আজহার ইমাম, বিরামপুর (দিনাজপুর) প্রতিনিধি
প্রকাশ : ১৪ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:৩৯ এএম
অনলাইন সংস্করণ

দোলনা কারিগরের সংসার চলে অভাবে

দোলনা তৈরিতে ব্যস্ত নগেন চন্দ্র মোহন্ত। চবি : কালবেলা
দোলনা তৈরিতে ব্যস্ত নগেন চন্দ্র মোহন্ত। চবি : কালবেলা

বাঁশের চিকন কাঠির গোলাকার ফ্রেমের ভেতরে বসে কাজ করছেন নগেন চন্দ্র মোহন্ত (৫৪)। একটি কাঠির সঙ্গে মোটা সুতা দিয়ে আরেকটি কাঠি জোড়া লাগাতে তার হাত চলছে নিখুঁতভাবে। আড়াআড়ি সাজানো লাল-সবুজ রঙের কাঠির নিপুণ কারুকাজ শেষে ফ্রেমে লাগিয়ে দেন রঙিন দড়ি। তৈরি হয় শিশুদের দোলনা। নগেনের কাছ থেকে কেনা রঙিন দোলনায় শুয়ে শিশুরা হয়তো শান্তিতে ঘুমায়; কিন্তু জটিল রোগ আর আর্থিক অনটনে নির্ঘুম রাত কাটান দোলনার কারিগর নগেন চন্দ্র।

দিনাজপুরের বিরামপুর পৌর শহরের রেলস্টেশন এলাকায় নগেন চন্দ্র মোহন্তের বাড়ি। দীর্ঘ চার বছরের বেশি সময় ধরে তিনি শুক্রাশয়ের সংক্রমণ, গোদরোগ ও প্রসাবের জ্বালাপোড়ায় ভুগছেন। এ সংক্রমণে যৌনাঙ্ক কখনো ফুলে গিয়ে সেখানে প্রচণ্ড ব্যথা করে। এতে তিনি প্রায় সময় শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। দোলনা তৈরি ও বিক্রি করে যা আয় হয়, তা দিয়ে নিজের চিকিৎসা ও সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন নগেন চন্দ্র। এরই মধ্যে গ্রাম্য চিকিৎসক থেকে শুরু করে শহরের বড় ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা নিয়েছেন তিনি। তবে গত চার বছরে অনিয়মিত চিকিৎসায় তার রোগ এখন জটিল রূপ নিয়েছে।

এক মাস আগেও দোলনা তৈরির কাজে যে হাত নৈপুণ্য দেখাত, শরীরের পীড়ায় সেই হাত আর আগের মতো কাজ করতে পারে না। চিকিৎসক জানিয়েছেন, খুব শিগগির অস্ত্রোপচার করতে হবে। এতে খরচ হবে লাখখানেক টাকা। চিকিৎসার টাকা কীভাবে জোগাড় হবে, তা জানেন না নগেন চন্দ্র।

দোলনা তৈরি ও বিক্রি করে যা আয় হয়, তা দিয়ে নিজের চিকিৎসা ও সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন নগেন চন্দ্র। গত চার বছরে অনিয়মিত চিকিৎসায় তার রোগ এখন জটিল রূপ নিয়েছে।

গত ৬ এপ্রিল নগেন চন্দ্রের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির আঙিনায় তার স্ত্রী দ্রৌপদী রানী দোলনার কাঠিতে নীল রং করছেন। পাশে অসুস্থ শরীর নিয়ে নগেন চন্দ্র দোলনার ফ্রেমের ভেতরে বসে দোলনার কাঠি জোড়া দিতে সুতা বাঁধছেন। অসুস্থ শরীর নিয়ে এভাবে কাজ করতে প্রায় সময় আর পারেন না, কখনো শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন বলে জানালেন তার স্ত্রী। প্রায় রাতে ঘুমাতে পারেন না, যন্ত্রণায় ছটফট করে কাটান।

দ্রেীপদী রানী জানান, তাদের দুই মেয়ে ও এক ছেলে। বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে তিন বছর আগে। আর ছোট মেয়ের বিয়ে হয়েছে মাসখানেক হলো। ছেলে একাদশ পড়ছে।

নগেন চন্দ্র জানান, তার পৈতৃক ভিটা ছিল বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলা সান্দিরা গ্রামে। সেখান থেকে কোনো জমি-সম্পদ পাননি তিনি। তার প্রায়াত বাবা নকুল চন্দ্র মোহন্তও পেশায় ছিলেন দোলনা তৈরির কারিগর। বাবার কাছ থেকেই এটি তৈরির কাজ শিখেছিলেন নগেন। নিজ হাতে দোলনা তৈরি করে সেগুলো বগুড়ার সান্তাহার বাজারে বিক্রি করতেন। মাঝেমধ্যে বিক্রি করতে বিরামপুর শহরে আসতেন। সেখানে তার তৈরি করা দোলনা ভালো বিক্রি হতে থাকায় প্রায় ২০ বছর আগে বিরামপুর পৌর শহরে বাসা ভাড়া নেন। পরে শহরের ঢাকা মোড়ে দোলনার দোকান দেন। পরবর্তী সময়ে বিরামপুর রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় রেলওয়ের জায়গাতে টিনের ছাউনি ও বেড়া দিয়ে বাড়ি করে সেখানেই বসত গড়েন তিনি।

