কালবেলা ডেস্ক
প্রকাশ : ২২ ডিসেম্বর ২০২৩, ১১:২৬ পিএম
আপডেট : ২২ ডিসেম্বর ২০২৩, ১১:৩৩ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সাক্ষাৎকার

পক্ষপাতিত্ব না থাকলে বর্তমান আইন দিয়েই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব

ভয়েস অব আমেরিকাকে সাক্ষাৎকার দেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। সৌজন্য ছবি
ভয়েস অব আমেরিকাকে সাক্ষাৎকার দেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। সৌজন্য ছবি

গত ১৯ ডিসেম্বর প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের একটি ভিডিও সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগের প্রধান শতরূপা বড়ুয়া। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সাক্ষাৎকারটির গুরুত্ব বিবেচনায় কালবেলার পাঠকদের জন্য লিখিত আকারে তুলে ধরা হলো।

শতরূপা বড়ুয়া: নির্বাচনী কাজে বাধা হতে পারে বা ভোটারদের ভোটদানে নিরুৎসাহিত করতে পারে এমন যে কোনো ধরনের সভা-সমাবেশ এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হচ্ছে এবং নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এ নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হচ্ছে এবং বলা হচ্ছে যে, এর সময়সীমা হচ্ছে ১৮ ডিসেম্বর থেকে ভোট গ্রহণের শেষ পর্যন্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত। পাশাপাশি আমরা দেখছি যে, বিএনপি এবং সমমনা দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে যুগপৎ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। সেই আন্দোলনের অংশ হিসেবে তারা হরতাল অবরোধ মানববন্ধনসহ নানারকম রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করছে এবং তারা ঘোষণা দিয়েছে যে, ৭ই জানুয়ারি দলীয় সরকারের অধীনে যে নির্বাচন হতে যাচ্ছে তাতে তারা অংশ নেবে না, তা বর্জন করবে এবং এই নির্বাচনের প্রতিহত করার ঘোষণাও তারা দিয়েছে। আমরা জানি যে, নির্বাচনের অংশ নেওয়া নাগরিকদের যেমন একটি অধিকার তেমনি নির্বাচন বর্জন করার অধিকারও নাগরিকদের রয়েছে। এই অবস্থায় কোনো রাজনৈতিক দল যদি নির্বাচন বয়কট করার জন্য জনমত তৈরিতে কোনো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি দেয় সেখানে নির্বাচন কমিশনের এমন নিষেধাজ্ঞা দেওয়া কী নির্বাচন কমিশনের নিরপক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে না?

কাজী হাবিবুল আউয়াল: আপনি নিজেই বলেছেন যে, তারা নির্বাচনকে প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে। আমরা অসংখ্যবার শুনেছি নির্বাচনকে প্রতিহত করা হবে। বয়কট করতে বাধা নেই, কিন্তু প্রতিহত করাটা অসাংবিধানিক এবং আইনের পরিপন্থি। আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেছি ১৮ ডিসেম্বর থেকে নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত বিরোধী দলগুলো যারা নির্বাচন বর্জন করছেন তারা ভোটারদের নিরুৎসাহিত করতে পারে বা পোলিং বাধাগ্রস্ত হতে পারে এমন কোনো কর্মসূচি সভা-সমাবেশ মিছিল ইত্যাদি থেকে তাদের নিবৃত্ত রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।

