দীর্ঘ ৩৫ বছর পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ভোটার তালিকা প্রকাশ ও মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় শেষ হয়েছে। কেন্দ্রীয় সংসদে প্রার্থী হয়েছেন মোট ৩২০ জন। এর মধ্যে ভাইস প্রেসিডেন্ট (ভিপি) পদে লড়বেন ১৮ জন। ঘোষিত ১১টি প্যানেলের মধ্যে ১০টিতে ভিপি প্রার্থী রয়েছে, একটিতে নেই ভিপি ও জিএস পদপ্রার্থী।
প্রার্থীদের তালিকা চূড়ান্ত হওয়ার পর থেকে ক্যাম্পাসজুড়ে নির্বাচনী আমেজ বিরাজ করছে। আবাসিক হল, একাডেমিক ভবন কিংবা আড্ডাস্থল— সবখানেই আলোচনার মূল বিষয় রাকসু নির্বাচন। প্রার্থীদের ভাবমূর্তি, অভিজ্ঞতা ও কার্যক্রম নিয়ে শিক্ষার্থীরা নানা বিশ্লেষণ করছেন। জুলাই অভ্যুত্থানে প্রার্থীদের ভূমিকা নিয়েও চলছে আলোচনা।
নির্বাচনী প্রচারণায় প্রার্থীরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কুশল বিনিময়ের পাশাপাশি ছুড়ছেন প্রতিশ্রুতির ফুলঝুড়ি। ক্লাস-পরীক্ষার অনিয়ম দূরীকরণ, র্যাগিং প্রতিরোধ, লাইব্রেরিতে পর্যাপ্ত আসনসংখ্যা নিশ্চিতকরণ, হলে গরমকালে পানির সংকট সমাধান কিংবা মশার উৎপাত নিয়ন্ত্রণ— সব সমস্যার সমাধানের আশ্বাস দিচ্ছেন তারা।
ঘোষিত প্যানেলগুলোর মধ্যে বর্তমানে সবচেয়ে আলোচনায় থাকা ভিপি প্রার্থীরা হলেন ছাত্রদল সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ নতুন প্রজন্ম প্যানেলের শেখ নূর উদ্দিন আবীর, শিবির সমর্থিত ‘সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেলের মোস্তাকুর রহমান জাহিদ, ‘আধিপত্যবিরোধী ঐক্য’ প্যানেলের মেহেদী সজীব, বামপন্থী ছয় সংগঠনের ‘গণতান্ত্রিক শিক্ষার্থী পর্ষদ’ এর ফুয়াদ রাতুল, ‘রাকসু ফর র্যাডিক্যাল চেঞ্জ’ প্যানেলের মেহেদী মারুফ এবং রাবির ইতিহাসে প্রথম নারী ভিপি প্রার্থী হিসেবে ‘সর্বজনীন শিক্ষার্থী সংসদ’ প্যানেলের তাসিন খান।
ছাত্রদল প্যানেলের ভিপি প্রার্থী শেখ নূর উদ্দিন আবীর ২০২৩ সালে ছাত্রলীগের (বর্তমানে নিষিদ্ধ) হামলার শিকার হয়েছিলেন। আবীর বলেন, আমরা দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার লড়াই করেছি। এবারও শিক্ষার্থীদের কণ্ঠস্বর হয়ে কাজ করব। শিক্ষা, বাসস্থান, খাদ্য, চিকিৎসা ও নারীদের সাইবার নিরাপত্তা আমাদের প্রধান অগ্রাধিকার। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে শিক্ষার্থীদের রায় আমরা মাথা পেতে নেব।
শিবির সমর্থিত প্যানেলের ভিপি প্রার্থী মোস্তাকুর রহমান জাহিদ বলেন, আমাদের প্যানেল সম্পূর্ণ অন্তর্ভুক্তিমূলক। নারী শিক্ষার্থী, সাংস্কৃতিক কর্মী, সংখ্যালঘু, আহত জুলাইযোদ্ধা— সবাই আমাদের দলে রয়েছে। আমি নির্বাচিত হলে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান— সবার ভিপি হবো। শিবিরকে ঘিরে যে মিথ প্রচলিত ছিল, তা ভেঙে গেছে। এবার শিক্ষার্থীরাই আমাদের প্রতি আস্থা প্রকাশ করবেন।
আধিপত্যবিরোধী ঐক্য প্যানেলের ভিপি প্রার্থী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক মেহেদী সজীব বলেন, আমাদের প্যানেল শেষ মুহূর্তে গঠিত হলেও আমরা তিনজন শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সক্রিয় থেকেছি। জুলাইয়ের আগেও আমরা নানা দাবি নিয়ে আন্দোলন করেছি। নারী শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন। কেউ আমাদের অন্য দলের ছায়া বললেও, আমাদের ভোট শিক্ষার্থীদের সচেতন ম্যান্ডেটেই হবে। আমি শতভাগ আশাবাদী।
বামপন্থী ছয় সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত গণতান্ত্রিক শিক্ষার্থী পর্ষদ প্যানেলের ভিপি প্রার্থী সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের আহ্বায়ক ফুয়াদ রাতুল বলেন, নিরাপত্তাহীনতার কারণে অনেক গণতান্ত্রিক ও বামধারার শিক্ষার্থী প্যানেলে আসতে সাহস পাননি। ক্যাম্পাসে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে সংকুচিত হয়েছে, সাইবার বুলিং শিক্ষার্থীদের ভয় পাইয়ে দিয়েছে। আমাদের অর্থ নেই, আতর বিতরণ বা বিরিয়ানি পার্টি করার সামর্থ্যও নেই। তবে আমাদের শক্তি হলো দীর্ঘদিনের আন্দোলন ও শিক্ষার্থীদের পাশে থাকার অভিজ্ঞতা। আমরা বিশ্বাস করি, মতাদর্শের পার্থক্য থাকলেও সংলাপ ও শিক্ষার্থীদের অধিকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
রাকসু ফর র্যাডিক্যাল চেঞ্জ প্যানেলের ভিপি প্রার্থী মেহেদী মারুফ বলেন, আমাদের লক্ষ্য মৌলিক পরিবর্তন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা-পরিবেশ অনুকূল নয়, বেকারত্ব চরম আকার ধারণ করেছে, শিক্ষক-শিক্ষার্থী দূরত্বও বাড়ছে। আমরা এমন একটি রাকসু গঠন করতে চাই যা শিক্ষার্থীদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করবে।
নারী ভিপি প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন সর্বজনীন শিক্ষার্থী সংসদ প্যানেলের তাসিন খান। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক তাসিন বলেন, ৫ আগস্টের পর থেকে আমি কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হইনি। আমরা ভেবেছিলাম জুলাই গণভ্যুথানের পর ছাত্ররাজনীতিতে বড় পরিবর্তন আসবে, কিন্তু দলীয় সংগঠনগুলো এখনো লাগামহীন। রাকসু সেই লাগাম টেনে ধরার সুযোগ। তাই আমি স্বতন্ত্রভাবে ভিপি পদে প্রার্থী হয়েছি।
তিনি আরও বরেন, শিক্ষা-পরিবেশ অনুকূল নয়, র্যাগিং, আবাসন সংকট, কাউন্সেলিং ও স্বাস্থ্যসেবার অভাব, নারীদের প্রান্তিক অবস্থা, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের অবহেলা— এসব সমস্যার সমাধানে আমি কাজ করতে চাই। আমার কণ্ঠস্বর কোনো মতাদর্শের নয়, ছাত্রসমাজের। আমি চাই একটি স্বতন্ত্র, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও দায়িত্বশীল রাকসু।
মন্তব্য করুন