নারায়ণগঞ্জে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ইটভাটাগুলোর কালো ধোঁয়ায় নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ।মারত্মক হুমকির মুখে পড়ছে জনস্বাস্থ্য। এসব ইটভাটার বিষাক্ত কালো ধোঁয়ায় একদিকে স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে ভাটার পাশে বসবাস করা বাসিন্দারা। অন্যদিকে ফসলি জমি হারিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে কৃষকরা। ইট তৈরিতে ব্যবহার করা হচ্ছে কৃষি জমির উর্বর মাটি। ফলে প্রতিনিয়ত হ্রাস পাচ্ছে কৃষি জমি। ইটভাটার কালো ধোয়ার কারণে মানুষ শ্বাষকষ্ট, এজমা ও ঠান্ডাজনিত নানা রোগে ভুগছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ প্রকল্প প্রতিবেদন অনুযায়ী, নারায়ণগঞ্জের বায়ু খুবই অস্বাস্থ্যকর হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এ বায়ু দূষণের অন্যতম কারণ হচ্ছে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা ইটভাটা।
তিন ফসলি জমির উর্বর মাটি ও গাছপালা গিলে খাচ্ছে নারায়ণগঞ্জের বন্দরের বিপুল সংখ্যক ইটভাটা। সরকারী নিয়ম-নীতিমালাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে জেলার বন্দর উপজেলার মদনপুর, মুছাপুর ও ধামগড় ইউনিয়নে গড়ে উঠেছে বিপুল সংখ্যক অবৈধ ইটভাটা। স্থানীয় তিন ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদের রয়েছে ছয়টি অবৈধ ইটভাটা। প্রথমে কয়েকটি ইটভাটা থাকলেও প্রশাসন তেমন কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় এবং মাসিক ও বাৎসরিক চাঁদা দিয়ে যত্রতত্র আবাসিক এলাকায় ইটভাটা নির্মাণ করতে পারে বলে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে অবৈধ ইটভাটা। এসব ইটভাটার কাঁচামাল হিসেবে মাটির জোগান দিতে গিয়ে ফসলী জমির উর্বর মাটি কেটে নিয়ে দিনের পর দিন ইট তৈরি করায় বন্দর উপজেলার এ তিনটি ইউনিয়নের ফসলি জমি প্রায় ৯০ শতাংশ ধ্বংশ হয়ে গেছে। এখন যতোটুকু বাকি আছে সেগুলোতে ভেকু লাগিয়ে অনেক সময় কৃষকদের জমি ক্রয় না করেও জোরপূর্বক উর্বর মাটি কেটে নিয়ে ইটভাটায় বিক্রি করছে কয়েকটি চক্র। একই সাথে প্রায় জায়গায় ভেকু দিয়ে ফসলি জমির মাটি কাটার দৃশ্যও দেখা যায় প্রতিনিয়ত।
স্থানীয়রা জানান, এক সময় রাতে লুকিয়ে জমির মাটি কাটলেও এখন আর তার প্রয়োজন পড়ে না। এখন দিনে প্রকাশ্যে মাটি কেটে নেয় প্রভাবশালী ভূমিদস্যুরা। ইটভাটায় ফসলি জমির মাটি বিক্রি চক্রের মূলহোতা বাদল মিয়া, মদনপুর ইউপি সদস্য আক্তার মোল্লা, মুছাপুর ইউপি সোহেল মিয়া, সিরাজ হোসেন, আমান উল্লাহ, ইকবাল হোসেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বার কিংবা কোনো প্রভাবশালী লোকের মদদপুষ্ট। ভূমিদস্যুদের পেছনে প্রভাবশালীদের হাত থাকায় স্থানীয়রাও প্রতিবাদ করতে সাহস পায় না। তাছাড়া বর্তমানে কয়লার দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বিভিন্ন ফলদ ও বনজ গাছগুলো কেটে ইটভাটার জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করছেন ইটভাটার মালিকরা।
স্থানীয় সফিক মিয়া, আসলাম হোসেনসহ কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিনটি ইউনিয়নের মধ্যে মদনপুর ইউপি চেয়ারম্যান গাজী এমএ সালামের আনন্দ ব্রিকস ফিল্ড, টাটা ব্রিকস ফিল্ড ও ধামগড় ইউপি চেয়ারম্যান কামাল হোসেনের ৯০৯ ব্রিকস ফিল্ড, ৭৮৬ ব্রিকস ফিল্ড এবং মুছাপর ইউপি চেয়ারম্যান মাকসুদ হোসেনের ২এসবি ব্রিকস ফিল্ড। নারায়ণগঞ্জ জেলা পরিষদের সদস্য ও ধামগড় ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান মাসুম আহম্মেদের এইচআরবি ব্রিকস ফিল্ডসহ কেবিএম ব্রিকস ফিল্ড, বিবিএম ব্রিকস ফিল্ড, ডিবিসি ব্রিকস ফিল্ড, রুপা ব্রিকস ফিল্ড, এমএবি ব্রিকস ফিল্ড, বিসমিল্লাহ ব্রিকস ফিল্ড, এমবিসি ব্রিকস ফিল্ড, আল্লার দান ব্রিকস ফিল্ডসহ প্রায় অর্ধশতাধিক অনুমোদনহীন ইটভাটা আছে। এক সময় যেসব এলাকায় মাঠের পর মাঠে দেখা যেত সবুজ ফসলের দৃশ্য এখন সেসব এলাকায় একের পর এক গড়ে উঠেছে ইটভাটা। ইটভাটার কালো ধোয়ায় চারদিক আচ্ছন্ন হয়ে আছে। দিনের বেলাতেও এ এলাকায় নেমে এসেছে রাতের অন্ধকার।