আপনি জানেন, সংবিধানের আর্টিকেল ৩৬ বা ৩৭-এ বলা আছে জননিরাপত্তা, জনস্বাস্থ্য এবং জনশৃঙ্খলা বিঘ্নিত হয় এমন কোনো কিছু করা যাবে না। এবারের নির্বাচন কিন্তু একটু ভিন্ন ধরনের অবশ্যই। গত ১০০ বছরে প্রতিটি নির্বাচনই সর্বজনীন এবং সকলে উৎসবমুখরভাবে অংশগ্রহণ করেছে। যার ফলে এই ধরনের কোনো সংঘাত বা সহিংসতার কোনো ঝুঁকি সৃষ্টি হয়নি আগে থেকেই। ২০১৪ সালে হয়েছিল ১৮ সালেও সেটা হয়নি এর আগে ১৯৩৫ সালের পর থেকে কোনো নির্বাচনে এ ধরনের সহিংসতার কোনো ঝুঁকি তৈরি হয়নি। ডিসেম্বরের ১৮ তারিখ আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সেদিন থেকেই আমরা নির্বাচনী প্রচরণা উন্মুক্ত করে দিচ্ছি এবং নির্বাচনী প্রচার দেশব্যাপী হবে। পুরো দেশে তখন একটা উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচনী প্রচার শুরু হবে। যারা নির্বাচনী প্রচার করবেন তাদেরও সভা-সমাবেশ নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে কঠোরভাবে। যেন তারা কোনোরকম সংঘর্ষে জড়িত না হন। অনেক নিয়মনীতি প্রবর্তন করা হয়েছে। আর সেই সময় যারা নির্বাচনের পক্ষে আর যারা নির্বাচন বর্জনের পক্ষে তারা যদি মুখোমুখি হয়ে পড়ে তাহলে অবশ্যই সংঘাত ও সহিংসতার ঝুঁকি থাকবে। আমাদের সদিচ্ছা হচ্ছে ওই ধরনের কোনো ঘটনা যেন না ঘটে। তারা যদি শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ করেন সে বিষয়ে কিন্তু বলা হয়নি, বলা হয়েছে নির্বাচনকে বিঘ্নিত করতে পারে বা নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে এ ধরনের সভা-সমাবেশ থেকে নিবৃত করা। বিগত দু’বছর বা ১০ বছর ধরেই তারা বয়কট করে যাচ্ছে, সেখানে তো বাধা দেওয়া হয়নি।

কিন্তু সময়টা খুব ক্রিটিকাল। সেজন্য শুধু ওই কয়েকটা দিনের কথা বলা হয়েছে। ওই সময়টাতে যেন প্রতিপক্ষের এমন কোনো সভা-সমাবেশ না হয় যাতে করে পক্ষরা সংঘর্ষে-সহিংসতা জড়িয়ে পরতে না পারে। সে দিক থেকে আমরা এ বিষয়টা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টিতে এনেছি এবং তাদের অনুরোধ করেছি তারা যেন বিষয়টা দেখে।

শতরূপা বড়ুয়া: আপনি এবারের নির্বাচনের ভিন্নতার কথা বললেন, এই নির্বাচনে শুধু বিএনপি বা সমমনা দল নয়, দেশে সাংগঠনিক ভিত্তি আছে জনসমর্থন আছে এমন কিছু ইসলামপন্থি দলও নির্বাচন বর্জন করার ঘোষণা দিয়েছে। গত নির্বাচনগুলোতে আমরা যা দেখেছি এদের সম্মিলিত ভোট বাংলাদেশের ভোট ব্যাংকের প্রায় ৪০ শতাংশ। এত বিপুলসংখ্যক ভোটারকে তাদের পছন্দ মাফিক প্রার্থী নির্বাচন থেকে বঞ্চিত রেখে কীভাবে আপনারা মনে করছেন যে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা সম্ভব?

কাজী হাবিবুল আউয়াল: এখানে নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। নিরপেক্ষতা তখনই প্রশ্নবিদ্ধ হয় যখন আমি গোপনে কারও সঙ্গে সংযুক্ত হব অথবা আমরা কোনো একটি পক্ষকে সমর্থন দিব। যারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, যারা নির্বাচনের প্রতিনিধিত্ব করছেন, তারা কেউ বলছেন না নির্বাচন কমিশন নৌকাকে সমর্থন করবে বা তারা গোপনে নৌকার পক্ষে কাজ করবে— এ ধরনের কোনো অভিযোগ নেই। বিএনপি এবং সমমনা দলগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে না।

