আজকের ব্যবসায়িক দুনিয়ায় প্রতিদিন অসংখ্য নতুন পণ্য ও ব্র্যান্ড জন্ম নিচ্ছে। একই ধরনের শত শত বিকল্প যখন গ্রাহকের সামনে থাকে, তখন শুধু ভালো প্রোডাক্ট তৈরি করাই যথেষ্ট নয়— সেটিকে মানুষের মনে বিশ্বাসযোগ্যভাবে তুলে ধরা সবচেয়ে বড় কাজ।
অনেকে বিজ্ঞাপনের ঝলকানিতে ভরসা করেন, কেউ আবার সেলিব্রিটি ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডরের সহায়তা নেন। কিন্তু একটি জিনিস অনেক উদ্যোক্তা ভুলে যান— নিজেই হয়ে ওঠা নিজের প্রোডাক্টের সবচেয়ে বড় অ্যাম্বাসেডর।
অর্থাৎ, উদ্যোক্তা যদি নিজেই তার পণ্যের প্রতি আত্মবিশ্বাসী হন, সেটিকে নিজের জীবনের অংশ করে নেন এবং সেই অভিজ্ঞতা আন্তরিকভাবে অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নেন, তবে সেটিই হয়ে ওঠে ব্র্যান্ডের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রচার।
কেন উদ্যোক্তাকেই হতে হবে সবচেয়ে বড় অ্যাম্বাসেডর?
আস্থা গড়ে ওঠে বাস্তবতায় : গ্রাহক এখন সচেতন। তারা বিজ্ঞাপনের ঝলকানি দেখে সিদ্ধান্ত নেন না, বরং বাস্তব অভিজ্ঞতা খোঁজেন। উদ্যোক্তা যখন বলেন, ‘আমি নিজেই প্রতিদিন এই প্রোডাক্ট ব্যবহার করি’ তখন সেটি আস্থার অন্য রকম পরিবেশ তৈরি করে।
ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার হাতিয়ার : একটি বড় কোম্পানি বিপুল টাকা খরচ করে টিভি বা বিলবোর্ডজুড়ে থাকতে পারে। কিন্তু একজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার সেই সামর্থ্য নেই। তার শক্তি হলো— নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা। নিজের মুখের কথা, নিজের অভিজ্ঞতাই তার সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন।
মানবিক সংযোগ তৈরি হয় : মানুষ আসলে শুধু প্রোডাক্ট কেনে না, তারা কিনে নেয় মানুষের গল্প। উদ্যোক্তার স্বপ্ন, সংগ্রাম আর যাত্রা— এসব গল্পই পণ্যের পরিচয় হয়ে ওঠে।
কীভাবে নিজেকে বানাবেন নিজের প্রোডাক্টের অ্যাম্বাসেডর?
