ঢাকার ফুটপাতে ৫ ফুট বাই ৭ ফুটের মধ্যে বসবাস করছে একেকটি পরিবার। এক দিন দুদিন নয়; প্রায় এক যুগ ধরে তাদের এখানে বসবাস। কেউ ইচ্ছাকৃত, কেউ বাধ্য হয়ে এই জীবন বেছে নিয়েছেন। রাজধানীতে ফুটপাতে এমন ভাসমান মানুষের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চললেও তাদের বিষয়ে কোনো তথ্য নেই স্থানীয় প্রশাসন বা সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষের কাছে। এ সমস্যা শুধু নাগরিক পরিবেশের জন্যই হুমকি নয়, তাদের জীবনমান নিয়েও উঠেছে মানবিক প্রশ্ন।
আজিমপুর কলোনির আমতলা গেট লাগোয়া ফুটপাতে ছোট্ট এক টুকরো সংসার। কচুরলতি কুটে রান্না চাপাচ্ছেন পঞ্চাশোর্ধ্ব জাহিদা। পাশেই বছর সাতেকের একটি মেয়ে। আগুনে পোড়া পা নিয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটেন জাহিদা। তাই কাজ করতে পারেন না। তার পেশা ভিক্ষাবৃত্তি। জানালেন, নদীভাঙনে ভিটেমাটি হারা বিধবা জাহিদা জামালপুরের ইসলামপুর থেকে ঢাকা এসেছেন ১১ বছর। মা-মেয়েতে মিলে সংসার পেতেছেন আজিমপুরের ফুটপাতে। জানালেন, মেয়েটির ঝিয়ের আয়ে পেটে-ভাতে দিন চলছে কোনোমতো।
ফুটপাতে থাকেন কেন—এমন প্রশ্নে জাহিদা বলেন, ‘ভিক্ষা করার জন্য রাস্তার পাশে, স্কুলের সামনে থাকতে হয়। তখন বস্তিতে নাতনিটারে কার কাছে রাখব। তা ছাড়া ঘর ভাড়াতেও ৩-৪ হাজার টাকা চলে যায়।’
জাহিদা একা নন, আজিমপুর কলোনি থেকে কবরস্থান পর্যন্ত ফুটপাতে এমন অন্তত ১৪টি পরিবারের বসবাস। এদের অধিকাংশের পেশাই ভিক্ষাবৃত্তি নয়তো ফুল বিক্রি। যেখানে কাজের সংস্থান, সেখানেই সংসার পাতাটা তাদের জন্য সহজ জানালেন এরা। তা ছাড়া ফুটপাতে ভাড়া দিতে হয় না কাউকে।
একই চিত্র চার নেতার মাজারের পাশের ফুটপাতেই। সেখানে ৫ ফুট বাই ৭ ফুটের ফুটপাতে বসবাস করছে ৬টি পরিবার। রান্না-খাওয়া-থাকা সবই ফুটপাতে। শৌচাগার হিসেবে ব্যবহার হয় পার্কের ভেতরের খোলা স্থান। গোসল সারে তারা মন্দিরের পুকুরে।
কথা হলো হটপেটিস বিক্রেতা কাশিম আলীর সঙ্গে। তিনিও জাহিদার মতোই নদীভাঙনের শিকার। তবে এসেছেন সিরাজগঞ্জের কাজিপুর থেকে। বললেন, ফুটপাতে থাকার খরচ নাই। বইমেলার সময় তাড়ায়ে দিলে মেডিকেলের সাইডে যাই। মেলা শেষে আবার ফিরা আসি। স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে কাশিমের পরিবার। বৌ ফুলের মালা বিক্রি করে। বাচ্চারা এসজিওর স্কুলে পড়ে আর বাকি সময় ভিক্ষা করে। কেন ঘর ভাড়া নিয়ে থাকছেন না—এমন প্রশ্নে কাশিমের সহজ উত্তর, ঘর ভাড়ার টাকায় সপ্তাহে তিন দিন মাংস কিনা খাওয়াইতে পারুম বাচ্চাগো। হুদাই ৫/৭ হাজার খরচ করমু কেন?
