কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০৪ আগস্ট ২০২৫, ০৯:৩০ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

আইসিইউ থেকে বাড়ি ফিরেছে আর্থিক খাত : অর্থ উপদেষ্টা

অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। ছবি : সংগৃহীত
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশের আর্থিক খাত দীর্ঘদিন ধরে অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক প্রভাবের শিকার হয়ে একরকম অচলাবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিল। এ অবস্থাকে ‘আইসিইউ পরিস্থিতি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তবে আশাবাদের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, আর্থিক খাত আইসিইউ থেকে কেবিনে ফিরেছে। এরপর এখন আমরা কেবিন থেকে বাড়িতে ফিরেছি। এমনকি বলা যায়, অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে এবং এখন সামনে এগোনোর সময়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে সোমবার (০৪ আগস্ট) ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস’ উপলক্ষে আয়োজিত এক আলোচনায় ড. সালেহউদ্দিন এসব মন্তব্য করেন।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতি, ব্যবসা, ব্যাংকিং ও মিডিয়ায় দীর্ঘ সময় ধরে এক ধরনের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এমপিরা হয়ে উঠেছেন ব্যাংকের মালিক, কেউ কেউ আবার টেলিভিশন বা সংবাদপত্রের মালিক হয়ে গেছেন। ফলে দেশে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বলে কিছু ছিল না, বরং সাধারণ উদ্যোক্তা, তরুণ প্রজন্ম ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য অবকাশ সংকুচিত হয়ে গিয়েছিল।

অর্থ উপদেষ্টা আরও বলেন, বৈষম্য, দুর্নীতি ও সিস্টেম ধ্বংস—এই ৩টি বিষ আমাদের সমাজ ও অর্থনীতিকে গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়েছে, মানুষগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। আমরা এখন চেষ্টা করছি ১৫ বছরের জমে থাকা জগদ্দল পাথর সরিয়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক কাঠামো তৈরি করতে। এটা সহজ কাজ নয়, তবে শুরুটা করতে হচ্ছে আমাদের দিয়েই।

তিনি বলেন, সংস্কার শুধু রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি নয়, এটি একটি বাস্তব প্রয়োজনে পরিণত হয়েছে। আমরা জানি সব সমস্যার সমাধান একদিনে হবে না, কিন্তু আমরা চেষ্টা করছি একটি দৃশ্যমান ভিত্তি রেখে যেতে। ভবিষ্যৎ সরকার যেন আমাদের রেখে যাওয়া কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে অর্থনীতিকে পূর্ণ পুনরুদ্ধার করতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর এই আলোচনায় বলেন, ছাত্রদের সঙ্গে যখন জনগণ যোগ দেয়, তখন কোনো সরকারই টিকতে পারে না। এবারের জুলাই আন্দোলনে আমরা সেই ঐক্য দেখেছি। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এবারের আন্দোলনে দেশের বুদ্ধিজীবীদের পাশে পাইনি। তারা ৬৯ ও ৭১ সালের মতো নেতৃত্ব দেননি, বরং বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। অনেকেই বিক্রি হয়ে গেছেন।

গভর্নর মনসুর বলেন, আমরা এখন অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার দিকে এগোচ্ছি। মূল্যস্ফীতি এখনো ৮ শতাংশের ওপরে রয়েছে। আমাদের লক্ষ্য তা ৩ থেকে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা। ব্যাংকিং খাতের ওপর আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার প্রয়োজন। এজন্য আমরা একটি নতুন ব্যাংক কোম্পানি আইন প্রণয়ন করছি, যা অর্থ মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। আইনটি বাস্তবায়িত হলে ব্যাংক খাত একটি সুশাসনের কাঠামোয় প্রবেশ করবে এবং অতীতের মতো আর অরাজকতা হবে না।