এসব এলাকার মানুষকে ইটভাটার এ বৈরী পরিবেশের সাথে যুদ্ধ করে বসবাস করতে হচ্ছে। অথচ এসব ইটভাটার বেশির ভাগই অনুমোদনহীন। যে কয়েকটার অনুমোদন আছে তাও মেয়াদোত্তীর্ণ। অভিযোগ রয়েছে, প্রতি মৌসুমে এখানকার ইটভাটার মালিকরা প্রশাসনের পেছনে ভাটা প্রতি ১লাখ টাকা থেকে শুরু করে ২ লক্ষ টাকা খরচ করে ইটভাটার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে অনুমতির মেয়াদ শেষ হওয়ায় নতুন করে প্রতি ইটভাটা থেকে ৫০ হাজার টাকা এবং যেগুলো কোনো লাইসেন্স-ই নেই সেগুলো থেকে এক লাখ টাকা করে জমা দিয়ে ইটভাটাগুলো চালানো হচ্ছে। একই সাথে এখানকার কিছু ভূমিদস্যুরা কৃষকের চাষের জমি কেটে পুকুরের চেয়েও বেশি গভীর করে মাটি নিয়ে যাচ্ছে ইটভাটায়। ইটভাটাগুলো দেশের প্রচলিত আইন ভঙ্গ করে দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছে তাদের ধ্বংসযজ্ঞ। অথচ প্রশাসন তাদের কিছুই করতে পারছে না। এ কারণে স্থানীয়রা খুব আতঙ্কে আছে বলে জানান তারা।
ইটভাটা স্থাপন আইন অনুযায়ী, আবাসিক এলাকায় কৃষি জমি এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এক কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না। একই সাথে গত তিন বছরে ভাটাগুলোর লাইসেন্সও নবায়ন করা হচ্ছে না বলে পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বন্দরের মুছাপুর, ধামগড় ও মদনপুর ইউনিয়নের বেশির ভাগ জায়গায়ই প্রকাশ্যে কৃষি জমি থেকে মাটি কেটে নেওয়া হচ্ছে। বন্দর উপজেলার সহকারী ভূমি ও নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে বছরে দু-একবার মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হলেও সারা বছর আর তদারকি করা হয় না।
শিক্ষক আমিনুল ইসলাম বলেন, আমরা অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে একাধিকবার মানববন্ধন করে কোনো ফল পাইনি। প্রশাসনকে ম্যানেজ করে তারা অবৈধ ইটভাটা চালিয়ে যাচ্ছে। এতে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বিআরবি ইটভাটার মালিক মো. মোস্তফা জানান, পরিবেশ অধিদপ্তরে ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করেছি, এখনো ছাড়পত্র পাইনি। অন্যান্য ইটভাটা যেভাবে চলছে আমিও সেভাবে চালাচ্ছি।
বন্দর ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি ও কেবিএম ইটভাটার মালিক মোমিন খান জানান, এ উপজেলার অধিকাংশ ইটভাটার কাগজপত্র নেই। তাদের কাগজপত্রের কথা বলতে গেলে আমাকেই হুমকি দেয়। আমার ইটভাটার পরিবেশের ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করেছি।
মুছাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইটভাটা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ হোসেন কালবেলাকে জানান, এ উপজেলার কোনো ইটভাটার পরিবেশের ছাড়পত্র নেই। কয়েকটি ইটভাটার জেলা প্রশাসকের অনুমোদন থাকলেও পরিবেশের ছাড়পত্র না থাকায় নবায়ন করতে পারছেন না। বন্দর উপজেলার ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মনিষা রানী বলেন, অবৈধ ইটভাটাগুলোর বিরোদ্ধে আমাদের কাছে কেউ লিখিত অভিযোগ করেনি। তারপরও আমরা অভিযান পরিচালনা করবো।
এরই মধ্যে মঙ্গলবার নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় ১২টি অবৈধ ইটভাটায় অভিযান চালিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর। এ সময় ইটভাটাগুলোর মালিকদের ৮১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। জরিমানার পাশাপাশি কয়েকটি ইটভাটা ভেকু দিয়ে গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। জরিমানা করা ইটভাটাগুলো হলো- মেসার্স সেলিম ব্রিক্স, মেসার্স বন্ধু বিক্স, মেসার্স নিউ ব্রিক সান, জমজম ব্রিক্স, ধলেশ্বরী ব্রিক্স, চার চরহবিল ব্রিক্স, তৈয়ব ব্রিকস, নূরে মদিনা ব্রিকস, মহব্বত আলী ব্রিকস, নিউ নূর ব্রিকস ও রাকিব ব্রিকস। তবে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় অভিযান হলেও রহস্য জনক কারণে বন্দরে অবৈধ ভাটাগুলোতে কোন অভিযান হচ্ছে না।
নারায়ণগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তর সহকারী পরিচালক শেখ মোজাহীদ জানান, ইটভাটাগুলো পরিবেশ ছাড়পত্র ও লাইসেন্স ছাড়াই ইট তৈরি করত। তাই জরিমানা করা হয়েছে । তাদের ইট তৈরির সময়ের আগে এক মৌসুমের জন্য তারা হাইকোর্ট থেকে অনুমতি নিয়ে আসে। তাই আমরা হাইকোর্টের নির্দেশের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারি না। তবে আমরা অন্য কোনো ত্রুটি পেলে এবং যেগুলোর কোনো অনুমতি বা কাগজপত্র না থাকে সেগুলোতে অভিযান চালিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করি। আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে।
নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাহমুদুল হক বলেন, কৃষি প্রধান দেশে কোনোভাবেই ফসলি জমির মাটি কেটে ইটভাটায় বিক্রি করতে দেওয়া হবে না। অনুমোদনহীন ইট ভাটাগুলোর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
মন্তব্য করুন