সরেজমিন দেখা যায়, আজিমপুর, শাহবাগই নয়, চানখাঁরপুল এলাকা, ঢাকা মেডিকেলের আশপাশে, নিউমার্কেটের পেছনের গেটের পাশের ফুটপাতে এমন অন্তত ৭০টি পরিবার থাকে যারা স্বেচ্ছায় ভাসমান জীবন কাটাচ্ছেন। অথচ কেউই ভবঘুরে নন। এরা প্রাকৃতিক দুর্ভোগের শিকার হয়ে ঢাকার আসে কপর্দকশূন্য হয়ে। বাঁচার তাগিদে তখন ফুটপাতে আশ্রয় নিয়ে দিনমজুরির কোনো না কোনো কাজ শুরু করেন। কিছু টাকা হাতে এলে বাসা নেন বস্তিতে। কিন্তু খরচের চাপ বাড়ায় পরে বস্তির ভাড়া ঘর ছেড়ে আগের মতো ফুটপাতকেই বেছে নেন আবার। অনেকে আবার ফুটপাত ছেড়ে বস্তিতেই ওঠেনি কখনো। কারণ, ফুটপাতে থাকতে খরচ নেই। নদীভাঙা মানুষ ছাড়াও ফুটপাতে বসবাসকারীদের মধ্যে স্বামী পরিত্যক্ত বা বিধবা নারী এবং সন্তান পরিত্যক্ত অসহায় বাবা-মায়েদের সংখ্যাই বেশি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সবশেষ ২০২২ সালের জনশুমারি ও গৃহগণনা জরিপ তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন ভাসমান জনসংখ্যা ২২ হাজার ১১৯ জন। যার ৪ ভাগের ৩ ভাগই পুরুষ। আর ঢাকার রাস্তায় এমন ভাসমান মানুষ থাকছেন, ৯ হাজার ৪৩৯ জন। এই জরিপ বলছে, এদের বসবাসের জন্য ঘরবাড়ি নেই এবং যারা রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ড, মাজার, ফুটপাত, সিঁড়ি, ওভার ব্রিজের নিচে, লঞ্চ-টার্মিনাল, ফেরিঘাট, মার্কেটের বারান্দা ইত্যাদি স্থানে অস্থায়ীভাবে থাকেন। উচ্ছেদ বা কাজের সংকট হলে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলা যায় এবং ভাসমান জীবনই বেছে নেন আবার।
বছরের পর বছর প্রধান সড়কের পাশে পলিথিন বা পুরোনো ত্রিপলে ছাউনি দিয়ে থাকা এদের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কে কী করছেন জানতে আজিমপুর ২৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়ে যোগাযোগ করা হয়। তবে এদের বিষয়ে কোনো তথ্য নেই স্থানীয় এই কর্তৃপক্ষের কাছে। একই চিত্র লালবাগ ও চানখাঁরপুলেও। বাধ্য হয়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নগর ব্যবস্থাপনা বিভাগে গেলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, এ বিষয়টি দেখা তাদের এখতিয়ারে নয়। এটি দেখবে সমাজ সেবা অধিদপ্তর।
তবে সমাজসেবা অধিদপ্তরে গিয়ে ঢাকায় ফুটপাতে বসবাসকারী ভাসমান মানুষ সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া গেল না। নির্দিষ্ট করে এ বিষয়ে কোনো প্রকল্প আজ পর্যন্ত নেওয়া হয়নি জানিয়ে সংস্থার মহাপরিচালক মো. সাইদুর রহমান খান বলেন, কাজ হলে তথ্য থাকত। সবাইকে নিয়ে কাজ করার আগে ধাপে ধাপে কাজ করতে হবে। শিশুদের নিয়ে চাইল্ড সেনসিটিভ সোশ্যাল প্রটেকশন ইন বাংলাদেশ প্রকল্পে কাজ করছি আমরা। পরবর্তী বছরে যদি আমাদের বাজেটের পরিসর বাড়ানো যায় তখন এ বিষয়ে আমরা চিন্তা করব।
দায়বদ্ধতার প্রসঙ্গে সাইদুর রহমান বলেন, এটা শুধু আমাদের কাজ নয়। এটা মাল্টিসেক্টর অ্যাপ্রোচের মাধ্যমে কাজ করার দরকার। এখানে হোম-মিনিস্ট্রির কাজের সুযোগ আছে, আমাদেরও কাজের সুযোগ আছে। অনেকগুলো মিনিস্ট্রির ইনভলভমেন্ট এখানে। তারা তাদের জায়গা থেকে কর্মসূচি নেবে, প্রজেক্ট নেবে এবং সেগুলো বাস্তবায়ন করবে। তবে এটি এককভাবে আমাদের দায় নয়।
এদিকে মহিলা ও শিশুবিষয়ক অধিদপ্তরেও এ বিষয়ে সদুত্তর মেলেনি। প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়ে আসা এই মানুষদের বিষয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশ অধিদপ্তরেও এদের বিষয়ে কোনো তথ্য নেই বলে জানান কর্তৃপক্ষ।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক কালবেলাকে বলেন, ‘শুধু ফুটপাতে নয় বস্তিসহ বিভিন্ন স্থানে ভাসমান মানুষ কী পরিমাণে আছে এ বিষয়ে আমরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম তথ্য পাই। কখনো শুনি ২০ লাখ, কখনো বা শুনি ১০ লাখ। তবে রাষ্ট্রীয় পক্ষ থেকে একটি তথ্য বা পরিসংখ্যান থাকা জরুরি।’
দিনের পর দিনে এই ভাসমান মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে, এই দায়বদ্ধতাটা আসলে কার—এমন প্রশ্নের উত্তরে ড. তৌহিদুল হক বলেন, এই দায় রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রকল্প বা কর্মসূচিগুলোর ধরনে সমস্যা রয়েছে। আমাদের দেশে ভাসমান মানুষকে পুনর্বাসন এবং প্রকল্পে আওতাভুক্ত করার জন্য রাষ্ট্রীয় যে কর্মসূচি রয়েছে তার মধ্যে যদি প্রতীয়মান হয়, তারা (ভাসমান) সমাজের অবহেলিত বা তুচ্ছতাচ্ছিল্য যোগ্য কিংবা সরকারকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে এরূপ মানসিকতা নিয়ে কাজ করলে টার্গেট অডিয়েন্স বা এই ভাসমান জনগোষ্ঠীর নৈতিক সমর্থন তারা পাবে না। নৈতিক সমর্থন বলতে, তারা এই প্রকল্পকে সহজে গ্রহণ করবে না।
প্রথমে বিপদে পড়ে ঢাকার এই ফুটপাতে আশ্রয় নিলেও, বর্তমানে তারা এখানেই ঘর বেঁধেছে। কোনো জবাবদিহির জায়গা না থাকায় দিনের পর দিনে এখানেই থাকছেন তারা। দিন দিন এর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ভাসমান জনগোষ্ঠীর জন্য স্থায়ী সমাধান খুঁজতে হলে সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান, সমন্বিত প্রকল্প ছাড়াও সামাজিক সহানুভূতির সমন্বয় প্রয়োজন।
মন্তব্য করুন