ঢাকা শহরের তরুণদের জীবন, বন্ধুত্ব, প্রেম, হাসি-কান্না আর টিকে থাকার লড়াই— সবকিছু মিলিয়ে এক অনন্য গল্পের জন্ম দেয় ‘ব্যাচেলর পয়েন্ট’। মফস্বল থেকে শহরে এসে গড়ে ওঠা তরুণদের দৈনন্দিন বাস্তবতা ও মজার কাহিনি নিয়ে নির্মিত এই ধারাবাহিক নাটক এখন তরুণ প্রজন্মের কাছে শুধু বিনোদন নয়, হয়ে উঠেছে এক প্রজন্মের প্রতিচ্ছবি।
২০১৭ সালে যাত্রা শুরু করা এই সিরিজ এখন পর্যন্ত পাঁচটি মৌসুমে পা দিয়েছে। আট বছর ধরে চলমান ‘ব্যাচেলর পয়েন্ট’ এ সময়ের সবচেয়ে আলোচিত ধারাবাহিক নাটকগুলোর একটি। এর জনপ্রিয়তা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, নতুন সিজনের দাবিতে দর্শকরা টেলিভিশন চ্যানেলের সামনে মানববন্ধন করেছেন, সামাজিক মাধ্যমে হয়েছে আলোচনার ঝড়, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও মিছিল করতে দেখা যায়।
শুরুটা কেমন ছিল
পরিচালক কাজল আরেফিন অমি বলেন, ‘সময়টা ২০১৭। তখন এমন একটা সময় চলছিল, যখন পরিচালকদের টিকে থাকতে হলে সিরিয়াল করা ছাড়া পথ ছিল না। আমিও তখন এমন এক সংকটে ছিলাম যে, হয় সিরিয়াল করব, না হয় এই পেশা ছেড়ে দেব।’
তিনি আরও বলেন, ‘সেই সময়ে অনেকেই বিদেশে গিয়ে নাটক করছিলেন। কিন্তু আমি ভেবেছিলাম, আমি তো ঢাকার ছেলে— এই শহরের, এই দেশের গল্পই বলতে চাই। তাই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম।’
অবশেষে প্রযোজক সৈয়দ ইরফান উল্লাহর সহযোগিতায় অমি পেয়ে যান বেসরকারি টিভি চ্যানেল নাইনে একটি সিরিজ করার সুযোগ। বাজেট ও প্রচার সময় ঠিক হয়, কিন্তু গল্প তখনো চূড়ান্ত নয়।
অমির ভাষায়, “বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ব্যাচেলর বন্ধুদের বাসায় গিয়ে তাদের জীবন দেখতাম। সেখান থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে ‘ব্যাচেলর পয়েন্ট’-এর গল্প তৈরি করি।”
শুরুতে ১০৪ পর্ব করার পরিকল্পনা থাকলেও বিভিন্ন জটিলতায় সিরিজটি ৫৩ পর্বেই থেমে যায়। তবে সেই অল্প সময়েই নাটকটি দর্শকদের মনে দাগ কাটে।
দর্শকের মানববন্ধন ও মিছিল
২০১৮ সালে ৫৩ পর্ব শেষে নাটকটি বন্ধ হয়ে গেলে তরুণদের মধ্যে শুরু হয় তীব্র প্রতিক্রিয়া। তখনো সামাজিক মাধ্যমে ‘ভাইরাল’ শব্দটি খুব পরিচিত না হলেও, নাটকটি ঘিরে দেশজুড়ে তরুণদের মধ্যে সৃষ্টি হয় আলোড়ন।
ঢাকার বাইরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ব্যাচেলর পয়েন্ট আবার ফিরিয়ে আনতে হবে’ দাবিতে মানববন্ধন হয়। পুরান ঢাকার একদল তরুণ ফেসবুকে ‘ব্যাচেলর পয়েন্ট’ নামে একটি গ্রুপ খুলে নাটকটি ফিরিয়ে আনার আন্দোলন শুরু করেন। পরে একদিন তারা ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে চ্যানেল নাইন অফিসের সামনে মানববন্ধনও করেন।
চ্যানেল নাইনের তৎকালীন অনুষ্ঠানপ্রধান তানভীর খান বলেন, ‘৫৩ পর্ব শেষে সিরিজটি বন্ধ হয়ে গেলে দর্শকরা এসে আমাদের অফিসের সামনে মানববন্ধন করেন। এটা খুব ইতিবাচক একটা ঘটনা ছিল। তাদের দাবি ছিল, নাটকটি আবার চালু করা হোক।’
