চট্টগ্রাম বন্দরে বিভিন্ন সেবায় অযৌক্তিক ও অতিরিক্ত ট্যারিফ আরোপের প্রতিবাদে চট্টগ্রাম বন্দর বন্ধ করে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে পোর্ট ইউজার্স ফোরাম। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে বর্ধিত ৪১ শতাংশ মাশুল ইস্যু আলোচনার মাধ্যমে সমাধান না করলে চট্টগ্রাম বন্দর বন্ধ করে দেওয়ার এ হুঁশিয়ারি দেন তারা।
অন্যদিকে আগামীকাল রোববার (১৯ অক্টোবর) থেকে চার ঘণ্টার কর্মবিরতি পালন করবে বলে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে চট্টগ্রাম সিএন্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনসহ দুটি সংগঠন।
শনিবার (১৮ অক্টোবর) দুপুরে চট্টগ্রাম নগরের টাইগারপাসস্থ নেভি কনভেনশন হলে এক প্রতিবাদ সভায় এ হুঁশিয়ারি দেয় পোর্ট ইউজার্স ফোরাম। সেখানে বন্দর ব্যবহারকারী বিভিন্ন সংগঠনের পাশাপাশি কয়েক হাজার পেশাজীবী সংগঠনের নেতাকর্মী যোগ দেন।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিদেশিদের সুবিধা দিতে এই বর্ধিত মাশুল কার্যকর করা হয়েছে। এর প্রভাব পড়বে পণ্যের দামে। শুধু চট্টগ্রাম নয়, সারা দেশের মানুষকে পণ্য কিনতে গুনতে হবে কয়েকগুণ বাড়তি টাকা, যা দেশের অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল করে তুলবে।
তবে বন্দর কর্তৃপক্ষের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ৪০ বছর পর বাস্তবভিত্তিক ট্যারিফ নির্ধারণ চট্টগ্রাম বন্দরে উন্নয়নের অগ্রযাত্রার সুফল।
সভায় পোর্ট ইউজার্স ফোরামের সভাপতি আমীর হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরে ৪১ শতাংশ মাশুল বৃদ্ধির পর আমরা পোর্ট ইউজার্স ফোরামের পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে একটি স্মারকলিপি প্রদান করি। যেখানে আমাদের দুটো পয়েন্ট ছিল। আপাতত ট্যারিফ স্থগিত করা এবং স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বসে যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত ট্যারিফ নির্ধারণ করা।
তিনি বলেন, আন-অফিসিয়ালি আমাদের জানানো হয়েছে— প্রধান উপদেষ্টা সনদ স্বাক্ষর নিয়ে ব্যস্ত আছেন, তাই তিনি এটাতে (ট্যারিফ) মনোযোগ দিতে পারেননি। এই কারণেই আমরা প্রতিবাদ সভা আহ্বান করেছি। এর উদ্দেশ্য— স্মরণ করিয়ে দেওয়া যে, এরপরে যদি ব্যস্ততা দেখিয়ে এটাতে (ট্যারিফ) মনোনিবেশ করা না হয় তাহলে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা বেশিদিন আর অপেক্ষা করবে না। একটা কর্মসূচি আমাদের অবশ্যই দিতে হবে।
নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করতে গিয়ে তিনি বলেন, সিএন্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশন আগামীকাল থেকে প্রতিদিন ৪ ঘণ্টা কর্মবিরতি পালন করবে। আমি নাম বলছি না, আরও দুটি অ্যাসোসিয়েশন একইভাবে কর্মবিরতি পালন করবে। আমরা আজকে সরকারকে আরও একটি স্মারকলিপি প্রদান করব। এক সপ্তাহের মধ্যে যদি ট্যারিফ ইস্যু সমাধান করা না হয়, তাহলে চট্টগ্রাম বন্দর বন্ধ করে দেওয়া হবে। এটা শুধুই চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের জন্য নয়, এটা সারা দেশের ব্যবসায়ীদের জন্য- সারা বাংলাদেশের জনগণের জন্য। কারণ এই টাকা কাটা যাবে সারা বাংলাদেশের মানুষের পকেট থেকে।
এলপিজি অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি আমিরুল হক বলেন, ‘দুর্ভাগ্যভাবে আমার জন্মটা মগের মুল্লুকে হয়েছে। ভেরি আনফরচুনেটলি যারা এখন এই ট্যারিফটা যারা করেছেন, তারা মনে করেছেন যে, মগের মুল্লুকের মানুষের ওপরে আমরা চাপিয়ে দিলাম। ওদের কোনো কথার কোনো দাম নেই। আমার ড্রাইভার যখন এখানে আসছে সে তো ফ্রি খাবে। ড্রাইভারকে কি পয়সা দিয়ে খেতে হবে? এটা কোন ধরনের কথা! ড্রাইভার পয়সা দেবে কেন বলেন না? এটা কোন সমাজে আছে, গাড়ি যখন যায় কর্ণফুলী ব্রিজ দিয়ে কিংবা কোনো ব্রিজ দিয়ে গাড়ির জন্য পয়সা নেই। ড্রাইভারের জন্য পয়সা আছে নাকি ভাই? গেট পাস কি ড্রাইভারের জন্য হতে পারে? এটা কি কোনো সভ্য সমাজে আছে?
তিনি আরও বলেন, একসময় গেট পাস ছিল ৫০ পয়সা। মনে আছে, কিনা মনে নেই। আমরা যারা পোর্টে ঢুকতাম গেট পাস ছিল ৫০ পয়সা। সেই ৫০ পয়সা ২৩০ টাকা করবেন। এ ধরনের কোনো অন্যায্য দাবি ৭০০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে ফোর টাইম, ফাইভ টাইম, সিক্স টাইম, সেভেন টাইম পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
বিজিএমইএ নেতা ও এশিয়ান গ্রুপের চেয়ারম্যান এমএ সালাম বলেন, ব্যবসায়ীরা সাধারণত প্রতিবাদ করে না। কিন্তু আমাদের বাধ্য হয়ে প্রতিবাদ করতে হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দর একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও কোনো আলাপ-আলোচনা ছাড়া ট্যারিফ বাড়ানো হয়েছে। আমেরিকার ট্যারিফ কমাতে আমাদের সরকার যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, সেই সরকার এটি কেমন দ্বিচারিতা করেছেন তা আমরা বুঝতে পারছি না।
বিজিএমইএর পরিচালক এসএম আবু তৈয়ব বলেন, আমরা প্রতিবাদ করার কথা নয়। কিন্তু প্রতি বছরে সব খরচ বাদ দিয়ে যে প্রতিষ্ঠান আড়াই থেকে তিন হাজার কোটি টাকা লাভ করে সেই প্রতিষ্ঠান তাদের স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে কোনো আলাপ না করে কীভাবে ট্যারিফ বাড়াতে পারে?
