গামছা দিয়ে মুখ ঢেকে দেওয়ার পর ঢালা হতো পানি। তখন নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যেত। মনে হতো, ডুবে যাচ্ছেন। ভয়, আতঙ্ক আর শ্বাসরোধে কেউ কেউ অজ্ঞান হয়ে যেতেন। নির্যাতনের এ পদ্ধতির নাম ‘ওয়াটারবোর্ডিং’।
র্যাবের গোপন বন্দিশালায় গুমের শিকার ব্যক্তিদের ওপর এমন ভয়াবহ নির্যাতন চালানো হতো বলে উঠে এসেছে তদন্ত কমিশনের গুম-সংক্রান্ত দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে।
গত ৪ জুন ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ : আ স্ট্রাকচারাল ডায়াগনসিস অব এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে প্রায় ১ হাজার ৮৫০টি অভিযোগ বিশ্লেষণ করে ২৫৩ জন গুমের শিকার ব্যক্তির তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে বলে জানিয়েছে কমিশন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর হাতে গুম হওয়া ব্যক্তিরা অস্বাস্থ্যকর সেলে বন্দি রাখা, উল্টো করে ঝুলিয়ে মারধর করা, নখ উপড়ে ফেলা, বৈদ্যুতিক শক, ঘূর্ণমান চেয়ারে বসানোসহ নানা পদ্ধতিতে করা ভয়াবহ নির্যাতনের কথা বলেছেন।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব গুম, অপহরণ বা আটকের কোনো লিখিত রেকর্ড রাখা হয়নি। ফলে নির্যাতনের দায় এড়ানো গেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এর আগে গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন তাদের প্রথম অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে বিরোধী মতের মানুষকে গুমের সঙ্গে কারা জড়িত, কীভাবে গুম করা হতো, কীভাবে নির্যাতন বা হত্যা করা হতো, তার নানা বর্ণনা উঠে আসে।
২০১৭ সালে র্যাব-১০-এর কাছে ৩৯ দিন বন্দি ছিলেন ২৭ বছর বয়সী এক তরুণ। প্রতিবেদনে তার জবানবন্দি তুলে ধরা হয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘মুখে গামছা দিয়ে পানি মারা শুরু করে। জগ ভর্তি করে মুখের ওপর পানি দিয়েছে। এতে আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। তারপর গামছা সরাইয়া দিয়ে বলে, “কী করছিস?” তখন আমি বলি, “স্যার কী কমু? আপনি আমারে বলেন, কেন ধইরা আনছেন?” তখন বলতেছে, “না ওরে হইতো না। আবার গামছা দে, পানি দে।” এইভাবে তিন-চারবার পানি দেওয়ার পর বলছে ওরে নিয়ে রাইখা আয়।’
এ নির্যাতন পদ্ধতিই ছিল নিয়মিত চর্চা। শুধু এই তরুণ নন, এমন ভয়াবহ অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন আরও অনেকে।
গুমের শিকার ভুক্তভোগীরা আরও জানান, অস্বাস্থ্যকর সেলে দিনের পর দিন বন্দি রাখা হতো তাদের। ছোট ও অন্ধকার কক্ষে থাকা-খাওয়ার জায়গা ও টয়লেট একসঙ্গেই ছিল। এমন অমানবিক পরিবেশের মধ্যে সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে চলত নিরবচ্ছিন্ন নজরদারি। টয়লেট ব্যবহার করার সময়ও যা বন্ধ হতো না, যা ভুক্তভোগীর জন্য চরম অপমান ও লজ্জার।
নির্যাতনের জন্য ঘূর্ণমান যন্ত্রপাতি সম্পর্কে একাধিক বিবরণ পাওয়া গেছে। সাক্ষ্য-বিশ্লেষণ করে দুটি ভিন্ন ধরনের যন্ত্র সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছে কমিশন। এর একটি ঘূর্ণমান চেয়ার, যা র্যাবের টাস্কফোর্স ফর ইন্টারোগেশন সেলে (টিএফআই) ব্যবহার করা হতো।
ভুক্তভোগীরা বলেন, ঘূর্ণমান চেয়ারে বসিয়ে দ্রুতগতিতে ঘোরানো হতো। কেউ বমি করে ফেলতেন, কেউ প্রস্রাব-পায়খানা করে দিতেন, কেউবা অজ্ঞান হয়ে যেতেন।
প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) নিয়ন্ত্রিত জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে (জেআইসি) আরও ভয়াবহ ‘ঘূর্ণমান যন্ত্র’ ব্যবহার হতো। এটি চেয়ার নয়; বরং পুরো শরীর ঘোরানোর যন্ত্র।
নারী বন্দিদের দেওয়া হতো ‘বিশেষ শাস্তি’। তারা পেতেন ভয়ানক ও লজ্জাজনক নির্যাতন। ২০১৮ সালে পুলিশের হাতে বন্দি ছিলেন ২৫ বছর বয়সী এক নারী। তিনি বলেন, ‘দুই হাত বেঁধে জানালার দিকে মুখ করিয়ে রাখত। গায়ে ওড়না না থাকায় দায়িত্বে থাকা পুরুষ কর্মকর্তারা এসে দেখত। বলাবলি করত, এমন পর্দাই করেছে, এখন সব পর্দা ছুটে গেছে।’
ওই নারী আরও বলেন, ‘একবার আমাকে এমন টর্চার করেছে যে পিরিয়ড শুরু হয়ে যায়। প্যাড চাইলে তা নিয়ে দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা হাসাহাসি করে।’
এ ছাড়া র্যাবের বন্দিশালায় আগে চোখ বেঁধে মারধর করা হতো। মারধর ও জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে প্রস্রাব করতে বলা হতো। প্রস্রাব করার সময় দেওয়া হতো বৈদ্যুতিক শক।
সেখান থেকে ফিরে আসা একজন বলেন, ‘প্রস্রাব করার সঙ্গে সঙ্গে মনে হতো আমি পাঁচ ফিট ওপরে উঠে গেছি। মনে হতো শরীরের বড় কোনো স্থানে শক দেওয়া হয়েছে।’
২০১৫ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থার হাতে ৩৯১ দিন বন্দি ছিলেন ৪৬ বছর বয়সী এক ব্যক্তি। তিনি তার ওপর চালানো নির্যাতনের বর্ণনায় বলেছেন, ‘ঘুমাতে দিত না। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে যাওয়ার পর বালিশ সরাই (সরিয়ে) ফেলত। শীতের মধ্যে কম্বল-বালিশ সব সরাই ফেলত। চেয়ার ছাড়া খালি পায়ের ওপর ভর দিয়ে বসিয়ে রাখত। আবার অনেক সময় হ্যান্ডকাপ পরিয়ে বিছানার সঙ্গে আটকে রাখত। মশা কামড়ালেও মারতে পারতাম না। এভাবে শাস্তি দিত।’
গুম কমিশনের সদস্য মানবাধিকারকর্মী সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘গুম হওয়া ব্যক্তিদের নির্যাতন সম্পর্কে আমাদের যতটুকু ধারণা ছিল, বাস্তব পরিস্থিত আরও ভয়াবহ ছিল। ভুক্তভোগীদের বর্ণনা না শুনলে সেটি কল্পনাও করা যাবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘নির্যাতনের এমন কোনো পদ্ধতি ছিল না, যেটা প্রয়োগ করা হয়নি। মৃতপ্রায় অবস্থা হওয়ার আগ পর্যন্ত নির্যাতন চালানো হতো।’
মন্তব্য করুন