত্রদের তার নিখোঁজের সন্ধান দেওয়ার জন্য ছবি ও বিভিন্ন প্রয়োজনীয় নথি দিলেও আজ অবধি কেউ মুন্নার হদিস দিতে পারেনি। এ অবস্থায় মুন্না বেঁচে আছে নাকি আন্দোলনে গিয়ে শহীদ হয়েছে এ নিয়েও চরম হতাশা, দিশেহারা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন তারা।
কথা হয় নিখোঁজ মুন্নার মা মুক্তা বেগমমের সঙ্গে। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে কালবেলাকে বলেন, গত বছর ৫ আগস্ট আমার একমাত্র ছেলে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান শুরু হলে এলাকাবাসী ও বন্ধুদের সঙ্গে আন্দোলনে অংশ নেয়। ওইদিন আমাদের কথা না শুনে সকালে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে ছোট মেয়েকে জানিয়ে ঢাকার লংমার্চ কর্মসূচিতে কাঁচপুর থেকে মিছিলের সঙ্গে গণভবনের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। এরপর আর বাড়িতে ফিরে আসেনি।
তিনি আরও বলেন, প্রতিবেশীদের নিয়ে কত জায়গায় গিয়েছি। দিনের পর দিন ছবি নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় দোকানে দোকানে ঘুরেছি। কেউ আমার ছেলের সন্ধান দিতে পারেনি৷ আমার ছেলেকে কেউ ফিরিয়ে দেন।
আন্দোলনে একসঙ্গে যাওয়া মুন্নার বন্ধু কালবেলাকে বলেন, গত বছরের ৪ আগস্ট আমরা আন্দোলনে এক সঙ্গে গিয়েছিলাম। ওইদিন একসঙ্গেই ফিরেছি পরের দিন ৫ আগস্ট এলাকার সবার সঙ্গে আমরাও যাত্রাবাড়ী হানিফ ফ্লাইওভারের টোল প্লাজার সামনে গেলে সংঘর্ষের ঘটনা দেখে ছত্রভঙ্গ হয়ে আমি চলে আসি; কিন্তু মুন্নাকে আর খোঁজে পাইনি।
তিনি আরও বলেন, এর পর থেকেই মুন্নার বাবা-মায়ের সঙ্গে অনেক জায়গায় গিয়েছি। শহরের অনেক হাসপাতালে গিয়েছি৷ প্রশাসনকেও জানিয়েছি। গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্ণ হলেও আজও তার খোঁজ মেলেনি। সরকারের কাছে দাবি, বন্ধু মুন্নাকে জীবিত বা মৃত হলেও যেন আমাদের মাঝে ফিরিয়ে দেন।
মুন্নার বাবা শফিকুল ইসলাম বলেন, ভাই ছেলের ছবি নিয়ে কত জায়গায় খুঁজলাম কোথাও পাইলাম না। ঢাকার প্রায় সব হাসপাতালে গেছি। থানায় গেছি। আড়াইহাজার সেনাবাহিনীর ক্যাম্পেও গেছি। কেউ আমার মুন্নার সন্ধান দিতে পারে নাই। সবাই শুধু বলে আমরাও খুঁজছি। আপনারাও খোঁজেন। কিন্তু খুঁজেতো আর ছেলেকে পেলাম না।
তিনি আরও বলেন, যদি জানতাম শহীদ হয়েছে তবুও নিজেকে বোঝাতাম। দেশের জন্য ছেলে জীবন দিয়েছে। একমাত্র ছেলে ছিল আমার। এখন আর কীসের আশায় বাঁচব। যদি সম্ভব হয় আমার ছেলেকে ফিরাইয়া দিন।
মুন্নার ছোট বোন সুমাইয়া কালবেলাকে বলেন, একটা মাত্র ভাই ছিল আমার। ভাইয়ের আদরের একমাত্র ছোট বোন ছিলাম আমি। ভাইকে ছাড়া তার জীবন শেষ হয়ে গেছে। আমার ভাইকে ফিরে পেতে চাই। যদি মরে গিয়ে থাকে তাহলে যেন লাশের সন্ধানটা অন্তত পাই।
এদিকে, জেলা প্রশাসনের তৈরি গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের তালিকায় পাওয়া যায়নি মুন্নার নাম। নেই আহতদের তালিকায়ও। তবে কি মুন্না এখনো পড়ে আছে হাসপাতালের কোনো হিমাগারে? নাকি ঠাঁই হয়েছে অজ্ঞাত শহীদদের কোনো গণকবরে? এমন প্রশ্ন তুলেছেন স্থানীয় এলাকাবাসী৷
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নারায়ণগঞ্জ জেলার সাবেক সভাপতি নিরব রায়হান বলেন, এ বিষয়টি সম্পর্কে আমি জেনেছি। তবে কেন্দ্রে বিষয়টি জানানোর পর তাদের কাছে এমন তথ্য নেই বলে জানান। ব্যস্ততার কারণে একাধিকবার যাওয়ার পরিকল্পনা করলেও যাওয়া হয়নি।
নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক জাহিদুল ইসলাম মিঞা কালবেলাকে বলেন, জেলায় যারা শহীদ হয়েছেন তাদের তালিকা আমাদের কাছে আছে। যারা আহত হয়েছেন তাদের তালিকাও আমাদের কাছে এসেছে। গত ৫ আগস্ট থেকে সাব্বির হোসেন মুন্না নামে কেউ নিখোঁজ আছে এ বিষয়টি আমাদের জানা ছিল না। যদি কেউ মিসিং হয়ে থাকে আমরা অবশ্যই তার জন্য ব্যবস্থা নেব। আমরা সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলব। সে কীভাবে মিসিং হলো, কোথায় আছে সেটা আমরা অবশ্যই তদন্ত করার ব্যবস্থা নেব।
মন্তব্য করুন