যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজা শহর ছেড়ে চলে যেতে শুরু করেছেন ফিলিস্তিনিরা। ইসরায়েলের অব্যাহত হামলা, বোমা ও ক্ষুধার কাছে অবশেষে পরাজয় মানছেন তারা। নিজ ভূমিতে থাকার অধিকারের লড়াইয়ে ইতোমধ্যে লাখো মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। বাড়িঘর, সহায়-সম্পদ সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেছে। বোমার আঘাতে বিরাণভূমিতে পরিণত হয়েছে পুরো উপত্যকা।
জানা গেছে, মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) গাজা সিটিতে নতুন করে ব্যাপক অভিযান শুরু করেছে ইসরায়েল। এর আগে রাতভর গাজায় তীব্র বোমা হামলার খবর পাওয়া যায়। ফিলিস্তিনিরা গত রাতকে ‘নরক’ এবং জীবনের ‘সবচেয়ে কঠিন’ রাতের মধ্যে একটি হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
সংবাদমাধ্যম বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, নতুন করে ইসরায়েলি ট্যাংক প্রবেশের এর প্রভাব পড়েছে হাজার হাজার ফিলিস্তিনির ওপর, তারা এখন দক্ষিণ দিকে নিরাপদ স্থানের দিকে পিছু হটছেন। অনেকের জন্য এটি প্রথমবার নয়, তারা পূর্বেও যুদ্ধের কারণে স্থানান্তরিত হয়েছেন। তবে এবার আর অন্যদিকে নয়, অনেকে হার মেনে গাজা ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।
মানুষদের কেউ পায়ে হেঁটে, কেউ পুরোনো গাড়ি বা রিকশায়, কেউ গাধার গাড়িতে বোঝাই করে নিয়ে যাচ্ছেন সামান্য কিছু জিনিসপত্র। যাত্রাপথে দেখা যাচ্ছে শিশুদের কাঁদতে কাঁদতে মায়ের আঁচল আঁকড়ে ধরা। অনেকেই বলছেন, এই শহর ছেড়ে যাওয়া তাদের জীবনের সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত।
আল-রিমাল এলাকার বাসিন্দা ৩৩ বছরের আমজাদ আল-নাওয়াতি জানিয়েছেন, তার পরিবার যেকোনো সময় পালানোর জন্য প্রস্তুত। চারপাশের প্রতিবেশীরা ইতিমধ্যেই চলে গেছেন। তিনি বলেন, ‘আমার প্রতিবন্ধী ভাই আহমেদের ওপর বোমার শব্দ ভয়ঙ্কর প্রভাব ফেলছে। সারারাত তাকে শান্ত করতে হয়েছে।’
একইভাবে কাঠমিস্ত্রি এস্সাম শাওয়ার পরিবার গতরাতে ১২ ঘণ্টা হেঁটে দেইর আল-বালাহ পৌঁছেছেন। তাদের হাতে ছিল না কোনো বাড়তি পোশাক বা খাবার। তিনি বলেন, ‘আমরা কেবল বাঁচার জন্য ছুটেছি’। তার স্ত্রী আয়াত যোগ করেন, ‘যাত্রার সময় বাচ্চাদের জন্য কিছুই ছিল না। ক্ষুধা আর ক্লান্তিতে তারা পুরো পথ কেঁদেছে।’
অন্যদিকে, নার্স হানা আলমাধৌন হোয়াটসঅ্যাপে জানিয়েছেন, তিনি তার তিন সন্তানকে সরিয়ে নিতে চাইছেন। কিন্তু পরিবহন পাওয়া যাচ্ছে না, আর যেটুকু আছে তার ভাড়া এত বেশি যে সাধারণ মানুষের সাধ্যের বাইরে। একটি ট্রাক ভাড়া করতে প্রায় এক হাজার ডলার লাগছে। আমি কাজের কারণে থাকতে চাই, কিন্তু সন্তানদের আগে নিরাপদ স্থানে পাঠাতেই হবে, লিখেছেন তিনি।
৩৪ বছরের মোহাম্মদ বলেন, তার কর্মস্থলের পাশের ভবনগুলো একের পর এক ধসে পড়েছে। রাস্তায় লাশ ছড়িয়ে ছিল। আকাশ থেকে ফ্লায়ার ফেলে দক্ষিণে যেতে বলা হলে তিনিও যাত্রা শুরু করেন। তিনি বলেন, এটা আমার জীবনের দ্বিতীয়বার ঘর ছাড়ার অভিজ্ঞতা। বারবার এভাবে পালাতে হচ্ছে, এটা মানসিকভাবে ভীষণ কষ্টদায়ক।”
গাজা সিটির এই নতুন ইসরায়েলি স্থল অভিযান আবারও হাজারো পরিবারকে বাস্তুচ্যুত করেছে। নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের নিরাপত্তা এখন সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয়।
জাতিসংঘ সম্প্রতি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ তুলেছে। তবে গাজার মানুষের জন্য প্রতিটি দিন এখন অভিযোগ বা আলোচনার বাইরে এক নির্মম বাস্তবতা। তাদের প্রতিটি মুহূর্ত কাটছে ক্ষুধা, আতঙ্ক আর মৃত্যুর ভয়ে।
সূত্র : বিবিসি
মন্তব্য করুন