মোশাররফ হোসেন, পঞ্চগড় প্রতিনিধি
প্রকাশ : ১২ মার্চ ২০২৪, ০৯:১৩ এএম
আপডেট : ১২ মার্চ ২০২৪, ১০:২৫ এএম
অনলাইন সংস্করণ

দুবেলা খাবার জুটত না সাফ ফুটবল তারকা ইয়ারজানের

গোলকিপার ইয়ারজান বেগম। ছবি : সংগৃহীত
গোলকিপার ইয়ারজান বেগম। ছবি : সংগৃহীত

নেপালে সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ ফুটবল টাইব্রেকারে তিনটি গোল ঠেকিয়ে ছিনিয়ে এনেছেন চ্যাম্পিয়নশিপ ট্রফি। গোলকিপার ইয়ারজান বেগমের অসাধারণ নৈপুণ্যে ভারতকে ৩-২ গোলে হারিয়ে জয় পায় বাংলাদেশ। জয়ের পর থেকেই দেশের ফুটবলপ্রেমীদের সঙ্গে আনন্দে ভাসছে ইয়ারজানের পরিবারসহ এলাকার মানুষ। জয়লাভের পর রোববার (১০ মার্চ) রাতেই ইয়ারজানের বাড়িতে ভিড় করে স্থানীয়রা। সোমবার (১১ মার্চ) সকালে প্রতিবেশীরা একে অপরকে মিষ্টি খাওয়ান।

এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অতিদরিদ্র ঘরের সন্তান ইয়ারজান বেগম। বাবা আব্দুর রাজ্জাক দীর্ঘদিন ধরে শ্বাসকষ্টের রোগী। মা রেনু বেগম অন্যের বাড়ি এবং ক্ষেত খামারে দুইশ থেকে আড়াইশ টাকা হাজিরায় কাজ করেন। ইয়ারজানের বাড়ি পঞ্চগড় সদর উপজেলার হাড়িভাসা ইউনিয়নের খোপড়াবান্দি গ্রামে। সংসারে বাবা-মা ছাড়াও চার বছরের এক বোন রয়েছে।

মা রেনু বেগমের সামান্য আয় দিয়েই চলে চার সদস্যের সংসার। দুই বেলা ঠিকমত খাবার জুটত না ইয়ারজানের। এর মধ্যে লেখাপড়ার পাশাপাশি স্কুল পর্যায়ে খেলাধুলায় ভালো করে সে। স্কুলের হয়ে জেলা পর্যায়ে একাধিকবার চাম্পিয়ন হয় ইয়ারজানের ফুটবল দল। জেলা পর্যায়ে বিভিন্ন লেখার সময় ইয়ারজানের প্রতিভা আন্দাজ করেন পঞ্চগড় টুকু ফুটবল একাডেমির টুকু রেহমান। পঞ্চগড় স্টেডিয়ামে টুকু ফুটবল একাডেমি থেকে তাকে প্রশিক্ষিত করা হয়। তবে সংসারে অভাবের কারণে প্রতিদিন ১২ কিলোমিটার দূরে জেলা শহরের মাঠে প্রশিক্ষণে যাওয়ার রিকশা ভাড়াও দিতে পারতেন না ইয়ারজানের বাবা-মা।

প্রত্যন্ত এলাকার একে তো গরিব ঘরের মেয়ে, তার ওপর আবার ফুটবল খেলা। ইয়ারজানের ফুটবল খেলা মেনে নিতে পারেননি এলাকার মুরব্বিরা। তবে লোক লজ্জা পেছনে ফেলে এগিয়ে যান ইয়ারজান। জেলা পেরিয়ে জাতীয় পর্যায়ে একাধিকবার বিভিন্ন লীগ ও ক্লাবের হয়ে খেলেছেন ইয়ারজান। সর্বশেষ সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ ফুটবলে দেশের হয়ে বিজয় ছিনিয়ে আনার খবরে এখন যেন ইয়ারজান শুধু হাড়িভাসা আর খোপড়াবান্দি নয়, পঞ্চগড়সহ দেশের গর্ব হয়ে উঠেছে। সোমবার সকালে ইয়ারজানের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তার আত্মীয়-স্বজন ছাড়াও এলাকার লোকজনের ভিড়। জেলা শহরে থেকেও অনেকেই দেখতে যান ইয়ারজানের বাড়ি। ভাঙাচোরা ঝুপড়িঘরে বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকতেন ইয়ারজান বেগম। বাঁশের বেড়ার ফাঁক গলিয়ে বাইরে থেকে দেখা ঘরের ভেতর। অভাব অনটনে খুশির এমন মুহূর্তেও ইয়ারজানের বাবার কাছে নেই মিষ্টি কেনার টাকা। তাই প্রতিবেশীরা নিজেদের টাকায় মিষ্টি কিনে মানুষজনকে মিষ্টি মুখ করান। এ সময় ইয়ারজানের স্কুলের শিক্ষকরাও তার বাড়িতে যান।

