আতাউর রহমান, ব্রাহ্মণপাড়া (কুমিল্লা) প্রতিনিধি
প্রকাশ : ১৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:১৯ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

কুমিল্লায় হারানোর পথে বাঙালির ঐতিহ্য নবান্নের জৌলুস

ব্রাহ্মণপাড়ায় পালিতে গরম পানি জ্বালিয়ে তৈরি হচ্ছে ভাঁপা পিঠা। ছবি : কালবেলা
ব্রাহ্মণপাড়ায় পালিতে গরম পানি জ্বালিয়ে তৈরি হচ্ছে ভাঁপা পিঠা। ছবি : কালবেলা

বাঙালির একটি অন্যতম জনপ্রিয় উৎসব নবান্ন। আবহমান কাল ধরে এ দেশে প্রচলিত এই নবান্ন উৎসব এ দেশের মাটি ও মানুষের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। তাই হেমন্তে এমন ধান কাটার পরপরই এক সময় কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়ার এ জনপদে নবান্ন উপলক্ষে ধর্ম বর্ণ-নির্বিশেষে কৃষকের ঘরে ঘরে আনন্দে সাড়া পড়ে যেত। ঘরে ঘরে চলত নতুন চালের গুঁড়া দিয়ে তৈরি নানা রকম পিঠাপুলি ফিরনি পায়েসের রান্নার ধুম। নবান্ন আর পিঠাপুলির উৎসবে আনন্দে মাতোয়ারা হতো সবাই। দিন বদলের পালায় এই জনপদে অনেকটাই ফিকে হয়ে গেছে নবান্নের আনন্দ। আগে নতুন ধান গোলায় ওঠার সময়ে যেভাবে উৎসবের আমেজ বিরাজ করত তা যেন দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে কালের গর্ভে। পিঠাপুলি পায়েস, আত্মীয়তা আর নেমন্তন্ন এখম আর তেমন চোখেই পড়ে না।

সোনালি ধানের প্রাচুর্য আর বাঙালির নানা উৎসবের মধ্যে অন্যতম উৎসব এই ‘নবান্ন’ ঘিরে অনেক কবি-সাহিত্যিকের বহু লেখায়ও উঠে এসেছে নবান্নের অপরূপ চিত্র। প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ তার কবিতায় লিখেছেন- আবার আসিব ফিরে ধান সিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়/মানুষ নয়- হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে/ হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে/কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল ছায়ায়।

বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার গীতকাব্যে বর্ণনা করেছেন - ‘হায় হেমন্তলক্ষ্মী, তোমার নয়ন কেন ঢাকা/ হিমের ঘন ঘোমটাখানি ধুমল রঙে আঁকা/ সন্ধ্যাপ্রদীপ তোমার হাতে-মলিন হেরি কুয়াশাতে/ কণ্ঠে তোমার বাণী যেন করুণ বাষ্পে মাখা/ ধরার আঁচল ভরে দিলে প্রচুর সোনার ধানে/ দিগঙ্গনার অঙ্গন আজ পূর্ণ তোমার দানে।/ আপন দানের আড়ালেতে-রইলে কেন আসন পেতে/আপনাকে এই কেমন তোমার গোপন করে রাখা।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম নবান্নকে দেখেছেন এভাবে----‘ঋতুর খাঞ্জা ভরিয়া এলো কি ধরনীর সওগাত?/ নবীন ধানের অঘ্রাণে আজি অঘ্রাণ হলো মাৎ। / বিন্নি পলাশ’ চালের ফিরনি/ তশতরি ভরে নবীনা গিন্নি / হাসিতে হাসিতে দিতেছে স্বামীরে, খুশিতে কাঁপিছে হাত। / শিরনি রাঁধেন বড় বিবি, বাড়ি গন্ধে তেলেসমাত।’

কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য্যের ‘এই নবান্নে’ কবিতায় নবান্নকে তুলে ধরেছে এভাবে-- ‘নতুন ফসলের সুবর্ণ যুগ আসে।’ ‘এই হেমন্তে কাটা হবে ধান, আবার শূন্য গোলায় ডাকবে ফসলের বান।’

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন হেমন্তে মাঠ ভরা ফসলের সম্ভারে মুগ্ধ হয়ে লিখেছিলেন --‘আশ্বিন গেল কার্তিক মাসে পাকিল ক্ষেতের ধান/সারা মাঠ ভরি গাহিছে কে যেন হলদি-কোটার গান।/ধানে ধান লাগি বাজিছে বাজনা, গন্ধ উড়িছে বায়,/কলমীলতায় দোলন লেগেছে, হেসে কূল নাহি পায়।’

কবি আল মাহমুদের কবিতায় নবান্ন আসে এভাবে — ‘আজ এই হেমন্তের জলজ বাতাসে/আমার হৃদয় মন মানুষীর গন্ধে ভরে গেছে/রমণীর প্রেম আর লবণ সৌরভে/আমার অহংবোধ ব্যর্থ আত্মতুষ্টির ওপর/বসায় মার্চের দাগ, লাল কালো কট ও কষায়।’

কবি আতাউর রহমান এই সুন্দর সময়টা শব্দ দিয়ে এঁকেছেন এইভাবে----‘হেমন্তের মাঠে মাঠে সোনালি ধানের হাসি/ ফোটে কৃষকের মুখে গিয়ে /মানুষের অভ্যন্তরে জেগে ওঠে সোঁদাপ্রেম/ এই নবান্নের স্পর্শ নিয়ে।’

