কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১১ জুন ২০২৪, ০৮:৪৯ পিএম
আপডেট : ১১ জুন ২০২৪, ০৮:৫০ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে নিঃস্ব হচ্ছে মানুষ : নাগরিক সমাজে

স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি
গোল টেবিল বৈঠকে বক্তারা। ছবি : কালবেলা
গোল টেবিল বৈঠকে বক্তারা। ছবি : কালবেলা

চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে দেশের অসংখ্য মানুষ নিঃস্ব হচ্ছে। অসংক্রামক রোগের উপদ্রব এখন বিশ্বজুড়ে। তারমধ্যে বাড়ছে না স্বাস্থ্যখাতে সরকারি বাজেট বরাদ্দ। এতে ব্যয় মেটাতে গিয়ে দেশের মানুষকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তাই স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি ও সেবার পরিধি বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছেন নাগরিক সমাজের নেতারা।

মঙ্গলবার (১১ জুন) কারওয়ানবাজার ডেইলি স্টার ভবনে সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশন (সিএসও) ফোরাম এবং ডেইলি স্টার যৌথ আয়োজিত পাবলিক হেলথ এক্সপান্ডিচার : এ ক্রিটিক্যাল চ্যালেঞ্জ ইন এনসিউরিং হেলথ কেয়ার ইন বাংলাদেশ শীর্ষক গোল টেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন।

গোল টেবিল বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশন ফোরামের কনভেনার ডা. সৈয়দ রুবায়েত। তিনি বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ সরকার স্বাস্থ্যখাতে সবচেয়ে কম ব্যয় করে। চলতি বছরের ১৫ এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) গ্লোবাল হেলথ এক্সপান্ডিচার ডাটা বেইজ তথ্য বিশ্লেষণ করে তিনি দেখান, ২০২১ সালে বাংলাদেশ একজন মানুষের পেছনে গড়ে ২৬ ডলার ব্যয় করেছেন। এ সময়ে প্রতিবেশী মিয়ানমার ৪৮ ডলার ব্যয় করেছেন। পাকিস্তানও নানা সংকটের মধ্যে ৪৯ ডলার ব্যয় করেছেন। নেপালে ৭৬ ডলার, ভারতে ৮১ ডলার, শ্রীলঙ্কায় ২৮৩ ডলার জনপ্রতি ব্যয় করেছেন। সবচেয়ে বেশি ব্যয় করেছেন মালদ্বীপ। তারা ওই বছর জনপ্রতি গড়ে এক হাজার ৪৭৯ ডলার ব্যয় করেছেন। পৃথিবীর সবচেয়ে কম সরকারি অর্থ ব্যয় করা ২০টি শীর্ষ দেশের মধ্যেও অন্যমত বাংলাদেশ। শীর্ষে রয়েছে দক্ষিণ সুদান। সেখানে মাথাপিছু প্রায় সাড়ে পাঁচ ডলার সরকার ব্যয় করে। এই সূচকে ২৬ ডলার ব্যয় করে বাংলাদেশও রয়েছে। কম ব্যয় করা তালিকায় থাকা অধিকাংশ দেশ আফ্রিকার।

তিনি বলেন, ২০২১ সালের তথ্যমতে, বাংলাদেশে এখন চিকিৎসা ব্যয়ের ৭৩ ভাগ রোগীকে বহন করতে হয়। ২০০০ সালে মোট ব্যয়ের ৬২ ভাগ রোগীকে বহন করতে হতো। এরপর প্রতিনিয়ত শুধু বাড়ছেই সূচক। অথচ আগামী ২০৩২ সালের মধ্যে আউট অব পকেট এক্সপান্ডিচার বা রোগীর ব্যয় কমিয়ে ৩২ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। কিন্তু বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্দ নেই। এতে ধারণা করা যাচ্ছে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা কঠিন হয়ে যাবে।

তিনি তার বক্তব্যে তুলে ধরেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, চিকিৎসা নিতে গিয়ে রোগীকে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করতে হয় বিশ্বের এমন ১০টি দেশের মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। সবচেয়ে বেশি রোগীকে খরচ করতে হয় আর্মেনিয়াতে। সেখানে মোট ব্যয়ের ৭৯ শতাংশ রোগীকে বহন করতে হয়। মোট ব্যয়ের ৭৩ শতাংশ রোগীকে বহন করার ভার নিয়ে এই তালিকার ছয় নম্বরে রয়েছে বাংলাদেশ। রোগীর চিকিৎসা ব্যয় বৃদ্ধির কারণে ৮ দশমিক ৬১ মিলিয়ন মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাচ্ছে। এখন স্বাস্থ্য বাজেটের পরিমাণ বাড়াতে হবে। রোগীদের ঘাড় থেকে চিকিৎসা ব্যয়ের বোঝা কমাতে হবে।

