লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি
প্রকাশ : ১৩ মে ২০২৪, ১১:২৯ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

উন্নয়নের নামে নিধন হচ্ছে বনায়ন, কাটা পড়বে ১৫ হাজার গাছ

গাছ নিধনের জন্য নাম্বারিং করা হয়েছে। ছবি : কালবেলা
গাছ নিধনের জন্য নাম্বারিং করা হয়েছে। ছবি : কালবেলা

মেঘনা নদীর উপকূলীয় এলাকায় লক্ষ্মীপুর-রামগতি সড়ক। সড়কের দুই পাশে সবুজ বেষ্টনীর আওতায় বনবিভাগের পক্ষ থেকে বনায়ন করা হয়েছে। ২০০৫ সালে লাগানো গাছগুলো এখন এ অঞ্চলের মানুষের জন্য যেন আশীর্বাদ হিসেবে কাজ করছে।

গাছের কারণে পুরো সড়কটি ছায়া-শীতল থাকছে। সেই সঙ্গে দেখতেও খুব সুন্দর লাগে। সড়কের পাশে থাকা নানা প্রজাতির বনজ গাছের সঙ্গে ওষুধি, ফলদ গাছ রয়েছে। কৃষ্ণচূড়া গাছের ফুল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ।

কিন্তু লক্ষ্মীপুর-রামগতি সড়কে এ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর বেশি দিন থাকবে না। সড়কের দু’পাশের গাছগুলো কাটা পড়ছে। এ সড়কটি সম্প্রসারণ করা হবে, ফলে কেটে ফেলা হবে সবুজ বেষ্টনীর গাছগুলো।

সড়ক উন্নয়নের নামে গত ৫ বছর আগে নোয়াখালী-লক্ষ্মীপুর-রায়পুর মহাসড়কে দুই পাশে থাকা শতবর্ষী গাছসহ সকল প্রকার গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। সড়ক সম্প্রসারণের জন্য ২০২০ সালের দিকে লক্ষ্মীপুরের মজুচৌধুরীর হাট মহাসড়কের পাশে থাকা প্রায় পাঁচ হাজার গাছ কাটা হয়েছে। ফলে এ দুই সড়কে এখন কোনো গাছ নেই। তপ্ত রোধে ওষ্ঠাগত অবস্থা পথচারীদের। সড়ক বিভাগের পক্ষ থেকেও বন বিভাগকে সড়কের পাশে বনায়ন করার অনুমতি দিচ্ছে না। তবে মজুচৌধুরীর হাট সড়কের একটি অংশের দু'পাশে কিছু গাছ লাগিয়েছে বন বিভাগ। ঢাকা-রায়পুর মহাসড়কের লক্ষ্মীপুর অংশ খালি পড়ে আছে।

স্থানীয়রা বলছেন, উন্নয়নের নামে দিনের পর দিন বন ধ্বংস করা হচ্ছে। কিন্তু সে হিসেবে বনায়ন করা হচ্ছে না। সড়কের পাশে গাছ রেখে বিকল্প ও পরিকল্পিত পরিকল্পনা নিয়ে উন্নয়ন করা যেতে পারে। এতে উন্নয়নও হবে, পরিবেশও রক্ষা হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, লক্ষ্মীপুর সড়ক বিভাগের আওতাধীন লক্ষ্মীপুর-চর আলেকজান্ডার-সোনাপুর-মাইজদী সড়কটি ৫.৫০ মিটার থেকে ৭.৩০ মিটার প্রশস্ত করা হবে। লক্ষ্মীপুর অংশে (লক্ষ্মীপুর-রামগতি সড়ক) ৫৪ কিলোমিটার সড়কে বনবিভাগের লাগানো গাছ রয়েছে। গাছগুলো কাটার জন্য গেল বছরের নভেম্বরে লক্ষ্মীপুর সড়ক ও জনপথ বিভাগের পক্ষ থেকে বন বিভাগকে চিঠি দেওয়া হয়। এ সড়কে ২০০৫ সালের দিকে বন বিভাগের লাগানো গাছের সংখ্যা ১৩ হাজার ৪৪৫।

এছাড়া রামগতি উপজেলার নুরিয়া হাজিরহাট-নুরু পাটওয়ারী সড়কের দু’পাশে রাস্তার সাইড ওয়েন্ডিং করার জন্য ওই সড়কের কেরামতিয়া বাজার থেকে ভূলুয়া ব্রিজ হয়ে পূর্বদিকে চৌরাস্তা হয়ে জোগির মোড় পর্যন্ত বন বিভাগের লাগানো গাছ কাটার জন্য গেল বছরের ডিসেম্বরে সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে চিঠি দেয় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। ওই সড়কে বন বিভাগের লাগানো গাছের সংখ্যা ১৬৭২। ২০২১ ও ২০১২ সালের দিকে গাছগুলো লাগানো হয়।