সরেজমিনে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের থেকে জানা যায়, সময় পরিবর্তনের হাওয়ায় এ জনপদের সংস্কৃতি পাল্টে যাচ্ছে। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী উৎসব নবান্ন। গ্রামীণ জনপদে দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠ থাকলেও কৃষকের ঘরে ঘরে নেই নবান্নের আমেজ। ঘরে ঘরে তেমন একটা নেই নতুন চালের পিঠাপুলি আর ফিরনি পায়েসের উৎসব। গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী নবান্ন উৎসব যেন দিন দিন কালের গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে। সিকি শতাব্দী পূর্বেও হেমন্তে ধান কাটার মধ্যদিয়ে নবান্নের উৎসবে মুখরিত হতো এ জনপদের প্রতিটি আঙিনা। অথচ আধুনিকতার ছোঁয়ায় এই জনপদের জনজীবনে নবান্ন উৎসব এখন অনেকটা স্মৃতি, আর নতুন প্রজন্মের কাছে নবান্ন যেন দূরের শোনা গল্পের মতো । সচেতন মহলের দাবি আবার ফিরে আসুক নবান্ন উৎসব প্রতি ঘরে ঘরে আগের মতো, ফিরে আসুক মানুষের মমতার বন্ধন।

স্থানীয় বাসিন্দা শানু মিয়া (৭৬) জানান, এই জনপদে এক সময় হেমন্ত এলেই নতুন ধান ঘরে ওঠানোর কাজে ব্যস্ত থাকত কৃষাণ-কৃষাণীরা। আর ধান ঘরে উঠলে পিঠে পায়েস খাওয়ার ধুম পড়ে যেত। পাড়ায় পাড়ায় চলতো নবান্ন উৎসব। আধুনিক সময়ে এসে অনেকেই ছেড়ে দিয়েছেন গৃহস্থালি কাজ। যার ফলে নবান্ন উৎসবও দিন দিন বিলীন হতে চলেছে। প্রাচীনকাল থেকেই এই অঞ্চলের মানুষ ধর্ম-বর্ণ অপেক্ষা করে নবান্নকে কেন্দ্র করে উৎসবে মেতে উঠত। একে অন্যে গড়ে তুলত সামাজিক সম্পর্ক। আজ তা আর তেমন চোখেই পড়ে না।

ব্রাহ্মণপাড়া সদর ইউপি চেয়ারম্যান জহিরুল হক কালবেলাকে বলেন, নবান্ন বাঙালির নানা উৎসবের মধ্যে অন্যতম এক উৎসবের নাম। সময়ের ব্যবধানে ঐতিহ্য বহন করা নবান্ন যেন হারিয়ে যাচ্ছে জনজীবন থেকে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় নতুন প্রজন্ম থেকে হারিয়ে যাচ্ছে বাঙালি পরিচয়ের অনেক গুরুত্বপূর্ণ আনুষ্ঠানিকতা। এতে করে দিন দিন বাঙালির নানা ঐতিহ্য হুমকির মুখে পড়ছে। বাঙালির নানা ঐতিহ্য ধরে রাখতে সমাজের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

স্বাস্থ্য পরামর্শ / রান্নায় সরিষার তেলে ঝুঁকি ও অসংক্রামক রোগ

ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে আবারো দুর্ঘটনা, নিহত আরও ৩

ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষে ৫৮% মার্কিনি : রয়েটার্স

স্পেনের বাইরে লা লিগার ম্যাচ খেলার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত জানাল ফুটবলাররা

দুবাইয়ে যাওয়ার ৪ মাস পরই ৩ কোটির লটারি জিতলেন প্রবাসী

এনজো ফার্নান্দেজের মুখে রিয়াল মাদ্রিদের নাম, বাড়ছে গুঞ্জন

কেশবপুরে নারী সমাবেশ/ / ধানের শীষের পক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার প্রতিশ্রুতি

সাভারে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের দাওয়াতি মাসের শুভ উদ্বোধন

তারেক রহমান শিগগিরই দেশে ফিরবেন, নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রীও হবেন : এ্যানি

দলবদলের বাজারে প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবগুলোর রেকর্ড ভাঙা খরচ

১০

ধর্মগড় সীমান্তে বিজিবির হাতে আটক চার বাংলাদেশি

১১

হাসিনাকে ফেরত পাঠানো নিয়ে মোদিকে ওয়েইসির প্রশ্ন

১২

জাকসুতে প্যানেল দ্বন্দ্ব, পদত্যাগ করে বাগছাস নেতার মিষ্টি বিতরণ

১৩

সৈয়দপুর বিমানবন্দরে যাত্রীসেবা আন্তর্জাতিক মানের করতে চাই : বেবিচক চেয়ারম্যান

১৪

‘আ. লীগ বিদ্যুৎ খাতে চুরির লাইসেন্স দিয়েছিল’

১৫

আ.লীগ নেত্রী রুনু গ্রেপ্তার

১৬

ইসির ইউটিউব চ্যানেল চালু, মিলবে যেসব তথ্য

১৭

শিশু ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ, গ্রেপ্তারের দাবি শিক্ষার্থী

১৮

চার বিভাগে ভারী বর্ষণের সতর্কতা জারি, পাহাড়ধসের আশঙ্কা

১৯

ভোলায় পাঁচ দিন ২০ নৌরুটে লঞ্চ চলাচল বন্ধ, ভোগান্তি চরমে

২০
X