চট্টগ্রাম শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি পারভেজ সাত্তার বলেন, আমি যখন শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি তখন ডলারের মূল্য ছিল ৩১ টাকা। তখন থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের ট্যারিফ বাড়তে চেয়েছিল। আমরা কিন্তু এক টাকাও বাড়াতে দিইনি। বর্তমানে পোর্ট ইউজার্স ফোরামের নেতৃত্বে আছেন আমীর হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী। তিনি একজন ডায়নামিক লিডার। আমি আশা করছি, উনিও সফল হবেন।
চট্টগ্রাম সিএন্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এসএম সাইফুল আলম বলেন, হঠাৎ করে ট্যারিফ বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবহন শ্রমিকরা। কিন্তু এ ক্ষতি সামগ্রিকভাবে সারা দেশের মানুষের ওপর প্রভাব ফেলবে। তাই আমরা চাই, সরকার এই ট্যারিফের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসুক। নতুবা আমাদের কঠোর কর্মসূচি হাতে নিতে হবে।
বিজিএমইএর পরিচালক মো. সাইফুল্লাহ মনসুর বলেন, আমরা মনে করেছিলাম পটপরিবর্তনের পরে সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ব্যবসাবান্ধব একটা পরিবেশ আসবে। কিন্তু আমরা সেটা দেখতে পাচ্ছি না। অনলি বিকজ, আমাদের ব্যবসায়ীদের মধ্যে ইউনিটি না থাকার কারণে আজকের এই অবস্থা। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, কিছুদিন আগে প্রাইভেট আইসিডিগুলো তাদের আজ বৃদ্ধি করেছে। তারা তো সরকারের না, তারা আমাদের ব্যবসায়ীদের একটা অংশ। কারও সঙ্গে কথা বলা ছাড়াই বাফা, শিপিং সেক্টরগুলো তাদের চার্জ বাড়িয়েছে।
বারবিটার হাবিবুর রহমান বলেন, আমরা এই ব্যবসাটি চট্টগ্রাম থেকেই শুরু করেছিলাম। চট্টগ্রাম বন্দরের ট্যারিফ মোংলার ৪০% বেশি। এরপর যদি ট্যারিফ বাড়ে তাহলে অবস্থা খারাপ হবে। অলরেডি আমাদের ব্যবসা সেখানে শিফট করছি। এমনভাবে চললে চট্টগ্রাম থেকে ব্যবসা চলে যাবে।
অন্যদিকে প্রবেশমূল্য প্রায় পাঁচগুণ বাড়ানোর প্রতিবাদে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সব ধরনের আমদানি পণ্য পরিবহন একযোগে বন্ধ করে দিয়েছে পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো। এতে বন্দর থেকে আমদানি পণ্য বের হচ্ছে না, এমনকি রপ্তানি পণ্য প্রবেশেও ব্যাঘাত ঘটছে। স্বাভাবিক নিয়মে খালাস বন্ধ থাকায় বন্দরে প্রায় ৪৬ হাজার কনটেইনারের জট সৃষ্টি হয়েছে।
গত ১৪ অক্টোবর রাত ১২টা থেকে প্রবেশমূল্য বাড়ানোর সিদ্ধান্ত কার্যকরের পর গত ১৫ অক্টোবর থেকে পণ্য পরিবহন বন্ধ রেখে কর্মবিরতি চালিয়ে আসছিল চট্টগ্রাম ট্রেইলর মালিক সমিতি। এর সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে বন্দরের পণ্য পরিবহনে যুক্ত বিভিন্ন যানবাহনের মালিক-শ্রমিকদের মোট ১৮টি সংগঠন। তারা পণ্য পরিবহন মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ নামে একটি সম্মিলিত মোর্চা গড়ে তুলেছে।
শনিবার (১৮ অক্টোবর) সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে পণ্য পরিবহন মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ ঘোষণা দিয়েছে, যতক্ষণ পর্যন্ত সরকার কিংবা বন্দর কর্তৃপক্ষ তাদের সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে কোনো গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত না নেবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের ধর্মঘট চলবে। অর্থাৎ অনির্দিষ্টকালের জন্য চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য পরিবহন বন্ধ থাকবে।