অন্যদিকে রামগঞ্জ উপজেলার পানপাড়া বাজার থেকে লামচর উচ্চ বিদ্যালয় ও আজিমপুর থেকে করপাড়া পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার সড়কে বন বিভাগের ১৮৭টি গাছ রয়েছে। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর থেকে ওই সড়কটির ‘উন্নয়নের বাধা’ ১২৫টি গাছ কাটার জন্য গেল বছরের সেপ্টেম্বরে বন বিভাগকে চিঠি দেওয়া হয়।

বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, লক্ষ্মীপুর-রামগতি আঞ্চলিক সড়কের পাশে ১৩ হাজার ৪৪৫টি, রামগতি উপজেলার ১৬৭২টি এবং রামগঞ্জ উপজেলার ১২৫টিসহ মোট ১৫ হাজার ২৪২টি গাছ কাটার জন্য জেলা পরিবেশ ও বন উন্নয়ন কমিটি অনুমোদন দেয়। ফলে নিলাম প্রক্রিয়ার জন্য ওইসব গাছে ‘নাম্বারিং’ করা হয়েছে। তবে নিলাম প্রক্রিয়া এখনো সম্পন্ন হয়নি। যে কোনো সময় এ গাছগুলো কাটা পড়বে।

সড়ক উন্নয়নের লক্ষ্যে আগেও লক্ষ্মীপুরের বিভিন্ন সড়ক এবং মহাসড়কের পাশে থাকা গাছ কাটা হয়েছে। কিন্তু এরপর কিছু কিছু সড়কে আর লাগানো হয়নি গাছ। বিশেষ করে লক্ষ্মীপুর-রায়পুর-নোয়াখালী মহাসড়কের পাশে থাকা শতবর্ষী গাছসহ নানা প্রজাতির গাছ পাঁচ বছর আগে কাটা হলেও নতুন করে বনায়ন করা হয়নি। লক্ষ্মীপুর মজুচৌধুরীর হাট সড়ক সম্প্রসারণের সময় গাছ কেটে ফেলার পর কিছু অংশে আবার গাছ লাগানো হয়। তবে সড়কের বেশিরভাগ অংশের পাশই খালি পড়ে আছে।

লক্ষ্মীপুর-রায়পুর-নোয়াখালী মহাসড়কের পাশের বাসিন্দারা বলেন, এ মহাসড়কের পাশে বড় বড় গাছ ছিল। কিন্তু সড়ক উন্নয়নের নামে কয়েক বছর আগে গাছগুলো কেটে ফেলা হয়েছে। এরপর আর গাছ লাগানো হয়নি। গাছ থাকাকালীন গাছের ছায়ায় পুরো সড়ক শীতল ছিল। এখন তপ্ত রোধে সড়ক উত্তপ্ত থাকে। শীতল ছায়ার বদলে রোধের উত্তাপ ছড়াচ্ছে।

কমলনগরের তোরাবগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা সানা উল্যা বলেন, মেঘনার উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুর। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এ জেলাতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস লেগেই থাকে। সে জন্য বেশি করে গাছ লাগানো প্রয়োজন। কিন্তু গাছ লাগানের পরিবর্তে কাটা হচ্ছে।

তিনি বলেন, লক্ষ্মীপুর-রামগতি মহাসড়ক দিয়ে চলাচল করি। এ সড়কের দুইপাশে নানা প্রজাতির গাছ লাগানো আছে। গাছের ছায়ায় পুরো সড়ক শীতল থাকে। গাছের কারণে সড়কটিতে প্রাকৃতিক পরিবেশ দারুণভাবে ফুটে উঠেছে। কিন্তু শুনেছি সড়ক সম্প্রসারণের জন্য গাছগুলো কাটা পড়বে। গাছ কাটতে প্রকৃতি ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই গাছ কাটার সিদ্ধান্তের সঙ্গে সঙ্গে গাছ লাগানোর সিদ্ধান্তও যেন নেওয়া হয়।

গাছের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জানতে চাইলে লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, গাছ মাটি থেকে পানি শোষণ করে। পরিমাণমতো পানি নিজে গ্রহণ করে বাকিটা বায়ুমণ্ডলে ছেড়ে দেয়। এতে বায়ুমণ্ডল শীতল থাকে এবং বৃষ্টিপাত হয়। যে অঞ্চলে গাছের পরিমাণ বেশি, ওইসব অঞ্চলে বৃষ্টিপাতও বেশি হয়।

গাছ বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে অক্সিজেন নির্গত করে। এতে বায়ুমণ্ডলের ভারসাম্য রক্ষা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে যে পরিমাণ বৃক্ষ থাকা দরকার, সে পরিমাণ বৃক্ষ না থাকায় বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ ক্রমাগত বাড়ছে। ফলে গ্রিনহাউস গ্যাসের প্রতিক্রিয়ায় তাপমাত্রা বাড়ছে। তাই গাছ না কেটে আমাদের বেশি করে গাছ লাগাতে হবে।

গাছ কাটার বিষয়ে জানতে চাইলে লক্ষ্মীপুর বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক ফিরোজ আলম চৌধুরী বলেন, সড়ক প্রশস্তকরণের জন্য গাছগুলো কাটা পড়বে। এটা সড়ক ও জনপথ বিভাগের সিদ্ধান্ত। আমাদের সিদ্ধান্তে গাছ কাটা হয় না।

