রাজশাহীর পবা উপজেলার বামনশিকড় গ্রামের কৃষক মিনারুল ইসলাম (৩৫) অনেক দিন ধরেই ঋণের বোঝা টানতে টানতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। সংসার চালাতে হিমশিম খাওয়া এই মানুষটির জীবনে নেমে আসে অমানিশা।
শেষমেশ দারিদ্র্য ও হতাশার অন্ধকারে তিনি এমন এক সিদ্ধান্ত নেন, যা কাঁপিয়ে দেয় পুরো দেশকে। গত ১৪ আগস্ট রাতে স্ত্রী মনিরা খাতুন (৩০), ছেলে মাহিম (১৪) ও কন্যাশিশু মিথিলাকে (৩) নৃশংসভাবে হত্যা করে নিজেও আত্মহত্যা করেন মিনারুল।
মৃত্যুর আগে তিনি একটি চিরকুট লিখে গিয়েছিলেন, ‘আমরা মরে গেলাম ঋণের দায়ে আর খাওয়ার অভাবে।’ এই কয়েকটি লাইন যেন তার অসহায় জীবনের এক নির্মম দলিল।
যে ঋণের দায়ে মিনারুলের এ আত্মহত্যা, এবার ফের সেই ‘ঋণ’ করেই মিনারুল ও তার স্ত্রী-সন্তানদের জন্য আয়োজন করা হলো চল্লিশা!
গত শনিবার (১৩ সেপ্টেম্বর) দুপুরে উপজেলার বামনশিকড় গ্রামের নিজ বাড়িতে এ চল্লিশার আয়োজন করে মিনারুলের পরিবার। আয়োজনে খরচ হয়েছে প্রায় এক লাখ টাকা। অথচ এই টাকার কোনো অংশই ছিল না পরিবারের হাতে, সবই ধারদেনা করে আনা হয়েছে।
এ ঘটনায় দেশজুড়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা চলছে। এবার ঘটনার বিষয়ে মুখ খুলেছেন প্রখ্যাত ইসলামি স্কলার শায়খ আহমাদুল্লাহও।
মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন, ‘ঋণের ভারে যিনি আত্মহত্যা করলেন, ঋণ করে তার চল্লিশা করা হলো। দ্বীনি শিক্ষার অভাব এবং দীন সম্পর্কে অজ্ঞতা যে কতটা নির্মম হতে পারে, এই ঘটনা থেকে তা আমরা নতুন করে উপলব্ধি করলাম। ইসলাম অত্যন্ত যৌক্তিক ও প্রাকৃতিক ধর্ম। ইসলাম যতগুলো আর্থিক ইবাদত আবশ্যক করেছে, সবই সামর্থ্যবানদের জন্য। কিন্তু ইসলামের ভেতর চল্লিশা নামের যে কুসংস্কার আমরা ঢুকিয়েছি, অনেক এলাকায় সেটা সবার ওপর আবশ্যক। এমনকি ঋণ কিংবা জমি বিক্রি করে হলেও তা পালন করতে হয়।’
তিনি লিখেছেন, ‘অন্যান্য দলিল-প্রমাণ একপাশে সরিয়ে রেখে শুধু এটুকু দেখেই চল্লিশার অযৌক্তিকতা ও অন্তঃসারশূন্যতা উপলব্ধি করা যায়। আল্লাহ-প্রদত্ত বিধান আর মানুষের তৈরি নিয়মের মৌলিক পার্থক্য এখানেই। লোকটি ঋণে জর্জরিত হয়ে মারা গেছেন। আর আজকাল সুদবিহীন ঋণ সোনার হরিণে পরিণত হয়েছে। অভিশপ্ত সুদ কীভাবে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে দরিদ্রকে আরো নিঃস্ব বানাচ্ছে আর সুদি মহাজনদের বানাচ্ছে আরো বিত্তশালী, আলোচ্য ঘটনা তার একটি উদাহরণ।’
আহমাদুল্লাহ আরও লেখেন, ‘ঋণের ছোবলে জীবনের ওপর কতটা অন্ধকার নামলে কোনো মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে পারে—আপনাদের কাছে প্রশ্ন রেখে গেলাম। এই জাতীয় ঘটনা দুদিন পরপর ঘটে আর আমাদেরকে চোখে আঙুল দিয়ে বলে যায়, দীনের চর্চা এবং ইসলামি অনুশাসন ও মূল্যবোধ ছাড়া প্রকৃত সুখের ঠিকানা আমরা কোনোদিন খুঁজে পাব না।’
পোস্টটির মন্তব্যঘরে চল্লিশা খাওয়া লোকদের প্রতি প্রশ্ন রেখে তিনি আরও লিখেছেন, ‘আত্মীয়-স্বজনের উচিত ছিল নিজেরা টাকা তুলে লোকটার ঋণ পরিশোধ করবে। সেটা তো করেইনি, উল্টো মৃতের পরিবারকে চাপে ফেলে ঋণ করে হলেও চল্লিশা করতে বাধ্য করেছে। ঋণে জর্জরিত ওই মানুষটির চল্লিশা যারা খেলেন, খাবার কীভাবে তাদের পেটে নামল, ভেবে বিস্মিত হচ্ছি।’
মন্তব্য করুন