গরম-আর্দ্র এই মৌসুমে অ্যাডিস মশার উৎপাত বাড়লেই দেশে বেড়ে যায় ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ। কিন্তু উপসর্গের মিল থাকার কারণে সাধারণ মানুষ তো বটেই, অনেক সময় চিকিৎসকরাও শুরুতে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। জ্বর, মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা—প্রথম দিকে দুই রোগেই একই রকম লক্ষণ দেখা দেয়। কিন্তু কয়েক দিন পর পার্থক্য স্পষ্ট হয়। কেউ কেউ ডেঙ্গু ভেবে টেস্ট করান, রিপোর্ট নেগেটিভ আসে। পরে আবার টেস্ট করলে ধরা পড়ে চিকুনগুনিয়া। আর এ কারণেই অনেকে সময়মতো সঠিক চিকিৎসা পান না, ভোগান্তি বাড়তে থাকে।
ঢাকার ভাটারা এলাকার বাসিন্দা ও এক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষক মাকসুদা আনছারীর অভিজ্ঞতাই এর বড় প্রমাণ।
দীর্ঘ ভোগান্তির গল্প
২৪ আগস্ট হঠাৎ তীব্র জ্বরে আক্রান্ত হন মাকসুদা আনছারী। প্রথমে চিকিৎসকরা ডেঙ্গুর টেস্ট করালেও ফল আসে নেগেটিভ। কয়েক দিন পর উপসর্গ দেখে চিকুনগুনিয়ার টেস্ট করলে তা পজিটিভ হয়।
তিনি বলেন, হাত-পা ফুলে গিয়েছিল, পানিও এসেছিল। এমন ভয়াবহ ব্যথা হয়েছিল যে, সারাদিন কান্না করতাম। মুখে কিছুই ভালো লাগত না, সব তিতা। এখনো পায়ের গিরায় গিরায় ব্যথা, আঙুলেও ব্যথা। পা টেনে অফিস যেতে হয়। এতে ব্যথা আরও বাড়ছে।
শুধু তিনি নন, তার পরিবারের পাঁচ সদস্যই একসঙ্গে আক্রান্ত হন চিকুনগুনিয়ায়। ১৫ দিন বিশ্রাম নেওয়ার পর তিনি স্কুলে ফিরলেও এখনো পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেননি।
ডেঙ্গু আর চিকুনগুনিয়া : পার্থক্য কোথায়?
চিকিৎসকরা বলছেন, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া; দুটিই ছড়ায় এডিস মশার মাধ্যমে। তবে উপসর্গে বেশকিছু স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে।
ডেঙ্গুর উপসর্গ
১. হঠাৎ উচ্চ জ্বর, চার-পাঁচ দিন পর শরীরে লালচে র্যাশ
২. রক্তের প্লাটিলেট কমে যাওয়া, রক্তক্ষরণ
৩. শক সিনড্রোমের ঝুঁকি, মৃত্যুঝুঁকিও বেশি
৪. শরীরে ব্যথা থাকে, তবে তীব্র নয়
৫. খেতে না পারা, বমি করা সাধারণ ঘটনা
৬. ‘এক্সপান্ডেড ডেঙ্গু’ হলে লিভার, হার্ট, কিডনিসহ অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে
চিকুনগুনিয়ার উপসর্গ
১. প্রথমে জ্বর, পরে থেমে থেমে আসে (১০২–১০৪ ডিগ্রি পর্যন্ত উঠতে পারে)
২. শরীরের প্রায় সব জয়েন্টে তীব্র ব্যথা, হাঁটাচলা কষ্টকর হয়ে পড়ে
৩. হাত-পা ফুলে যাওয়া
৪. তীব্র মাথাব্যথা ও চোখের পেছনে ব্যথা
৫. শরীরে র্যাশ সচরাচর হয় না
৬. প্লাটিলেট কমে না, রক্তক্ষরণ হয় না
৭. মৃত্যুঝুঁকি নেই, তবে দীর্ঘদিন ব্যথায় ভুগতে হয়
৮. অনেকের চামড়া উঠে যায় বা রং কালো হয়ে যায়
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ জানান, ডেঙ্গুতে যেখানে মৃত্যুঝুঁকি থাকে, চিকুনগুনিয়ায় সে ভয় নেই। তবে জয়েন্ট পেইন এত ভয়াবহ হয় যে, রোগী হাঁটাচলা পর্যন্ত করতে পারেন না। এ জন্য একে অনেকে ‘ল্যাংড়া জ্বর’ও বলেন।
কবে টেস্ট করলে ধরা পড়ে?
ডেঙ্গু : জ্বরের ২-৩ দিনের মধ্যে টেস্ট করলে শনাক্ত হয়। পরে করলে ফল মিলতে নাও পারে।
চিকুনগুনিয়া : জ্বরের ৫-৭ দিন পর টেস্ট করলেই কার্যকর ফল আসে। এর আগে করলে শনাক্ত নাও হতে পারে।
চিকুনগুনিয়া শনাক্ত হয় আইসিটি টেস্ট, আরটি-পিসিআর বা সেরোলজি টেস্টের মাধ্যমে। অন্যদিকে ডেঙ্গু শনাক্ত হয় সাধারণ রক্ত পরীক্ষায়।
খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জুনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. ফরহাদুল ইসলাম বলেন, চিকুনগুনিয়ায় জয়েন্ট পেইন এতটাই তীব্র হয় যে, অনেক সময় আমরা শুধু উপসর্গ দেখেই অনুমান করতে পারি। তবে নিশ্চিত হওয়ার জন্য টেস্ট জরুরি।
চিকিৎসায় পার্থক্য কী?
দুটি রোগের চিকিৎসায় মূলত সহায়ক চিকিৎসা (supportive treatment) দেওয়া হয়।
ডেঙ্গু রোগীকে প্যারাসিটামল দেওয়া হয় জ্বর কমানোর জন্য। প্রচুর পানি, ডাবের পানি, শরবত, জুস, স্যুপ, দুধ খেতে হয়। প্লাটিলেট কমে গেলে রক্ত দিতে হয়।
চিকুনগুনিয়ায় ব্যথা অসহনীয় হওয়ায় অনেক সময় পেইনকিলার দেওয়া হয়। তরল খাবারের পাশাপাশি ফল খেতে বলা হয়। দীর্ঘ ব্যথা কমাতে ফিজিওথেরাপিও কাজে আসে।
সতর্কবার্তা
ডেঙ্গুতে মৃত্যুঝুঁকি বেশি হলেও চিকুনগুনিয়া দীর্ঘ ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। চিকিৎসকরা বলছেন, উপসর্গ দেখে বিভ্রান্ত না হয়ে সময়মতো সঠিক টেস্ট করানোই সবচেয়ে জরুরি। দ্রুত সনাক্ত করা গেলে দুই রোগই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
সূত্র : বিবিসি বাংলা
মন্তব্য করুন