শনিবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ১৯ আশ্বিন ১৪৩২
জাবি প্রতিনিধি
প্রকাশ : ০৩ জুন ২০২৪, ১১:০৬ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণে হুমকির মুখে জাবির পরিবেশ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গাছ কেটে বন উজাড়। ছবি : কালবেলা
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গাছ কেটে বন উজাড়। ছবি : কালবেলা

নৈসর্গিক সবুজ আর পাখির কলতানে মুখরিত ক্যাম্পাস হিসেবে সবার কাছে পরিচিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু মাস্টারপ্ল্যান ছাড়াই একের পর এক ভবন নির্মাণে বর্তমানে তা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। একটা সময়ে গাছ কাটার প্রতিবাদ করা শিক্ষকদের বেশিরভাগই এখন বন উজাড় করে ভবন নির্মাণের সহযোগী।

‘মাস্টারপ্ল্যান দাও, জাহাঙ্গীরনগর বাঁচাও’ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র সংগঠনগুলোও বিভক্ত হয়ে আছে। এতে একাধিক বন উজাড় করে ও লেক ভরাট করে ভবন নির্মাণ করলেও কার্যত কোনো বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বক্তব্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন’ প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) পাস হওয়ার মাধ্যমে এ পরিস্থিতি শুরু হয়। সে সময় মাস্টারপ্ল্যান না থাকায় পরিবেশবাদী সংগঠন ও সচেতন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা জোরালো আন্দোলন ও প্রতিবাদ গড়ে তুললেও তা উপেক্ষা করে প্রশাসন প্রকল্পে ১ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ২১টি অবকাঠামো নির্মাণ শুরু করে। চলমান এ প্রকল্প ছাড়াও ভারত এবং বাংলাদেশের যৌথ অনুদানের মোট ৯৭ কোটি ৮৯ লাখ ১৭ হাজার টাকা ব্যয়ে চারুকলা অনুষদ এবং ইনস্টিটিউট অব বিজনেস এডমিন্সট্রেশনের নিজস্ব অর্থায়নে ভবন নির্মাণে গত পাঁচ বছরে প্রায় তিন হাজার গাছ কাটা হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃক্ষরোপণ ও গাছ কাটার বিষয়টি দেখভাল করেন রেজিস্ট্রার অফিসের এস্টেট শাখা। এ অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১৩৫০টি গাছ কাটা হয়েছে। যার মধ্যে রোববার (২ জুন) এক দিনেই গাছ কাটা হয়েছে প্রায় ২০০টি। তবে ২০২২ সালে গাছ কাটার সংখ্যা জানা যায়নি। এর বিপরীতে গত ছয় বছরে বৃক্ষরোপণ করা হয়েছে প্রায় ২৩৫০টি। ২০২৪ সালে এখনো বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি হাতে নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তবে কোথায় কোথায় গাছ লাগানো হয়েছে এই প্রশ্নের কোনো সুস্পষ্ট জবাব দিতে পারেনি কর্তৃপক্ষ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সূত্রে জানা যায়, এস্টেট শাখায় সংরক্ষিত বৃক্ষ নিধনের সংখ্যার তুলনায় গাছ কাটা হয়েছে দিগুণেরও বেশি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যে গাছগুলো বিক্রি করে থাকে, শুধু সেগুলোর হিসাবই সংরক্ষণ করা হয়। এর বাইরেও অনেক গাছ কাটা হয়। কর্তৃপক্ষের কাছে হিসাব আসার আগেই সেগুলো বিক্রি হয়ে যায়। অপরদিকে বৃক্ষরোপণ শুধু খাতা-কলমেই হয়েছে। যেসব বৃক্ষ রোপণ করা হয় সেসবেরও কোনো পরিচর্যা করা হয় না। ফলে তা মোট বনায়ন বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে না।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ধীরে ধীরে গাছপালা ও জলাশয় কমে যাওয়ার প্রতিফলন ঘটেছে সম্প্রতি প্রকাশিত হওয়া এক গবেষণাতেও। ‘বাংলাদেশ জার্নাল অব এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ’-এ প্রকাশিত এ গবেষণাপত্রে দেখা যায়, ১৯৮৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত গত ৩৫ বছরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) গাছপালা ও জলাশয় কমেছে ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ, অন্যদিকে নির্মাণকৃত ভবনের সংখ্যা বেড়েছে ১৫৯ দশমিক ৩ শতাংশ।

স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহের ইমেজ বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়, ১৯৮৮ সালে জলাশয়ের পরিমাণ ছিল ১২২ দশমিক শূন্য ৪ একর, যা পর্যায়ক্রমে ১৯৯৮ সালে ৮১ দশমিক ৮১, ২০০৮ সালে ১১৫ দশমিক ৮২, ২০১৮ সালে ৮৭ দশমিক ৫৯ ও ২০২৩ সালে ৭৩ দশমিক ৫৮ একরে দাঁড়িয়েছে। এক্ষেত্রে ক্রমাবনতি হলেও ২০০৮ সালে জলাশয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে। তবে সার্বিকভাবে জলাশয়ের পরিমাণ কমেছে প্রায় ৩৯ দশমিক ৭ শতাংশ। ১৯৮৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গাছপালা ছিল ৩৮৮ দশমিক ৮০ একর জায়গাজুড়ে, যা ১৯৯৮ সালে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৪৫৪ দশমিক ৬০ একরে। তবে পরবর্তী বছরগুলোয় তা কমে ২০২৩ সালে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ২৮৫ দশমিক ৮৮ একরে। সব মিলিয়ে এ হ্রাসের পরিমাণ ১৬৮ দশমিক ৭ একর, যা প্রায় ৩৭ শতাংশ।