ডেইলি স্টার বাংলার সম্পাদক গোলাম মর্তুজা বলেন, সরকারের তরফ থেকে বাজেট বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয় না কারণ তারা কেউ সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ করেন না। সামান্য অসুস্থ হলে তারা বিদেশে চিকিৎসা নেন। রাষ্ট্রের জনপ্রতিনিধি, আমরা দেশে চিকিৎসা গ্রহণ করলে চিকিৎসা ব্যবস্থার চেহারাা এতদিনে বদলে যেত। বাজেটে অর্থ বরাদ্দ বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ভিআইপিদের চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাত্রা বন্ধের দাবি তুলতে হবে।

কেয়ার বাংলাদেশের পরিচালক (স্বাস্থ্য ও পুষ্টি প্রোগ্রাম) ইখতিয়ার উদ্দিন খন্দকার বলেন, সারা দেশের সরকারি স্বাস্থ্যসেবার স্ট্রাকচার আরও উন্নত ও সম্প্রসারিত করতে হবে। রোগী ব্যবস্থাপনা ও সেবার পরিধি বাড়াতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে। তাহলে রোগীর ওপর ব্যয়ের বোঝা কমানো সম্ভব হবে।

তিনি বলেন, আমাদের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার একটি স্থাপনা রয়েছে। সেখানে সেবার পরিধি বৃদ্ধির বিষয়টিকে আরও বেশি সমৃদ্ধ করতে হবে। তাহলে আউট অব পকেট এক্সপান্ডিচার কমে আসবে।

প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি শিশির মোড়ল বলেন, রোগীর ঘাড় থেকে চিকিৎসা ব্যয়ের বোঝা কমাতে হলে বাজেট বরাদ্দের টাকা যথাযথভাবে ব্যয় করতে হবে। প্রতি বছর প্রায় আট হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে পারে না স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। ফলে ফেরত যায়। এমনিতে বরাদ্দ কম তার ওপর ফেরত যাওয়া অর্থ এর সঙ্গে আছে প্রচলিত দুর্নীতি। ফলে ব্যয়ের বোঝা শুধু বাড়ছে রোগীর ঘাড়ে। এই বিষয়ে মনিটরিং করতে হবে। সেইসঙ্গে সরকারি ওষুধ উৎপাদক প্রতিষ্ঠান ইডিসিএলকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। কারণ আউট অব পকেট এক্সপান্ডিচারের বেশিরভাগ টাকা ব্যয় করতে হয় ওষুধ কিনতে। বছরে বিভিন্ন সময়ে বাড়ে ওষুধের দাম। সরকারি প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনীয় ওষুধের উৎপাদন বৃদ্ধি করলে ও বিনামূল্যে রোগীকে সরবরাহ করলে কমে আসবে রোগীর ব্যয়ের পরিমাণ।

হ্যান্ডিক্যাপ ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক আঞ্চলিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. ইশরাত জাহান বলেন, জটিল রোগে ভুগছে দেশের ৪২ভাগ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা। অন্যান্য সুস্থ মানুষের চেয়ে তাদের গড় আয়ু প্রায় ১০ থেকে ২০ বছর কম। কিন্তু বাজেটে তাদের চিকিৎসা বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো বরাদ্দ কিংবা ব্যাখ্যা নেই। তাদের যথাযথ চিকিৎসা প্রাপ্তির জন্য স্বাস্থ্য বীমা চালু করা এখন সবচেয়ে জরুরি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, জনসংখ্যার অনুপাতে দেশে স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বরাদ্দ প্রয়োজন মোট বাজেটের প্রায় ১২ থেকে ১৫ শতাংশ। সেখানে আমরা এবছর দেখছি প্রস্তাব করা হয়েছে মাত্র ৫. ২ শতাংশ। মানসম্মত চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য এই অর্থ অপর্যাপ্ত। তারপর এখানে সমস্যা হলো প্রতি বছর অর্থ ফেরত যায়। সীমিত বরাদ্দের অর্থ কাজে লাগাতে পারে না মন্ত্রণালয়। এসব কারণে সেবার ব্যাপ্তি দিনে দিনে ছোট হচ্ছে আর রোগীর ঘাড়ে বাড়ছে ব্যয়। স্বাস্থ্যসেবাকে বিস্তৃত করতে হবে প্রান্তিকে। ওষুধের সরবরাহ আরও বাড়াতে হবে। তবেই রোগীর ব্যয়ের ভার কমবে।

