রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) অ্যাপ্লাইড কেমিস্ট্রি অ্যান্ড কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে প্রভাষক পদে নিয়োগ পেলেন বাংলাদেশ জাসদ ছাত্রলীগের এক পদধারী নেতা। এদিকে আওয়ামী লীগের জোটভুক্ত জাসদ ছাত্রলীগের এ নেতার নিয়োগ পাওয়াকে কেন্দ্র করে ক্যাম্পাসে চলছে আলোচনা-সমালোচনা।
তবে কী বর্তমান প্রশাসন আওয়ামী লীগ জোটের পুনর্বাসন করছেন এমন অভিযোগ তুলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যৈষ্ঠ অধ্যাপক সমাজসহ জুলাই আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষক নিয়োগ পাওয়া ছাত্রলীগ নেতা হলেন নুরুজ্জামান শেখ। তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার জাসদ ছাত্রলীগের (ইনু গ্রুপ) সহসাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ২০২১ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা জাসদ ছাত্রলীগের সভাপতি আব্দুল মজিদ স্বাক্ষরিত কমিটির তালিকা থেকে এ তথ্য জানা যায়। তার বাসা চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার লাগাদ পাড়া গ্রামে। তার বাবার নাম রাব্বিল শেখ।
নুরুজ্জামান শেখের বড় ভাই নুরুল ইসলাম রাফি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা জাসদ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এর আগে তিনি শিবগঞ্জ উপজেলা জাসদ ছাত্রলীগের সভাপতিও ছিলেন। বর্তমানে তিনি জাসদ জেলা যুবজোটের সহসভাপতি। তার পুরো পরিবার ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ ও জাসদের (ইনু গ্রুপ) কট্টর সমর্থক বলে এলাকাবাসী নিশ্চিত করেছেন।
এদিকে নুরুজ্জামানের নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপি-জামায়াতপন্থী জ্যৈষ্ঠ অধ্যাপকরা। তারা বলছেন, আন্দোলনের পর জাসদ ছাত্রলীগের এমন পদধারী নেতার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া মানে আওয়ামী লীগসহ তাদের জোট দলগুলোকে আবারও পুনর্বাসন করা। এদের নিয়োগ দেওয়া মানে জুলাই আন্দোলনে নিহত হওয়া আবু সাঈদ ও মুগ্ধর মতো হাজারও শহীদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার শামিল।
যেখানে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে সেখানে নুরুজ্জামান শেখের চাকরি কীভাবে হয়? বাংলাদেশে কী মেধাবী শিক্ষার্থী নেই? বর্তমান প্রশাসনের নিয়োগ কার্যক্রম নিয়ে আরও সতর্ক হওয়া উচিত বলে মনে করছেন তারা।
নুরুজ্জামান শেখের পরিবার জাসদের রাজনীতির সাথে জড়িত কিনা জানতে চাইলে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার পৌর বিএনপির সদস্য সচিব মতিউর রহমান নিখিল বিশ্বাস বলেন, তার পুরো পরিবার শুরু থেকেই জাসদের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তার বড় ভাই নুরুল ইসলাম রাফি জাসদ ছাত্রলীগের একজন বড় নেতা ছিলেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নুরুজ্জামান শেখ বলেন, আমি জাসদ ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত না। তবে আমার পরিবার জাসদের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত।
পদের বিষয়ে জানতে চাইলে নুরুজ্জামান বলেন, এ বিষয়ে আমার কিছুই জানা নেই। কেউ আমার নাম কমিটিতে দিলেই তো আর আমি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, বিষয়টি এমন না।
এদিকে নুরুজ্জামান শেখের প্রতিবেদন না পাঠাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরামের এক সদস্য প্রতিবেদককে ফোন দিয়ে নিষেধ করেন এবং ওই শিক্ষকের রেফারেন্সেই নুরুজ্জামান শেখ বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পেয়েছেন বলে জানা যায়। নুরুজ্জামান শেখের আসল পরিচয় গোপন রেখে তাকে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এমনটাই দেখিয়েছেন সেই শিক্ষক। ওই শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলার আড়াই মিনিটের একটি অডিও রেকর্ড প্রতিবেদকের হাতে এসেছে।
এমন নিয়োগ বিপ্লব ও শহীদদের রক্তের সাথে স্পষ্ট বেঈমানী করার শামিল এমনটাই জানান রাবির সাবেক সমন্বয়ক ফাহিম রেজা।
তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ একটি সন্ত্রাসী সংগঠন আর এদের সহযোগী ছিল ১৪টি দল। বিপ্লব পরবর্তী সময়ে প্রশাসন সন্ত্রাসীদের একজনকে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। যে বা যারা ফ্যাসিবাদ বিরোধী শক্তি হয়েও ফ্যাসিবাদ পূনর্বাসনের কাজ করে যাচ্ছে তাদের পূর্ববর্তী ১৫ বছরের কথা মনে করিয়ে দিতে চাই। সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে বলতে চাই ফ্যাসিবাদ বিরোধীদের মাঝে যোগ্য কাউকে খুঁজে না পেলে নিয়োগ দেওয়ার দরকার নেই। শিক্ষক নিয়োগে আওয়ামী ফ্যাসিবাদী ও তাদের দোসরদের পুনর্বাসন করলে শিক্ষার্থীরা জবাব দিতে বাধ্য হবে।
এ নিয়োগের প্রতিবাদ জানিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সমন্বয়ক সালাউদ্দিন আম্মার বলেন, ‘গত জুলাইয়ের আগে আমাদের দেখানো হতো একাত্তরের চেতনা, আর এখন দেখানো হয় জুলাইয়ের চেতনা। শুধু বদলেছে কলাকৌশল কিন্তু সেই আগের মতোই রয়েছে চেতনার ব্যবসা। বাস্তবতা হলো, চেতনাধারীদের হাতেই এখন চলছে নিয়োগ বাণিজ্যের নির্লজ্জ পুনরাবৃত্তি। একটা সময় রাবিতে চাকরি পেতে হলে পিএইচডি পরিবর্তে পছন্দনীয় ও দলীয় পরিচয় থাকতে হতো। এখনও সেটাই আছে শুধু নামটা বদলেছে।’
তিনি বলেন, ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগের ইতিহাস মানেই যোগ্য প্রার্থীদের বাদ দিয়ে চাটুকারদের সুযোগ দেওয়া। ভর্তি ও শিক্ষক নিয়োগ বোর্ডে স্বচ্ছতার তোয়াক্কা না করে নিজেদের লোককে বসিয়ে ভবিষ্যৎ দখলের ভিত গড়া। আজকের প্রশাসনও ব্যতিক্রম নয়। বরং তারা আরও বেশি আত্মতুষ্ট, আরও কম দায়বদ্ধ।’
নিয়োগ নিয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সালেহ্ হাসান নকীব কালবেলাকে বলেন, ‘আমার কাছে এ ধরনের কোনো ইনফরমেশন আসেনি। আমি একেবারেই এ বিষয়ে অবগত নই। তার একাডেমিক পারফরমেন্স এবং কতটুকু বুঝে এসব বিবেচনা করেই তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সুপারিশ তো অনেকেই করে তবে বিএনপি- জামায়াত পরিচয়ের চর্চা আমি করি না। নিষিদ্ধ সংগঠন বা সুস্পষ্ট অপরাধের প্রমাণ যদি থাকে তখন সেটা আমরা অন্যভাবে দেখব। নুরুজ্জামান শেখ যদি সেরকম কোনো অপরাধের সঙ্গে যুক্ত থাকে বা প্রমাণ থাকে তখন সেটা আমরা আমলে নেব।’
মন্তব্য করুন