নিজের মেধা খরচ করে বছরভর লিখে শেষে প্রকাশকের পেছনে ঘুরে, হাতে পায়ে ধরে বই প্রকাশ করতে হয় লেখককে। শুধু কি হাতে পায়ে ধরলেই বই প্রকাশ করে প্রকাশক? না। প্রকাশনার খরচের পুরোটুকুই প্রকাশককে দিতে হয়। কখনো কখনো বই প্রকাশের আগেই খরচের সাথে মুনাফাও বুঝে নেন প্রকাশক।
হবু কবি বা লেখকের বই কে কিনবে? সেটাও একটা বিষয়। তাই বই বিক্রির দায়িত্বটাও কবি বা লেখকের। বিক্রি করতে চাইলেই কি নতুন লেখকের বই কেউ কিনতে চায়? সেই সম্ভাবনাও খুব কম। অগত্যা পরিবার, বন্ধু স্বজনকে ডেকে এনে বই গছিয়ে দেওয়া ছাড়া উপায়ই বা কি। যে ক’কপি বিক্রি হয়, তাও যায় প্রকাশকের পকেটে।
বেশ কয়েক বছর ধরে নিয়মিত বই প্রকাশ করে আসছেন হালিম নজরুল নামের এক লেখক। কথা হয় তার সাথে। তিনি বলেন, বই প্রকাশ করলে প্রকাশকের একটা লাভ আছে, কিন্তু নতুন লেখকই নয় শুধু, বেশিরভাগ লেখকই সম্মানী চোখে দেখেন না। ফলে প্রকাশকরা তাদের ব্যবসাটা ঠিকই করে যাচ্ছেন। আর আমরা লেখকরা প্রকাশকের পেছনে ছুটছি। আমার লেখার মান কেমন সেটা হয়তো প্রকাশক জানেনই না। ফলে আমার লেখায় মান থাকা সত্ত্বেও নিজের টাকাই বই প্রকাশ করে যাচ্ছি। প্রকাশকের কাছে ধননা দেওয়ার কারণে প্রকাশকও সেই সুযোগটা নিচ্ছেন। এর মানে এই না যে টাকা দিয়ে লেখক বই করলেই সব মানহীন বই। নিজ খরচায় বই প্রকাশ করলেও রয়্যালিটি বা সম্মানী চোখে দেখেন না লেখক। তাহলে কিসের লোভে টাকা খরচ করে বই প্রকাশ করেন তিনি? এমন প্রশ্নের জবাবে তাহমিনা শিল্পী নামের এক লেখিকা বলেন, লেখকের লাভ তার একটি বই প্রকাশিত হচ্ছে। এরচে বেশি লাভ আসলে লেখকের নাই। অর্থিকভাবে লেখকের কোন লাভ নেই, আর্থিক লাভ প্রকাশকের। লেখক টাকা বিনিয়োগ করে যে বই প্রকাশ করেন তার থেকে যা বিক্রি হয় সেই টাকাও লেখক পায় না। তাও নিয়ে যায় প্রকাশক। রয়্যালিটি দেবে কিনা সেই বিষয়ে নিশ্চিত নই। তবে ৫টা বই বিক্রি হলেও রয়্যালিটি দেওয়া উচিত।
লেখকরা কেন টাকা দেয়, কথা হয় প্রকাশকদের সাথে। বেশিরভাগ প্রকাশকই ঝুঁকি নেন না নতুন বই প্রকাশের ক্ষেত্রে। ফলে টাকার বিনিময়েই বই ছাপাতে হয় লেখককে। নিয়ম অনুযায়ী প্রকাশক ছুটবেন লেখকের পেছনে। কিন্তু উল্টারথে লেখকই ছুটছেন প্রকাশকের পেছনে। আর সেই সুযোগই লুফে নিচ্ছেন প্রকাশকরা।
কথা হয় প্রতিভা প্রকাশের প্রকাশক মঈন মুরসালিনের সাথে। তিনি বলেন, একজন লেখকের প্রথম বই প্রকাশ হলেই সেটা লাভজনক হয় না। লাভজনক বই হতে গেলে তার জন্য সময় দিতে হয়, সেইটুকু ধৈর্য্য ধারণ করতে পারেন না বেশিরভাগ লেখক। একটা লেখক তার জীবন খরচ করে লিখতে হয়, অন্তত টানা দশ বছর লেখালেখি করলে তখন তার একটা মূল্য দাঁড়ায়। লেখকের সত্যিকারের মূল্য হলে প্রকাশকই তার পেছনে ঘুরবে। কিন্তু আমাদের দেশের চিত্র ভিন্ন, প্রকাশকের পেছনে ঘুরে লেখক।
প্রকাশকদের দাবি, নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর দায়িত্ব তাদের না। তাই নতুন বই প্রকাশে দায় নেই প্রকাশনা সংস্থার। সপ্তডিঙ্গা নামের একটি প্রকাশনার প্রকাশক নাফে নজরুল বলেন, আমাদেরও ঘর সংসার আছে, পেট আছে, আমরা তো আর নিজেদের সম্পদ বিক্রি করে বই প্রকাশ করবো না। অনিশ্চিত পেশায় কেইবা বিনিয়োগ করতে চায়। তবে নতুন লেখকদের কাছে টাকা নিলেও তাদের আমরা অনেক বই দেই। বলতে পারেন লেখক ভেদে ১শ থেকে ২শ বই তারা কিনে নেয় আমাদের কাছ থেকে।
তবে টাকার বিনিময়ে বই প্রকাশ করাকে অন্যায় বলে মনে করেন পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সিনিয়র সহসভাপতি শ্যামল পাল। তিনি বলেন, এখন অনেক প্রকাশক অনেক লেখক। বিষয়টা লজ্জার, তবে এটা ঘটছে। এটা অনুচিত কাজ। যদিও অহরহ ঘটছে এমন ঘটনা তবে লেখককে টাকা দিয়ে বই করতে হবে কেন? এটা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। আমরা অবশ্যই বিষয়টি নিয়ে কাজ করবো।
তিনি বলেন, এখনই লাগাম না টানলে টাকার বিনিময়ে নিম্নমানের সাহিত্য প্রকাশ পাবে, তাতে করে ঠকবে পাঠক।
বাংলা একাডেমির বইমেলাকে কেন্দ্র করে প্রতিটি বছর বাজারে আসে কম করে হলেও ৩ হাজার নতুন বই। কোনো কোনো বছর সেই সংখ্যা ৫ হাজারও ছাড়িয়ে যায়। এতো এতো বই প্রকাশ হলেও ভালো বই খুঁজে পেতে গলদঘর্ম হতে হয় পাঠককে।
মন্তব্য করুন