নগরীর কদমতলীতে আন্তঃজিলা মালামাল পরিবহন সংস্থার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এ সংবাদ সম্মেলনে চট্টগ্রাম ট্রেইলর মালিক সমিতির সভাপতি মোর্শেদ হোসেন নিজামী, চট্টগ্রাম প্রাইম মুভার অনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ হোসেন, চট্টগ্রাম ট্রাক-কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ইউসুফ মজুমদার মানিক, চট্টগ্রাম জেলা প্রাইম মুভার ও ট্রেলার শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আবুল খায়েরসহ মোট ১৮টি সংগঠনের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছে, চট্টগ্রাম বন্দরে সম্প্রতি বিভিন্ন সেবা খাতে ৪১ শতাংশ মাশুল বৃদ্ধি কার্যকরের পর বন্দরে যানবাহন প্রবেশের গেট-ফি পাঁচগুণ বেড়ে গেছে। আগে পণ্য পরিবহনকারী প্রতিটি যানবাহনকে ৫৭ টাকা ৫০ পয়সা গেট-ফি দিতে হতো। এখন বাড়িয়ে ২৩০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর প্রতিবাদে মালিক-শ্রমিক সংগঠগুলো একমত হয়ে পণ্য খালাস বন্ধ রেখেছে।
চট্টগ্রাম প্রাইম মুভার অনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ হোসেন বলেন, ‘এই যে ৫৭ থেকে ২৩০ টাকা গেট-ফি হঠাৎ করে বাড়িয়ে দিল, এই টাকাটা কে দেবে? আগে তো এটা ড্রাইভার দিত। কারণ আমাদের এখানে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য যেখানে নিয়ে যাওয়া হতো, সেজন্য যে খরচ নির্ধারণ করা হতো, সেই খরচের মধ্যে এই টাকাটা যুক্ত ছিল। এখন ২৩০ টাকা করার ফলে মাসে ১৮০০ থেকে ২ হাজার টাকা খরচ বেড়েছে। কিন্তু এখন ড্রাইভাররা ঘোষণা দিয়েছেন, তারা কোনোভাবেই বাড়তি গেট-ফি দেবে না, এই টাকাটা মালিককে দিতে হবে। এটা তো আমাদের পক্ষে বহন করা কঠিন।’
চট্টগ্রাম ট্রাক-কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ইউসুফ মজুমদার মানিক বলেন, ‘আমরা পণ্য পরিবহনকারী ১৮টা সংগঠন আছি, আমাদের ফেডারেশন আছে। কারও সঙ্গে একবার কথা বলার প্রয়োজন বোধ করল না, হঠাৎ করে ৫৭ টাকা ৫০ পয়সা থেকে গেট-ফি হয়ে গেল ২৩০ টাকা। আমাদের পরিবহনের মালিকরা এতে ক্ষুব্ধ, শ্রমিকরা ক্ষুব্ধ, এমনকি ব্রোকাররাও বলছে এভাবে পণ্য পরিবহন করা সম্ভব নয়। সবাই আমাদের চাপ দিচ্ছে প্রতিবাদ করার জন্য। আমরা পণ্য পরিবহন বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছি।’
চট্টগ্রাম ট্রেইলর মালিক সমিতির সভাপতি মোর্শেদ হোসেন নিজামী বলেন, ‘আকস্মিক প্রবেশ-ফি বাড়ানোর প্রতিবাদে আমরা গত বুধবার থেকে কর্মবিরতি পালন করে আসছি। এখন আমাদের সঙ্গে সর্বস্তরের মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো একাত্মতা প্রকাশ করে তারাও ধর্মঘট শুরু করেছে। যতক্ষণ পর্যন্ত বন্দর কর্তৃপক্ষ কিংবা সরকার আমাদের সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে সুরাহা করবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের কর্মসূচি চলবে।’
উল্লেখ্য, ব্যবহারকারীদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই হুট করে চট্টগ্রাম বন্দরে ৪১ শতাংশ মাশুল বৃদ্ধির প্রতিবাদে ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে ব্যবসায়ী সমাজ। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উদাসীনতা বা আসকারার কারণে এমন প্রেক্ষাপট সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন তারা। যে কারণে চট্টগ্রাম বন্দরে যানবাহনের প্রবেশ ফি ইতোমধ্যে চার গুণ বাড়ানোর প্রতিবাদে নিজেদের কার্যক্রম বন্ধ করেছে চট্টগ্রামের প্রাইম মুভার মালিক ও শ্রমিকদের ১৮টি সংগঠন।
মন্তব্য করুন