বাজার থেকে বাঁশ, প্লাসিকের ফিতা ও রং কিনে বাড়িতে নিয়ে দোলনা তৈরি করেন নগেন। দিন শেষে তৈরি হওয়া এগুলো পৌঁছে দেন শহরের স্থানীয় দোকানে। তার কাজে এত দিন সহায়তা করে এসেছেন স্ত্রী ও ছোট মেয়ে। মেয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে যাওয়ায় বাড়িতে এখন দোলনা তৈরির কাজে একমাত্র সহযোগী স্ত্রী। পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতায় নগেন চন্দ্র আগে যেখানে প্রতিদিন চার থেকে পাঁচটি করে দোলনা তৈরি করতে পারতেন, সেখানে এখন সেই সংখ্যা কমে গেছে।

স্ত্রীকে নিয়ে সারা দিনে দুটি দোলনা তৈরি করেন। আর এতে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা আয় হয়। নগেন ও দ্রৌপদী বলেন, আয়ের টাকায় প্রতিদিন ১৯৪ টাকার ওষুধ, ছেলের পড়ালেখা খরচ আর খাবার জোটাতে অসুস্থ শরীর নিয়ে তাঁদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।

এ ব্যাপারে কথা হয় বিরামপুর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা আবদুল আউয়ালের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘নগেন চন্দ্র যদি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার অপারেশন করাতে চান, সে ক্ষেত্রে হাসপাতালে সমাজসেবা থেকে ওষুধ ও অপারেশন উপকরণ কিনতে সহযোগিতার সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা চলাকালে তার ওষুধ কেনার জন্য উপজেলা সমাজসেবা থেকে আর্থিক সহযোগিতা করা হবে।’

নগেন চন্দ্র মহন্ত দৈনিক কালবেলাকে জানান, ‘শরীরের অসুখ নিয়ে খুব কষ্টোত আছো। এই শরীর নিয়ে আগের মতো আর দোলনা বানবার পারো না। আয় রোজগারও আগের মতো হয় না। তার ওপোরোত আবার ডেইলি ১৯৪ টাকার ঔষধ কিনবার নাগে (লাগে)। অ্যালা চিন্তা করলে তো দুচোখোত আন্দার (অন্ধকার) দ্যাখো। ডাক্তার কইছে অপারেশন করবার নাগবে। এক লাখ টাকার মতো খরচ হইবে। এত টাকা মুই কোত্তে (কোথায়) পাবু। কেউ যদি হেল্প করলো হয়, তাহলে তো অসুখ সারলো হয়।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

গাজায় হামাসের বন্দুকধারীদের টহল

আগামীর রাষ্ট্রকাঠামোর পূর্ণ রূপরেখা ৩১ দফাতেই রয়েছে : কফিল উদ্দিন 

পরিবেশ রক্ষায় ৮০ হাজার বৃক্ষরোপণ করা হয়েছে : টুকু 

ক্ষমতায় এলে ১৮ মাসে এক কোটি কর্মসংস্থান গড়বে বিএনপি : আমিনুল হক

মিসরে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পেলেন ট্রাম্প

নেইমারের জন্য এখনও দরজা খোলা রেখেছেন আনচেলত্তি

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষ ও প্রফেশনাল কোর্সের সব পরীক্ষা স্থগিত

ইতিহাস গড়ে ফুটবল বিশ্বকাপের টিকিট পেল কেপ ভার্দে

পলিথিনে মোড়ানো শপিং ব্যাগে মিলল নবজাতকের মরদেহ

রোমে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ড. ইউনূসের বৈঠক

১০

কলাবাগানে ডিপ ফ্রিজ থেকে নারীর মরদেহ উদ্ধার

১১

অবশেষে বিশ্বের শীর্ষ নেতাদের উপস্থিতিতে গাজা শান্তিচুক্তি সই

১২

জয়পুরহাট জেলা এনসিপির প্রধান সমন্বয়কের পদত্যাগ

১৩

শরীয়তপুরে নির্যাতিত শিশুর পাশে তারেক রহমান

১৪

‘ড. তোফায়েলের শূন্যতা বহু দশক অনুভূত হবে’

১৫

আওয়ামী লীগ নেত্রী কেকার মরদেহ উদ্ধার

১৬

স্থানীয় সমস্যা সমাধানের আশ্বাস আনোয়ারুজ্জামানের

১৭

পূজা পরিষদ ও মহানগর কমিটির প্রত্যাশা / সংকট সমাধানে এক হয়ে কাজ করার নজির অব্যাহত থাকুক

১৮

নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে : পিএনপি

১৯

শেষ ওভারের নাটকীয়তায় প্রোটিয়াদের কাছে বাংলাদেশের হার

২০
X