মেয়ের সাফল্যে আপ্লুত রেনু বেগম। তিনি বলেন, খুব কষ্ট করে আমার মেয়ে এ পর্যন্ত এসেছে। মানুষের কৃষি জমিতে কাজ করে মেয়েকে বড় করেছি। অভাবের সংসারে মেয়েকে তিনবেলা ঠিকমতো খাওয়াতে পারিনি। তার অদম্য ইচ্ছাশক্তি তাকে সাফল্য এনে দিয়েছে, আমাদের গর্বিত করেছে।

তিনি বলেন, দৈনিক ২৫০ টাকা মুজুরি পাই। এ দিয়েই অসুস্থ স্বামীর চিকিৎসা খরচ ও সংসার চালাই। অনেক সময়ে মেয়েকে অনুশীলনে যাওয়ার যাতায়াত ভাড়া দিতে পারতাম না। কিছু কিনে খাবে এ জন্য অতিরিক্ত টাকা কখনই দিতে পারিনি। আজকে সব কষ্ট আমার দূর হয়েছে, গর্বে বুক ভরে গেছে।

রেনু বেগম আর বলেন, খেলার জন্য আমার মেয়ে ইয়ারজানকে অনেক বকাবকি করতাম, ভয় দেখাতাম। খেলতে যেতে নিষেধ করতাম। কিন্তু সে লুকিয়ে খেলতে চলে যেত। পরে যখন বুঝলাম সে ভালো খেলতেছে, তখন আর গালি দিতাম না। তবে খেলতে যাওয়ার জন্য রিকশা ভাড়াও দিতে পারতাম না। ওর বাবা অসুস্থ, কাজ করতে পারেন না। আমি আড়াইশ টাকা হাজিরার আয় দিয়ে দুই মেয়েসহ চারজনের সংসার চলত। তাকে কখনো ভালো কিছু খাওয়াতে পারিনি। অনেক সময় সে না খেয়েই খেলতে চলে যেত। এখন সে বিদেশের মাটিতে খেলে ভালো করেছে, আমরা খুব খুশি হয়েছি। আমাদের মতো এলাকার সবাই খুশি।

ইয়ারজানের বাবা আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আমি দুবার টিবির চিকিৎসা নিয়েছি। এখনো দম বন্ধ হয়ে আসে, শ্বাসকষ্ট হয়। কোনো কাজ করতে পারি না। ইয়ারজানের মায়ের সামান্য আয় দিয়েই আমাদের খেয়ে না খেয়ে থাকতে হয়। সরকারি কোনো সাহায্য সহযোগিতাও পাইনি। মেয়েকে ভালো কিছু খাওয়াতে পারিনি। কোনো কোনো দিন আমার মেয়ে সকালে নাশতা করে সেই নাশতা দিয়েই সারাদিন কাটিয়েছে। দুপুর এব রাতে ভাত পায়নি, কারণ আমি খাবার জোগার করতে পারি নাই। এজন্য আমি আমার মেয়েকে খেলা বাদ দিতে বলেছিলাম।

এটিএম আখতারুজ্জামান ডাবলু বলেন, ইয়ারজান আমাদের এলাকার কৃতীসন্তান। তার পরিবার একবারেই হতদরিদ্র। তার মা রেনু বেগমের আয়েই চলে তাদের সংসার। এমন পরিবার থেকে ওঠে আসা সহজ বিষয় নয়। ইয়ারজানের সাফল্যে আমরা গর্বিত। আমরা প্রত্যাশা করছি সামনে জাতীয় দলেও জায়গায় করে নেবে এবং বাংলাদেশের ফুটবলকে ভালো কিছু উপহার দেবে। ইয়ারজানের জন্য শুভকামনা রইল।