ড. সালেহউদ্দিন বলেন, আমি যখন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলাম, তখন দুর্নীতির মাত্রা এতটা ছিল না। কিন্তু পরবর্তীতে আমরা এমন একটি অবস্থায় পৌঁছাই যেখানে ব্যাংকের মালিক, এমপি ও ব্যবসায়ী একই ব্যক্তি হয়ে দাঁড়ায়। এটি কোন উন্নত দেশেই দেখা যায় না। পার্শ্ববর্তী ভারতের টাটা, আদানি কিংবা আম্বানিরাও একসাথে রাজনীতি ও ব্যাংকিং করেন না। অথচ আমাদের এখানে সেটাই হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, একটি রাষ্ট্রে যখন একটি গোষ্ঠী রাজনীতি, অর্থনীতি, মিডিয়া ও ব্যাংকিং খাত দখল করে ফেলে, তখন সাধারণ মানুষ দমবন্ধ পরিস্থিতিতে পড়ে। তরুণ উদ্যোক্তারা সুযোগ পায় না। ব্যাংকের ঋণ চলে যায় চেনা গোষ্ঠীর কাছে। মিডিয়ায়ও কোনো ভিন্নমত টিকে থাকতে পারে না। ফলে দেশ একরকম কৃত্রিম শান্তির মধ্যে থেকেছে, অথচ ভিতরে ভিতরে দুর্নীতি ও বৈষম্য ফুলেফেঁপে উঠেছে।

আলোচনায় ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, আর্থিক খাতে এখন যে পরিবর্তনের ছাপ আমরা দেখতে পাচ্ছি, তা রাতারাতি হয়নি। গত এক বছর ধরে আমরা বিভিন্ন জায়গায় স্থিতিশীলতা ফেরাতে চেষ্টা করছি। এতে কিছুটা সফলতাও এসেছে। এখন প্রয়োজন এই সংস্কারগুলোকে আইনি ভিত্তি দিয়ে টেকসই করা।

তিনি বলেন, যারা ব্যাংকিং খাতের ভেতরে থেকে ফ্যাসিবাদী সরকারকে সহযোগিতা করেছে, তাদের চিহ্নিত করে শাস্তি দিতে হবে। এটা কেবল ন্যায়ের প্রশ্ন নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি শিক্ষা তৈরি করা জরুরি।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক আনিসুর রহমান বলেন, যারা ব্যাংকের ভেতরে বসে দুর্নীতির গোপন চক্র পরিচালনা করেছে, তাদের মুখোশ উন্মোচন করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতাও নিশ্চিত করতে হবে।

ড. সালেহউদ্দিন বলেন, প্রতিষ্ঠানগুলোর ভেতরেই এখন এমন অনেক কর্মকর্তা আছেন, যারা নিজেও আদর্শ হারিয়ে ফেলেছেন। আমাদের কাজ হলো তাদের মধ্য থেকে সৎ ও সক্ষম মানুষগুলোকে খুঁজে বের করে নেতৃত্বে আনা। সব মানুষ একরকম নয়, এখনো কিছু ‘সোনার মানুষ’ আছে—তাদের সামনে আনতে হবে।

তিনি বলেন, আমরা একটি ভবিষ্যত নির্মাণের কাজ করছি, যেটি হয়তো এখন পুরোপুরি চোখে পড়বে না। তবে এই কাজটা শুরু করা জরুরি। আমাদের সময় সীমিত, তাই আমরা একটি পথচিহ্ন রেখে যাব। পরবর্তী সরকার ও নীতিনির্ধারকরা এই পথ অনুসরণ করে এগোতে পারবেন।

আলোচনায় বক্তারা ‘জুলাই আন্দোলন’-এর শহীদদের স্মরণ করেন এবং তাদের পরিবারের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। অনুষ্ঠানে জানানো হয়, এই আন্দোলনে শহীদ হওয়া ৮৫২টি গেজেটভুক্ত পরিবারের প্রত্যেককে ২ লাখ টাকা করে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও দেশের বিভিন্ন তপশিলি ব্যাংক মিলে ১৬ হাজার শহীদ ও আহতদের পরিবারের জন্য এই সহায়তা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে।

সাবেক ব্যাংকার এবং শহীদ ইয়ামিনের বাবা মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, এখনো ব্যাংকে সেইসব লোকজন ঘাপটি মেরে বসে আছে যারা ফ্যাসিবাদী সরকারের সহযোগী ছিল। তাদেরকে বিচারের মুখোমুখি না করলে সত্যিকার অর্থে আমরা মুক্ত হতে পারবো না।” তিনি আরও বলেন, জুলাই শহীদদের রক্ত যেন বৃথা না যায়, সেটা নিশ্চিত করা এখনকার প্রজন্মের দায়িত্ব।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেন, আর্থিক খাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—আমানতকারীদের সুরক্ষা। আমরা এই নীতিকে প্রাধান্য দিচ্ছি। ব্যাংকিং ও নন-ব্যাংকিং খাতে যারা আমানত রাখছে, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে দেশের অর্থনীতি কখনোই শক্তিশালী হবে না।

