রাজশাহী নগরীতে আবাসন ব্যবসার নামে প্রতারণা করে ‘ফুটপাত থেকে রাজপ্রাসাদে’ আসা সেই মোস্তাফিজ তার প্রতারণা আড়াল করতে জমির মালিক ও ফ্ল্যাট ক্রেতাদের হুমকি দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
প্রতারণার বিষয় নিয়ে মুখ খুললে জমির মালিকদের অংশের ফ্ল্যাটের কাজ করবে না বলে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। অপরদিকে তার অংশের বিক্রি করা ফ্ল্যাট ক্রেতাদের রেজিস্ট্রি করে দেওয়া হবে না বলেও হুমকি দিচ্ছেন তিনি। এ নিয়ে জমির মালিক ও ক্রেতাদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে।
এদিকে ভবন নির্মাণে অনিয়ম ও আবাসন ব্যবসায়ী না হয়েও বিজ্ঞাপন দিয়ে ফ্ল্যাট বিক্রি করার ঘটনায় দুটি পৃথক চিঠি দিয়েছে রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (আরডিএ)। শনিবার (২৩ মার্চ) আরডিএ’র অথোরাইজড কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
জানা গেছে, ‘গ্রীণ প্লাজা রিয়েল অ্যাস্টেট কোম্পানির’ ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান রাজশাহী নগরীর ঘোড়ামারা এলাকায় গ্রীণ প্যালেস নামের একটি সাততলা ভবন নির্মাণ করছেন। ভবনটির ছাদ ঢালাইসহ প্রায় ৭০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী চলতি মার্চ মাসের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার কথা। তবে বাকি কাজ করতে গড়িমসি করছেন। যারা ফ্ল্যাট কিনেছেন তাদেরকেই এখন কাজ করে ফ্ল্যাটে উঠতে বাধ্য করা হচ্ছে। আবার চুক্তির বাইরে অতিরিক্ত অর্থও দাবি করছেন মোস্তাফিজ। এসব অনিয়ম নিয়ে মুখ খুললে ফ্ল্যাটের রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হবে না বলেও হুমকি দিচ্ছে ক্রেতাদের।
ফ্ল্যাটের এক ক্রেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমি তিন বছর আগে মোস্তাফিজ থেকে গ্রীণ প্যালেসে ১৮৫০ স্কয়ার ফুটের একটি ফ্ল্যাট কিনি। ৬৪ লাখ টাকা দাম ধরে ৪০ লাখ টাকা প্রথমে পরিশোধ করেছিলাম । বাকি টাকা ঋণ করে সমন্বয় করে দেওয়ার কথা। পরে ব্যাংক ঋণ করতে গিয়ে জানতে পারি ওই ফ্ল্যাটের আরডিএর নকশা অনুমোদন আছে ১৭২০ স্কয়ার ফিট। নকশার বাইরে প্রায় ১৩০ স্কয়ার ফিট অতিরিক্ত করা হয়েছে অবৈধভাবে। ফলে আর ব্যাংক ঋণ পাইনি।’ তিনি বলেন, ‘ব্যাংক ঋণ না পেলেও ধারদেনা করে আমি কয়েক ধাপে মোস্তাফিজকে ফ্ল্যাটের প্রায় সমস্ত টাকাই পরিশোধ করতে চাই। কিন্তু সে এর মধ্যে অন্য এক ব্যক্তির কাছে ওই ফ্ল্যাটটি বিক্রি করে দেয়। বাধ্য হয়ে আমি মেয়রের কাছে অভিযোগ করি।’
এ ক্রেতা আরও বলেন, ‘পরে মেয়রের হস্তক্ষেপে ফ্ল্যাটটি বুঝে পেয়েছি। কিন্তু সে আমার নিকট থেকে এখন চুক্তির বাইরে আরও ১০ লাখ টাকার ওপরে বেশি দাবি করছে। ফ্ল্যাটের বাকি কাজগুলোও আমাকেই করে নিতে হচ্ছে। টাকা না দেওয়ায় রেজিস্ট্রি দিতে গড়িমসি করছে। মিডিয়ার সামনে কথা বললে ফ্ল্যাটের রেজিস্ট্রি দেওয়া হবে বলেও হুমকি দিচ্ছে। তার লোকজনকে দিয়েও নানাভাবে হুমকি দিচ্ছে মোস্তাফিজ।’