গোলটেবিল বৈঠকে আরও বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাইনুল ইসলাম, আইসিডিডিআরবির বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. আহমেদ এহসানুর রহমান, নারী পক্ষের প্রকল্প পরিচালক সামিয়া আফরিন, কেয়ার বাংলাদেশের পরিচালক (স্বাস্থ্য ও পুষ্টি প্রোগ্রাম) ইখতিয়ার উদ্দিন খন্দকার, অবস্টেট্রিকেল অ্যান্ড গাইনিকোলজিকেল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) সভাপতি হয়েছেন অধ্যাপক ডা. ফারহানা দেওয়ান, বাংলাদেশ উইমেন্স হেলথ কোয়ালিশনের (বিডব্লিউ এইচসি) নির্বাহী পরিচালক শরীফ মোস্তফা হেলাল, আরটিএমআই এর এক্সিকিউটিভ ব্রান্ড মেম্বার মাইশা কবির, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রকল্প কর্মকর্তা শান্তা ইসলাম, নারী মৈত্রীর প্রোগ্রাম ম্যানেজার রেহানা আক্তার মিতা, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সহসভাপতি ডা. মাখদুমা নার্গিস, আইপিএস বাংলাদেশের সিনিয়র টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার ফারহানা জেসমিন হাসান, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এবং সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) লিগ্যাল স্পেশালিস্ট আয়েশা আক্তার, মেরী স্টোপস এর কান্ট্রি ডিরেক্টর কিশওয়ার ইমদাদ, ব্র্যাকের প্রোগ্রাম প্রধান ডা. ইমরান আহমেদ চৌধুরী, আইপিএএস বাংলাদেশের পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. ওয়াহিদা সিরাজ, সিরাক-বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক এস এম সৈকত, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অফ পাবলিক হেলথের অধ্যাপক কাওসার আফসানা, ওজিএসবির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. সামিরা চৌধুরী এবং আইসিডিডিআরবির সিনিয়র ডাইরেক্টর এবং সিনিয়র সাইটিস্টি ডা. শামস এল আরেফিন প্রমুখ।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

পুরো সংসদ ভবন ঘিরে রেখেছে নিরাপত্তা বাহিনী

পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ, সংসদ ভবন ছাড়লেন জুলাই যোদ্ধারা

২০২৬ বিশ্বকাপের জন্য বিক্রি হয়েছে এক মিলিয়নের বেশি টিকিট

সীমান্তে আত্মঘাতী হামলায় ৭ পাকিস্তানি সেনা নিহত

জামায়াতের এমপি প্রার্থীকে হারিয়ে সভাপতি ছাত্রদল নেতা

 ‘জুলাই সনদ’ তারেক রহমানের ৩১ দফার আংশিক প্রতিফলন : প্রিন্স 

নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উল্টে গেল বাস, নিহত ২

জুলাই যোদ্ধাদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ, সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ

মেরুদণ্ড সমস্যায় কর্মহীন ৬০ ভাগ রোগী

‘কৃষিজমি ও পরিবেশ নষ্ট করে বর্জ্যের প্লান্ট করা যাবে না’

১০

‘জুলাই যোদ্ধাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সনদে জরুরি সংশোধন হচ্ছে’

১১

তিন মাসে রেকর্ড রাজস্ব আদায়

১২

জুলাই যোদ্ধাদের সঙ্গে পুলিশের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া

১৩

নেত্রকোনায় কালবেলার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী / কালবেলা মানুষের আস্থা অর্জন করেছে : পুলিশ সুপার

১৪

প্রস্রাবের রং কারণ ছাড়াই ঘোলাটে, এটা কীসের ইঙ্গিত

১৫

তদন্তের মুখে তিন দক্ষিণী অভিনেত্রী

১৬

বরগুনায় কালবেলার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে কৃষ্ণচূড়া ও রাধাচূড়া গাছ রোপণ

১৭

এইচএসসি পরীক্ষায় আমিরাতে বাংলাদেশি দুই প্রতিষ্ঠানের সাফল্য 

১৮

পৃথিবীর সবচেয়ে দামি পালক কোন পাখির?

১৯

চাঁদপুরে কালবেলার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপযাপন / সমাজ বিনির্মাণে সাংবাদিকদের লেখনীর বিকল্প নেই : সলিম উল্লাহ

২০
X