তিনি আরও বলেন, ‘‘তখনই বুঝতে পারি মানুষ শর্ট এবং ‘র’ কনটেন্ট বেশি পছন্দ করছে। সাজানো-গোছানো স্ক্রিপ্টের চেয়ে বাস্তবধর্মী, তরুণদের গল্পের কনটেন্টই বেশি গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। ব্যাচেলর পয়েন্টে এগুলো সবই ছিল।’’
পরে সিরিজটির পরবর্তী সিজনগুলো প্রচার হয় বাংলাভিশন ও ধ্রুব টিভি ইউটিউব চ্যানেলে।
ধ্রুব টিভির কর্ণধার ধ্রুব গুহ বলেন, ‘‘১৮ থেকে ৩৫ বছরের তরুণরাই মূল দর্শক। তারা ‘ব্যাচেলর পয়েন্ট’ দেখার সময় সব চিন্তা ভুলে গিয়ে আনন্দ পান। এটাই সিরিজটির আসল সাফল্য।’’
সহকারী থেকে জনপ্রিয় অভিনেতা
‘ব্যাচেলর পয়েন্ট’-এর মাধ্যমে আলোচনায় আসেন অনেক তরুণ অভিনেতা। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত নাম জিয়াউল হক পলাশ (কাবিলা) এবং শিমুল শর্মা (শিমুল)। দুজনই প্রথমে ছিলেন পরিচালক অমির সহকারী।
অমি বলেন, ‘পলাশ মূলত সহকারী পরিচালক হিসেবে এসেছিল। তবে ছোট ছোট চরিত্রে ওর অভিনয় দেখে মনে হলো, বড় চরিত্রে নিলে ও দারুণ করবে। তাই ওকে কাবিলা চরিত্রে রাখি।’একইভাবে শিমুলও ছিলেন অমির সহকারী। তৃতীয় সিজন থেকে তিনি সিরিজে নিয়মিত মুখ হয়ে ওঠেন।
সমালোচনাও আছে
নাটকটির জনপ্রিয়তার পাশাপাশি এসেছে সমালোচনাও। অনেকেই অভিযোগ করেন, এখানে অশালীন সংলাপ বা আচরণ রয়েছে।
এ বিষয়ে প্রযোজক ধ্রুব গুহ বলেন, ‘নামই যেহেতু ব্যাচেলর পয়েন্ট, তাই গল্পে কিছু বিশৃঙ্খলা, হাসিঠাট্টা আসবেই। ব্যাচেলর জীবনের বাস্তবতাও তো এমনই।’
পরিচালক কাজল আরেফিন অমি বলেন, ‘২০১৭ থেকে ২০২৫ পর্যন্ত আমরা টানা দর্শক ধরে রাখতে পেরেছি, এর মানে কনটেন্টে কিছু না কিছু আছে। কেউ কেউ অশ্লীল বললেও আসলে কোনো এডাল্ট দৃশ্য নেই, এমনকি কোনো ছেলে-মেয়ের হাত ধরা দৃশ্যও নেই।’তবে ২০২২ সালে সিজন ৪–এর কিছু পর্ব ডাবল মিনিং সংলাপের কারণে ইউটিউব থেকে সরাতে হয় বলে জানা গেছে। তখন কিছু শিল্পী ফেসবুকে দুঃখ প্রকাশও করেন।
ওটিটিতে নতুন যুগে
বর্তমানে ‘ব্যাচেলর পয়েন্ট’-এর পঞ্চম সিজন প্রচারিত হচ্ছে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম বঙ্গ বিডিতে, যেখানে দর্শকদের অর্থ ব্যয় করে দেখতে হচ্ছে নাটকটি।
বঙ্গ বিডির চিফ কনটেন্ট অফিসার মুশফিকুর রহমান বলেন, ‘আমাদের প্রত্যাশার চেয়েও বেশি সাড়া পেয়েছি দর্শকদের কাছ থেকে।’
কেন এত জনপ্রিয়?
নাট্য ব্যক্তিত্ব তারিক আনাম খান মনে করেন, ‘পরিচালক অমি দর্শকের মনোভাব বুঝে গল্প সাজাতে পেরেছেন। এটাও এক ধরনের যোগ্যতা। কেউ কেউ সমালোচনা করেন, কিন্তু যদি খুব অশালীন হতো, দর্শক নিজেরাই তা গ্রহণ করত না।’
পরিচালক অমি জানান, প্রথম সিজনের প্রতি পর্বে বাজেট ছিল মাত্র ৫৫ হাজার টাকা। এখন তা বেড়ে ১২–১৩ গুণ হয়েছে। সঙ্গে বেড়েছে অভিনেতাদের পারিশ্রমিকও।
আর কত সিজন চলবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যতদিন দর্শক চাইবে, ততদিন ব্যাচেলর পয়েন্ট চলবে। তবে কোথায় ফুলস্টপ দেব, সেটা এখনো জানি না।’
সূত্র : বিবিসি বাংলা
মন্তব্য করুন