ড. সালেহউদ্দিন বলেন, জুলাই আন্দোলনের সময় আমি শারীরিকভাবে অসুস্থ ছিলাম, তাই সরাসরি যেতে পারিনি। কিন্তু আমার স্ত্রী গিয়েছিলেন, এমনকি তার সঙ্গে আমার কাজের মেয়েকেও পাঠিয়েছিলাম। ছাত্ররাই আন্দোলন শুরু করে, পরে জনগণের অংশগ্রহণে তা একটি জাতীয় জাগরণে রূপ নেয়। এখন আমাদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হলো—এই শহীদদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা।

তিনি বলেন, প্রতিটি সংস্কারের পেছনে সময় ও শ্রম দিতে হয়। আইনের সংস্কার, প্রতিষ্ঠান গঠনের সংস্কার, আর ব্যক্তির মানসিকতার সংস্কার—৩টিই এখন জরুরি। আমরা চেষ্টা করছি, যতটুকু করা যায়, করে যেতে। বাকিটা পরবর্তী প্রজন্মের হাতে তুলে দিতে হবে।

অর্থ উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তুতি আজ শুরু হলো। এটাকে সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে হবে। আমরা যে ভিত্তি রেখে যাচ্ছি, তা যেন একটি নতুন বাংলাদেশ গঠনের ভিত্তি হয়। শুধু ব্যাংকিং খাত নয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, এনবিআর, এমনকি আইনশৃঙ্খলা খাতেও যতটা সম্ভব সংস্কার করতে হবে। এগুলো জটিল কাজ, কিন্তু অসম্ভব নয়।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সিলেটে পাথর লুটপাটকারীদের নিয়ে যে পদক্ষেপ নিচ্ছে দুদক

প্লট ও ফ্ল্যাট বরাদ্দে মন্ত্রী-সচিবসহ যাদের কোটা বাতিল

১১ বছর আগে মারা যাওয়া স্বামীই সন্তানের বাবা, দাবি অন্তঃসত্ত্বার

ডাকসু নির্বাচন / দ্বিতীয় দিনে মনোনয়নপত্র নিয়েছেন ১৩ জন

জরায়ুর বদলে লিভারে বেড়ে উঠছে ভ্রূণ, বিস্মিত চিকিৎসকরাও

ঋণখেলাপিরা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না : অর্থ উপদেষ্টা

মোদির হাতেই দেশ নিরাপদ, বললেন কংগ্রেস নেতা

অসহায় বিধবা পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দিলেন তারেক রহমান

এবার জাফলংয়ে পাথর লুটপাট বন্ধে অভিযান

ইবতেদায়ি মাদ্রাসার এমপিওভুক্তি নিয়ে সুখবর

১০

একবার ফোন চার্জ দিলে কত টাকা খরচ হয় আপনার? জেনে নিন

১১

১২ হাজার কোটি টাকা রেমিট্যান্স এলো ১২ দিনে

১২

ভারতকে পাক সেনাপ্রধানের পরমাণু যুদ্ধের হুমকি, যা বলল যুক্তরাষ্ট্র

১৩

এসএসসি পাসেই পানি উন্নয়ন বোর্ডে চাকরি, নেবে ২৮৪ জন

১৪

বিচ্ছেদের পর কাজ থেকে বিরতি, এখনো চিকিৎসা নিচ্ছেন ফারিয়া

১৫

হস্তান্তরের আগেই নবনির্মিত স্কুল ভবনে ফাটল

১৬

পরীক্ষায় কম নম্বর দেওয়ায় শিক্ষিকাকে মারধর করল ছাত্র

১৭

অভাব-ঋণের ভারে মা-মেয়ের বিষপান

১৮

বিএনপির বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে একটি ধর্মভিত্তিক দল : রিজভী

১৯

হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ায় যে ৬ খাবার, বাদ দিন এখনই

২০
X