এদিকে ২০২৪ সালে বৃক্ষ কর্তন ও ভবন নিমার্ণের হার পূর্বের বছরের তুলনায় জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ফাঁকা জায়গা রেখে জঙ্গল, জলাশয়, অতিথি পাখির আবাসস্থলে ভবন নির্মাণ করছে প্রশাসন।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃক্ষ ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য এবং পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আমির হোসেন ভূঁইয়া বলেন, ২০১৯ সালে বৃক্ষ ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা হলেও এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বৃক্ষ ব্যবস্থাপনা এবং পরিকল্পিত বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি গ্রহণ করেনি আর আমাদের কাছেও কখনো পরামর্শ নেয়নি। উন্নয়ন প্রকল্পের নামে যখন অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণের জন্য গাছ কাটতে হয় তখন আমাদের ডাকা হয়। তবে সবসময় নয়। যখন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের তীব্র আন্দোলন ও প্রতিবাদের মুখে পড়ে তখন বৃক্ষ ব্যবস্থাপনা কমিটিকে আলোচনায় রাখা হয়। তবে বেশ কয়েকবার ভবন নির্মাণে গাছ কাটার জন্য আমাদের কোনো পরামর্শ নেওয়া হয়নি।

ছাত্র ইউনিয়ন জাবি সংসদের একাংশের সভাপতি আলিফ মাহমুদ বলেন, অর্থলিপ্সু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যত্রতত্র অযাচিত ভবন নির্মাণের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। বন উজাড় করে গুটিকয়েক বৃক্ষরোপণে পরিবেশের ক্ষতি পোষানো যাবে না। শিক্ষার্থীরা মাঝে মাঝে যা গাছ রোপণ করে তাই থেকে যাচ্ছে। অতি অল্প যে স্থলভূমি রয়েছে তা সংরক্ষণের নেই কোনো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। ফলে কিছুদিন আগেও নির্মল জাবি দিন দিন তপ্ত ভূমিতে রূপান্তরিত হচ্ছে।

অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক মো. নাসির উদ্দিন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুতে এখানে কোনো গাছ ছিল না। পরবর্তীতে বৃক্ষ রোপণের মাধ্যমে বনায়ন তৈরি করা হয়েছে। ভবন নির্মাণের জন্য বর্তমানে যে গাছ কাটা হচ্ছে, বৃক্ষ রোপণের মাধ্যমে আমরা সে ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করব।

এ বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক নূরুল আলমের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

কুয়েতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য সুখবর

ফের জামায়াতের সমালোচনা করলেন হেফাজত আমির

জবি ক্যাম্পাসে ছাত্রদল নেতা হাসিবুলের প্রথম জানাজা সম্পন্ন

গণতন্ত্রে উত্তরণে বিশ্বের সমর্থন পাওয়া গেছে : মির্জা ফখরুল

আমরা পা ছেড়ে মাথার রগে ফোকাস করছি, মজার ছলে সর্ব মিত্র

নাটকীয় ম্যাচ জিতে টাইগারদের সিরিজ জয়

জবি ছাত্রদল নেতার মৃত্যুতে হাসপাতালে ভিপি সাদিক কায়েম

হঠাৎ খিঁচুনিতে জবি ছাত্রদল নেতার মৃত্যু

আবারও ইনজুরিতে ইয়ামাল

ঈদগাহের নামকরণ নিয়ে দ্বন্দ্ব, দুই গ্রামবাসীর সংঘর্ষ

১০

খুলনায় ছেলের হাতে বাবা খুন

১১

চাকসু নির্বাচন / ১৫ সেকেন্ডে দিতে হবে ১ ভোট

১২

‘ভোটের অধিকার না থাকায় শ্রমজীবীরা বেশি অমর্যাদার শিকার’

১৩

এক গ্রামে ১১ জনের শরীরে মিলল অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ

১৪

থানায় জিডি করলেন সালাউদ্দিন টুকু

১৫

সংস্কৃতির ভেতরেই রাজনীতির সৃজনশীলতা নিহিত : দুদু

১৬

সাইফের চোখ বাঁচাতে প্রয়োজন ৩০ লাখ টাকা

১৭

সিরিজ জিততে বাংলাদেশের দরকার ১৪৮ রান

১৮

জাতিসংঘে ড. ইউনূসের সফর গণতন্ত্র ও মানবিক সংহতির বার্তা : প্রেস সচিব

১৯

বিরক্ত মেহজাবীন চৌধুরী

২০
X