নিজের পণ্য নিজেই ব্যবহার করুন : সর্বপ্রথম যা করতে হবে, নিজের তৈরি পণ্য বা সেবা নিজের জীবনে ব্যবহার করা।
উদাহরণ- ঢাকার এক তরুণ উদ্যোক্তা হার্বাল শ্যাম্পু বাজারজাত করছেন। তিনি প্রতিটি প্রচারণায় নিজের অভিজ্ঞতার কথাই বলেন। তার ভাষায়— ‘আমি চাই না শুধু গ্রাহক আমার পণ্য কিনুক, আমি চাই তারা দেখুক আমি নিজেই এটি ব্যবহার করছি। এটাই আমার আস্থা।’
গল্প বলাটা একটি বড় মার্কেটিং : শুধু বৈশিষ্ট্য নয়, পণ্যের পেছনের গল্প বলুন। কেন এটি তৈরি হলো, কোনো সমস্যার সমাধান করতে গিয়েই জন্ম নিল— এ গল্প গ্রাহকের মনে দাগ কাটে।
উদাহরণ : রাজশাহীর এক নারী উদ্যোক্তা মাটির গয়না বিক্রি করেন। তিনি বলেন— ‘আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, বিদেশি দামি গয়না কিনতে পারতাম না। তখনই মাটির গয়না বানাতে শুরু করি। সেটিই আজ আমার ব্যবসা।’ গ্রাহক তখন শুধু গয়না কেনেন না, কিনে নেন এক টুকরো সংগ্রামের ইতিহাস।
সোশ্যাল মিডিয়ায় উপস্থিত থাকুন : সোশ্যাল মিডিয়া উদ্যোক্তার হাতে সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার। প্রোডাক্ট তৈরির প্রক্রিয়া ভিডিও করে শেয়ার করুন, রিল আকারে গ্রাহকের অভিজ্ঞতা তুলে ধরুন এবং নিজের যাত্রা খোলামেলাভাবে বলুন।
উদাহরণ : চট্টগ্রামের এক তরুণ উদ্যোক্তা প্রতিদিন তার ক্যাফের ছবি তুলে দেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। তাকে দেখা যায় কফি বানাতে, গ্রাহকের সঙ্গে আড্ডা দিতে। ফলে মানুষ মনে করে— এই ক্যাফে শুধু ব্যবসা নয়, এটি তার নিজের স্বপ্ন।
যোগাযোগে স্বচ্ছ থাকুন : প্রোডাক্টের সীমাবদ্ধতা বা উন্নতির জায়গা লুকাবেন না। বরং খোলাখুলিভাবে বলুন। গ্রাহকদের কাছে যোগাযোগের স্বচ্ছতা ম্যাটার করে।
উদাহরণ : ‘আপনারা জেনে খুশি হবেন যে প্রথম ব্যাচে আমরা বিদেশি উপাদান ব্যবহার করেছিলাম, তবে এখন থেকে স্থানীয় কাঁচামাল নিয়েই কাজ করছি।’ যোগাযোগের এমন সততাই গ্রাহকের মনে দীর্ঘস্থায়ী আস্থা তৈরি করে।
সরাসরি গ্রাহকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন : বিভিন্ন প্রদর্শনী, মেলা বা অনলাইনে লাইভে এসে গ্রাহকের প্রশ্নের উত্তর দিন। যেকোনো সমালোচনার গঠনমূলক উত্তর দিন, কোনে অভিযোগ থাকলে বিনয়ের সাথে ক্ষমা প্রার্থনা করুন ও সেবার মান বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিন। কারণ এমন সরাসরি সংযোগই ব্র্যান্ডের আসল শক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়।
উদাহরণ : সাভারের এক তরুণ ফ্যাশন উদ্যোক্তা প্রতি শুক্রবার ফেসবুক লাইভে নতুন পোশাক দেখান এবং প্রশ্নের উত্তর দেন। এতে তিনি হয়ে উঠেছেন নিজের ব্র্যান্ডের জীবন্ত মুখপাত্র।
প্রোডাক্টকে জীবনধারায় মিশিয়ে ফেলুন : প্রোডাক্টকে শুধু ব্যবসা হিসেবে না দেখে নিজের জীবনধারার অংশ করুন। নিজের পন্যের সাথে আপনার জীবনধারা অগনিত গ্রাহকদের আকৃষ্ট করতে পারে।