টুকু ফুটবল একাডেমির পরিচালক টুকু রেহমান বলেন, হাড়িভাসার মতো প্রত্যন্ত এলাকা থেকে ইয়ারজার নিয়মিত শহরের এসে প্রশিক্ষণ নিত। তার এই ফুটবল খেলা গ্রামের অনেকেই ভালো চোখে দেখত না। এর মাঝেও প্রতিদিন সে নির্ধারিত সময়ের দুই ঘণ্টা আগে মাঠে হাজির হয়ে আমাকে ফোন করে আসতে বলত। তার খেলার প্রতি আগ্রহ দেখে অবাক হতাম। তার অনেক বড় স্বপ্ন। এখন সে স্বপ্নে অনেক কাছাকাছি। আশা করি, সে আগামীতে জাতীয় দলের হয়ে খেলবে।

ইয়ারজান হাড়িভাসা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এই বিদ্যালয়ের শিক্ষক আফসার আলী বলেন, ইয়ারজান স্কুলের একজন আন্তরিক ও পরিশ্রমী ছাত্রী। খেলাধুলায় ইতোপূর্বে স্কুলের বেশ সুনাম কেড়েছে। ভারতের সঙ্গে খেলা ফাইনাল ম্যাচের পুরোটাই আমি টিভিতে দেখেছি। তার দুর্দান্ত কিপিং আমাকে মুগ্ধ করেছে। তার ধারাবাহিক সাফল্যে আমরা গর্বিত।

হাড়িভাসা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান শিক্ষক আব্দুর রহমান বলেন, ইয়ারজানের নেতৃত্বে আমাদের স্কুল পরপর তিনবার ফুটবলে জেলা চ্যাম্পিয়ন হয়। সে আসলে দারুণ খেলে। গোলকিপার ছাড়াও সে ফুটবলে বিভিন্ন স্থানে ভালো খেলে। আমাদের স্কুলে তার মত একজন মেধাবী খেলোয়াড় পেয়ে আমরা গর্বিত। আশা করি সে দেশের জাতীয় দলে সুযোগ পাবে এবং দেশের সুনাম বয়ে আনবে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে ‘কড়া হুঁশিয়ারি’ ভারতের

মে মাসে পুড়তে পারে দেশ

ভাঙা হলো ময়মনসিংহ সাহিত্য সংসদের ‘বীক্ষণ’ মঞ্চ

বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাদের সঙ্গে পুলিশের মতবিনিময় 

সেঞ্চুরির পর ৫ উইকেট আর জয়, মিরাজের ধন্যবাদ পেলেন যারা

সূর্যের তাপে পুড়ছে পাকিস্তান

রাজনৈতিক মতৈক্যে করিডরের সিদ্ধান্ত নিন, সরকারকে সমমনা জোট

ঈদের আগেই বাজারে আসছে নতুন নোট, যা থাকছে নকশায়

মেধাবী শিক্ষার্থীদের পাশে ঢাবি অ্যালামনাই

পদোন্নতির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে চিকিৎসকদের অবস্থান কর্মসূচি

১০

সাংবাদিককে হুমকি দেওয়া সেই অধ্যক্ষকে কেন্দ্র সচিবের পদ থেকে অব্যাহতি

১১

রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা ছাড়া করিডর নয় : শেখ বাবলু

১২

ইবিতে সাংবাদিকের ওপর হামলার ঘটনায় ছাত্রদলের নিন্দা

১৩

ইসরায়েলি গুপ্তচর সন্দেহে ইরানে এক জনের ফাঁসি কার্যকর

১৪

তীব্র তাপদাহের সঙ্গে মে মাসে কালবৈশাখী-ঘূর্ণিঝড়ের আভাস

১৫

ফ্যাসিস্ট আমলে হাজার হাজার শ্রমিককে পথে বসানো হয়েছে : রিজভী

১৬

সীমান্তের বাসিন্দাদের যুদ্ধকালীন প্রশিক্ষণ দিচ্ছে ভারত

১৭

খুলনায় বিএনপির নেতাকর্মীদের থানা ঘেরাও

১৮

ইয়েমেনের হামলায় যুদ্ধবিমান হারিয়ে পিছু হটল মার্কিন রণতরী

১৯

বাড়িতে ছাদবাগান থাকলে মিলবে ৫ শতাংশ ট্যাক্স রেয়াত

২০
X