ওই ভবনের পাশের এক বাসিন্দা আনসার আলী বলেন, ‘ভবনটি নির্মাণের সময় নানা অনিয়ম দেখে আমরা বারবার আরডিএতে ফোন করে অভিযোগ করেছি। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। চারদিকে এক ফিটও জায়গা ছাড়েনি। অবৈধভাবে প্রতিটি ফ্ল্যাটের অতিরিক্ত অংশ বৃদ্ধি করে বাণিজ্য করেছে তারা।’
মোস্তাফিজকে ভবন নির্মাণের জন্য জমি দেওয়া নগরীর রাজারহাতা এলাকার ওয়ালিউর রহমান বাবু বলেন, ‘আমাদের তিন কাঠা জমির ওপর বাড়ি ছিল সেটি ভেঙে ফেলেছে মোস্তাফিজ। কিন্তু গত তিন বছরেও ওই বাড়ির কাজ শুরুই করতে পারেনি। এসব নিয়ে মিডিয়ার সামনে কথা বলায় আমাকেও নানাভাবে হুমকি দেওয়া হচ্ছে।’
আরেক জমির মালিক বলেন, ‘চুক্তি অনুযায়ী মোস্তাফিজ অনেক শর্তই মানেনি। সে প্রতারণা করেছে আমাদের সঙ্গেও। সময়মতো বাড়ির কাজও শেষ করেনি। এখন এসব নিয়ে কথা বললে সে বাকি কাজগুলো শেষ করবে না।’
জানতে চাইলে ‘গ্রীণ প্লাজা রিয়েল এ্যাস্টেটের মার্কেটিং ম্যানেজার মাসুদ রানা বলেন, ‘গ্রীণ মনোয়ারা প্যালেসে বিক্রির মতো ফ্ল্যাট রয়েছে। প্রতিটি ফ্লোরে চারটি ইউনিট আছে। অতিরিক্ত অংশ করা হয়েছে কিনা কর্তৃপক্ষ বলতে পারবেন।’
জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমি কোনো অনিয়ম করিনি। নিয়ম মেনেই আমি ব্যবসা করছি। আমার সমস্ত ডকুমেন্ট আছে। কোনো কিছুই অনিয়মের মধ্যে হয়নি।’
বিষয়ে রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অথরাইজড কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘গ্রীণ প্যালেস ও গ্রীণ মনোয়ারা প্যালেসে নকশার বাইরে অতিরিক্ত অংশ করা হয়েছে। আমরা অতিরিক্ত অংশ ভেঙে ফেলার জন্য চিঠি দিব। প্রাথমিকভাবে তাদের কারণ দর্শানোর চিঠি দিয়েছি। অতিরিক্ত অংশ ভেঙে ফেলা হবে।
তিনি আরও বলেন, আমরা দুটি চিঠি দিয়েছি। এর মধ্যে একটি ওই ভবন দুটির জমির মালিকদেরকে। নকশার বাইরে অতিরিক্ত অংশ করায় সেটির জবাব চাওয়া হয়েছে। আরেকটি দিয়েছি আবাসন ব্যবসায়ী না হয়েই বিজ্ঞাপন দিয়ে ফ্ল্যাট ব্যবসার নামে প্রতারণা করায়। মোস্তাফিজকে দুটি চিঠিতেই কারণ দর্শানোর জন্য বলা হয়েছে। জবাব পাওয়ার পরে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
‘গ্রীণ প্লাজা রিয়েল অ্যাস্টেট কোম্পানি লিমিটেড’ নামের এই আবাসন ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে প্রতারণার মাধ্যমে অন্তত ২০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এ নিয়ে শনিবার (২৩ মার্চ) দৈনিক কালবেলায় ‘প্রতারণা করে ফুটপাত থেকে রাজপ্রাসাদে’ শিরোনামে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
মন্তব্য করুন