উদাহরণ : একজন স্বাস্থ্যকর পানীয় উদ্যোক্তা যদি নিজেই নিয়মিত ব্যায়াম করেন, স্বাস্থ্যকর খাবার খান এবং নিজের পানীয় পান করতে দেখা যায়, তবে গ্রাহকের মনে সেটি দ্বিগুণ প্রভাব ফেলে।
সফলতার বড় উদাহরণ : স্টিভ জবস ও অ্যাপলের ইতিহাস নিশ্চয় অনেকের জানা আছে। অ্যাপলের ইতিহাসে স্টিভ জবস নিজেই ছিলেন ব্র্যান্ডের প্রতিচ্ছবি। তার উপস্থাপনা, পোশাক, প্রযুক্তি নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি— সবকিছুই অ্যাপলের ব্র্যান্ডকে জীবন্ত করে তুলেছিল। তিনি শুধু ফোন বা কম্পিউটার বিক্রি করেননি, বিক্রি করেছেন একধরনের ‘লাইফস্টাইল’।
এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের তরুণ উদ্যোক্তারা। বাংলাদেশেও তরুণ উদ্যোক্তারা এখন নিজেরাই হয়ে উঠছেন ব্র্যান্ডের মুখ। যেমন- এক নারী উদ্যোক্তা নিজের তৈরি অর্গানিক সাবান ব্যবহার করেন এবং ফেসবুকে অভিজ্ঞতা জানান। ফলে দিনদিন তার জনপ্রিয়তা বাড়ছে।
এক তরুণ আইটি উদ্যোক্তা প্রতিদিন তার সফটওয়্যারের আপডেট লিংকডইনে লিখে দেন এবং দেখান কিভাবে তিনি নিজেই ব্যবহার করছেন। এতে তরুণ গ্রাহকদের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে চলেছে।
গ্রামের এক নারী কৃষক নিজের উৎপাদিত মধু বিক্রির আগে পরিবারের সঙ্গে তা খাওয়ার ছবি পোস্ট করেন। যারফলে গ্রাহকের মনে দৃঢ় আস্থা জন্মায়। এতে প্রতিদিন গ্রাহকের কাছে তার মধুর চাহিদা বাড়ছে।
ব্র্যান্ডিংয়ের ক্ষেত্রে যেসব ভুল এড়িয়ে চলা জরুরি
১. পণ্যের গুণ অতিরঞ্জিত করবেন না। ২. অন্যের অনুকরণ নয়, নিজস্ব পরিচয় গড়ে তুলুন। ৩. শুধু বিক্রির কথা নয়, সম্পর্ক তৈরির ওপর জোর দিন।
তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য বার্তা : লেখাটি যারা পড়বেন তাদের মধ্যে অনেকেই তরুণ উদ্যোক্তা। হয়তো আপনার একটি অনলাইন দোকান আছে, হয়তো শুরু করেছেন হস্তশিল্পের ব্যবসা, কিংবা একটি স্টার্টআপের স্বপ্ন দেখছেন। মনে রাখবেন— আপনার সবচেয়ে বড় শক্তি হলো আপনার নিজের মুখের কথা, নিজের অভিজ্ঞতা আর নিজের বিশ্বাস।
গ্রাহকের সঙ্গে যখন আপনি সরাসরি কথা বলেন, নিজের গল্প শেয়ার করেন, নিজের প্রোডাক্ট ব্যবহার করে অভিজ্ঞতা জানান, তখনই আপনি হয়ে উঠবেন আপনার ব্র্যান্ডের সবচেয়ে বড় অ্যাম্বাসেডর।
পরিশেষে, আজকের বাজারে মানুষ শুধু একটি পণ্য কেনে না, তারা কিনে নেয় আস্থা, গল্প আর বিশ্বাস। সেই গল্পের সবচেয়ে শক্তিশালী কণ্ঠস্বর হতে পারেন আপনি নিজেই।
তাই যদি সত্যিই চান আপনার ব্র্যান্ড মানুষের মনে জায়গা পাক, তবে বিজ্ঞাপনের ঝলকানির চেয়ে বড় শক্তি হলো আপনার নিজের জীবন, আপনার নিজের ব্যবহার আর আপনার নিজের মুখের কথা।
এভাবেই উদ্যোক্তা থেকে মানুষ হয়ে ওঠে ব্র্যান্ড, আর ব্র্যান্ড হয়ে ওঠে মানুষের গল্প।
লেখক : ব্যাংকার, উন্নয়ন গবেষক ও লেখক
মন্তব্য করুন