তিনি বলেন, তাপদাহ কমাতে বা পরিবেশকে শীতল রাখতে গাছের বিকল্প নেই। গাছের প্রয়োজনীয়তা বর্তমান তীব্র দাবদাহের মধ্যে বুঝি। যেখানে গাছ কাটা পড়বে, সেখানে আমরা পুনরায় বাগান করি। তবে সড়ক ও জনপথ বিভাগ আমাদেরকে গাছ লাগাতে দেয় না। তারা নিজেরা লাগায়। কিন্তু যাদের যে কাজ, তাদের সেটাই করতে হয়।

সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী জহিরুল ইসলাম বলেন, গাছ অল্প কয়েকটা, বেশি না। এটাতে কি প্রকৃতিক দুর্যোগ পড়বে, একটু এনালাইসিস করে দিন।

তিনি বলেন, রাস্তা সম্প্রসারণ ইম্পর্টেন্ট (গুরুত্বপূর্ণ) জিনিস। গাছের গোড়াগুলো হাল্কা, রাস্তা নষ্ট হয়ে যায়। গাছের কারণে সড়কে দুর্ঘটনা ঘটে। রাস্তার জন্য রোদ ভালো। গাছের ছায়া পড়লে রাস্তা নষ্ট হয়ে যায়। ছায়ায় রাস্তায় শ্যাওলা পড়ে, দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনা ভালো, নাকি পরিবেশ ভালো? এখানে দুর্ঘটনা অহরহ ঘটছে।

গাছ কাটার পর লাগানোর বিষয়ে তিনি বলেন, গাছ কাটার পর লাগানো হয় না, তা কিন্তু না। ফল গাছ লাগাতে আমরা উৎসাহ প্রদান করি।

জেলা পরিবেশ ও বন উন্নয়ন কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক সুরাইয়া জাহান বলেন, গাছ কাটার আগে গাছ লাগাতে হবে। কিন্তু সবসময় হয়তো এটা হয়ে ওঠে না৷ এখন যেহেতু তীব্র দাবদাহ, এর মধ্যে গাছ লাগানো খুব একটা ফলপ্রসূ হবে না। তারপরও এ বিষয়টা নিয়ে আমরা বন বিভাগের সাথে কথা বলছি। মজুচৌধুরীর হাট সড়কে গাছ লাগানোর উদ্যোগ নিয়েছি। এ বর্ষাতে আমরা সেখানে গাছ লাগাব।

তিনি বলেন, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে নতুন ভবনের কিছু গাছ কাটা পড়বে। যে পরিমাণ গাছ কাটা পড়বে, তার চাইতে বেশি পরিমাণ গাছ ওইখানে লাগিয়েছি। যাতে কিছু গাছ কাটা পড়লেও ওই গাছগুলো বড় হয়।

রামগতি সড়কে গাছ কাটার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা এ বিষয়টা খেয়াল রেখেছি। তারপরও গাছ লাগানোর বিষয়ে যেহেতু আলোচনা হচ্ছে, আমরা বন বিভাগের সঙ্গে কথা বলব।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

যমুনা ঘেরাওয়ের হুঁশিয়ারি ছাত্রদলের 

খালেদা জিয়াকে হয়রানিতে দুদকের সাবেক ৩ চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে মামলা

৯ জিম্মির বিনিময়ে ২ মাসের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের

পাওনা টাকার জেরে হত্যা, চাঁপাইনবাবগঞ্জে একজনের যাবজ্জীবন

টানা দরপতনে বিনিয়োগকারীদের ‘কফিন মিছিল’

ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হলো নুসরাত ফারিয়াকে 

‘আমি যে তাদের স্বার্থপর ছেলে’ লিখে যুবকের আত্মহত্যা

ইসরায়েলকে এআই সেবা দেওয়ার কথা স্বীকার মাইক্রোসফটের

খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন অলি আহমদ

ফার্ম কর্মচারীকে জবাই করে হত্যা

১০

হবিগঞ্জে যাত্রীবাহী বাস খাদে পড়ে আহত ২০

১১

খুবিতে হত্যাচেষ্টা মামলা নিয়ে বিতর্ক, রিমান্ড নামঞ্জুর

১২

ইউআইইউ’র টেলিকম ও আইসিটি অ্যাওয়ার্ড ২০২৫ অর্জন

১৩

রাতে দিল্লির ম্যাচে কি দেখা যাবে মোস্তাফিজকে?

১৪

সংঘাত নয়, শান্তিই পাকিস্তানের অগ্রাধিকার : আইএসপিআর

১৫

গৌরবের বদলে গ্লানির গল্প: ম্যানসিটির ভুলে যাওয়ার মতো মৌসুম

১৬

জবি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে পুলিশি হামলা, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ

১৭

বিচারককে হেনস্তা : বিএনপিপন্থি চার আইনজীবীকে শোকজ

১৮

২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার এডিপি অনুমোদন

১৯

ভারতের ওপর আকাশপথে নিষেধাজ্ঞা বাড়াল পাকিস্তান

২০
X