হাসপাতালে রোগীদের ব্যবহৃত পানির বেশিরভাগই ফেলা হয় নদীতে। এই পানিতে থাকে বিভিন্ন ধরনের জীবন বিধ্বংসী ব্যাকটেরিয়া। পরবর্তীতে নদীর পানি ওয়াসার মাধ্যমে পরিশোধিত হয়ে আমাদের বাসাবাড়িতে সরবরাহ করা হয়। যার ফলে বেড়ে যাচ্ছে স্বাস্থ্যের ঝুঁকি। এসব দূষিত পানি পরিপূর্ণভাবে পরিশুদ্ধ করতে ও স্বাস্থ্যঝুঁকি কমাতে নতুন এক প্রযুক্তি আবিষ্কার করতে যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন। ইতোমধ্যে এই বিষয়ে ল্যাব পরীক্ষা চালিয়ে সফল হয়েছেন তিনি।
জানা যায়, জাপানের এহিমে ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীরা ইউনিভার্সিটি অফ শিজুকার বিজ্ঞানীদের সঙ্গে যৌথ গবেষণার মাধ্যমে অক্সিডেশন ও অ্যাডভান্স অক্সিডেশন পদ্ধতি ডেভেলপ করে। পদ্ধতিগুলোর মাধ্যমে হাসপাতালে ব্যবহৃত পানি থেকে অ্যান্টিবায়োটিক, ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া এবং অ্যান্টিবায়োটিক রেসিসটেন্স জিন অপসারণ করতে পারে। সেই পদ্ধতিগুলো এখন জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) এবং জাপান সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি এজেন্সি (জেএসটি) প্রকল্পের মাধ্যমে বিভিন্ন হাসপাতালে পাইলটিং করে পদ্ধতিগুলোর কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হবে। সঙ্গে সঙ্গে পদ্ধতিগুলোর কার্যকারিতার ওপর ভিত্তি করে বাণিজ্যিকীকরণ করা হবে।
জেএসটি এবং জাইকার অর্থায়নে ঢাকা মহানগরে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সের স্বাস্থ্যঝুঁকি প্রশমনে পানির মান পর্যবেক্ষণ ও পরিশোধন প্রযুক্তি বাস্তবায়ন প্রকল্প নামে এই নতুন গবেষণা প্রকল্পের অনুমোদন পেয়েছেন অধ্যাপক আনোয়ার। প্রকল্পটির লক্ষ্য ঢাকায় পানির মান পর্যবেক্ষণ এবং পরিশোধন প্রযুক্তির প্রবর্তন এবং ঢাকা ওয়াটার এনভায়রনমেন্ট রিসার্চ সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা।
পাঁচ বছর মেয়াদি প্রকল্পের মোট বাজেট প্রায় ৫০০ মিলিয়ন জাপানি ইয়েন, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩০ কোটি খরচ হবে নতুন এই প্রযুক্তি উদ্ভাবনের পেছনে আর ২০ কোটি খরচ হবে বাংলাদেশ থেকে জাপানে যাওয়া একদল গবেষকের পেছনে। এই প্রকল্প ২০২৬ সালের এপ্রিলে শুরু হয়ে চলবে ২০৩১ সালের মার্চ পর্যন্ত। চলতি মাস থেকে ২০২৬ সালের মার্চ পর্যন্ত একটি প্রস্তুতিমূলক সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রকল্পটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং এহিমে বিশ্ববিদ্যালয় যৌথভাবে বাস্তবায়ন করবে, যেখানে বাংলাদেশের পরিবেশ অধিদপ্তর, জাপানের শিজুওকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইয়ামাগাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইনস্টিটিউট ফর গ্লোবাল এনভায়রনমেন্টাল স্ট্র্যাটেজিস সহযোগিতা করবে।
অধ্যাপক আনোয়ার জানান, প্রকল্পের ৫০ কোটি ইয়েন বাজেটের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি আধুনিক গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জাপানে বিভিন্ন গবেষণা সভা, কর্মশালা ও প্রোগ্রামে অংশগ্রহণের সুযোগ পাবেন। এছাড়া অন্তত পাঁচজন শিক্ষার্থী জাপানের এহিমে, শিজুওকা এবং ইয়ামাগাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করার সুযোগ পাবেন। যারা সেখানে গবেষণার পাশাপাশি প্রতি মাসে এক থেকে দেড় লাখ টাকা সম্মানী পাবেন।
২০১৯ সালে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (এএমআর)-এর কারণে সরাসরি ২৬ হাজার ২০০ এবং পরোক্ষভাবে প্রায় ৮৫ হাজার মানুষ মারা যান। এর কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে শুধু এশিয়াতে বছরে প্রায় ৪.৭ মিলিয়ন মানুষ মৃত্যুবরণ করতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ঢাকায় অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া ও জিনের স্বাস্থ্যঝুঁকি কমানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে নদী ও হাসপাতালের বর্জ্য পানির নিয়মিত মান পরীক্ষা এবং উন্নত পরিশোধন প্রযুক্তি প্রয়োগ করা হবে।
অধ্যাপক আনোয়ার বলেন, ঢাকায় প্রায় পাঁচ শতাধিক হাসপাতাল আছে। হাসপাতালে রোগীদের ব্যবহৃত পানির প্রায় ৯০ শতাংশই নদীতে ফেলা হয়। এই পানিতে রোগবাহিত ব্যাকটেরিয়া থাকে। পরবর্তীতে সেই পানি সিটি কর্পোরেশন আবার আমাদের খাওয়ার জন্য সরবরাহ করে। তারা এটিকে ফিল্টারিং করলেও ওই রোগবাহিত ব্যাকটেরিয়া দূর হয় না।
পরবর্তীতে এই পানি খাওয়ার দ্বারা ওই ব্যাকটেরিয়া আমাদের শরীরের প্রবেশ করে। আমরা চাচ্ছি হাসপাতালের ব্যবহার করা পানি থেকে জীবাণু দূর করার পরে সেটা নদীতে ফেলতে। তখন এই জীবাণু মানবদেহে প্রবেশ করার সম্ভাবনা কমে যাবে।
তিনি বলেন, এ বিষয়টি বাংলাদেশে নতুন। কিন্তু এটা জরুরিভিত্তিতে করতে হবে। কেননা এটি ক্যান্সারের চেয়েও মারাত্মক। এই ব্যাকটেরিয়াগুলো এন্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা কমিয়ে দিচ্ছে। আপাতত আমরা এই প্রজেক্টের কার্যক্রম ঢাকা মহানগর এলাকায় চালাব। আমাদের লক্ষ্য পরবর্তীতে এই প্রজেক্টের কার্যক্রম দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও বিস্তৃত করা।
এই বিষয়ে জাপান থেকে ডিগ্রিও নিয়েছেন অধ্যাপক আনোয়ার। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকবার ল্যাবে এর ওপরে পরীক্ষা চালিয়ে সফল হয়েছেন তিনি। এখন তার অর্জিত জ্ঞানকে বাস্তবে রূপ দিতে এই প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
প্রকল্পের আওতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত গবেষণা কেন্দ্রটি পরিবেশ অধিদপ্তরের সঙ্গে যৌথভাবে পরিচালিত হবে এবং এটি দেশে এএমআর সম্পর্কিত গবেষণার জাতীয় কেন্দ্র হিসেবে কাজ করবে। এছাড়াও এটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং সিডিসির মতো আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে সহযোগিতার সুযোগ তৈরি করবে বলে জানান অধ্যাপক আনোয়ার।
মন্তব্য করুন