আপনি পক্ষপাতিত্বের যে বিষয়টির কথা বলছেন সেটি তখনই হতো যদি তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করত এবং আমরা একটি পক্ষ নিতাম। যখন বিএনপি ও সমমনা দলগুলো যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করত তখন এই পক্ষপাতের বিষয়টা আমাদের আরও অধিক সচেতন হতে হতো। আর নির্বাচন কমিশন পক্ষপাতমূলক হয় না। আমাকে প্রায় ৮ লাখ কর্মচারী যারা নির্বাচন কন্ডাক্ট করবে, তারা সবাই ধারকৃত সরকারি কর্মচারী। তাদের উপর আমাদের নির্ভর করতে হবে। তারা যদি সততার সাথে নিষ্ঠার সাথে কাজ করে তবে পক্ষপাত্বের প্রশ্ন উঠবে না। আমরা চেষ্টা করে থাকি এবং জেলা প্রশাসক যারা রিটার্নিং অফিসার তাদেরও বারবার করে বলে দেওয়া হয়েছে এই বিষয়গুলো দেখভাল করতে, যাতে পোলিং সেন্টারের ভেতরে যারা ভোট গ্রহণ করবে তারা যেন সততার সঙ্গে নিষ্ঠার সঙ্গে ভয় ভীতিহীনভাবে ভোট গ্রহণ করে। তাহলেই নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে না। আরেকটা বিষয় হচ্ছে যারাই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে তাদের পেলিং এজেন্ট দিতে হবে। নির্বাচনে কোনো রকম কারচুপি হচ্ছে কিনা, সেটি প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে নিজস্ব পোলিং এজেন্ট দিয়ে প্রতিহত করতে হবে।

প্রধান নির্বাচন কমিশনের পক্ষে ৪২ হাজার কেন্দ্রে গিয়ে এককভাবে বসে থাকা সম্ভব নয়। সেটা আমরা করিও না। সেজন্য প্রত্যেক প্রার্থীকে সচেতন হতে হবে। ভেতরে কোনোরকম কারচুপি হচ্ছে কিনা, ভেতরে যারা ভোট গ্রহণ করছে যারা সরকারি কর্মচারী বা জেলা প্রশাসন বা পুলিশ তারা পক্ষপাতমূলক আচরণ করছেন কিনা ইত্যাদি দেখতে হবে এবং কোনো অনিয়ম হলে আমাদের কাছে রিপোর্ট করতে হবে বা রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে রিপোর্ট করতে হবে।

এখন সেই ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন হচ্ছে না। কিন্তু ২৮টি দল যারা হয়তো প্রধানতম দল নয় তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। দেখা গেছে আওয়ামী লীগের ভেতরেই অনেক ইন্ডিপেন্ডেন্ট ক্যান্ডিডেট দাঁড়িয়ে গেছে। আমাদের কাজ হচ্ছে ভোটাররা নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারছে কিনা।

শতরূপা বড়ুয়া: এবারের নির্বাচনী কেন্দ্রগুলোতে কী সিসিটিভি ক্যামেরা থাকবে? কাজী হাবিবুল আউয়াল: না, সিসিটিভি ক্যামেরা থাকবে না।

শতরূপা বড়ুয়া: এটা কেন থাকছে না? আমরা গাইবান্ধা-৫ এর নির্বাচনে নির্বাচন কেন্দ্রগুলোতে সিসিটিভি ক্যামেরা থাকা বা রাখার কার্যকারিতার একটা প্রমাণ দেখেছি তো...

কাজী হাবিবুল আউয়াল: কারণটা হচ্ছে গাইবান্ধার একটা কনস্টিটিউটে নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনে ৬০ হাজারে অধিক নির্বাচনী কেন্দ্রে ভোট হবে। আমাদের সিসিটিভি ক্যামেরা লাগবে প্রায় সাড়ে তিন লাখ। সাড়ে তিন লাখ সিসিটিভি ক্যামেরা মনিটর করা আমাদের পক্ষে সম্ভব না। এখানে বসে কেন্দ্রীয়ভাবে সম্ভব হবে না। বিষয়টা নিয়ে আমরা চিন্তাভাবনা করেছি। এটা বস্তুগতভাবেই সম্ভব হবে না। ফলে আমরা সেই পরিকল্পনা পরিত্যাগ করেছি।

শতরূপা বড়ুয়া: এটা কী নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত?

কাজী হাবিবুল আউয়াল: আমাদের সিদ্ধান্ত। ফিজিক্যালি সম্ভব না আমরা পারব না— এটা সেজন্য পরিত্যাগ করা হয়েছে।

শতরূপা বড়ুয়া: আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান এমনকি অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়াও বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু অবাধ নিরপেক্ষ এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ওপর জোর দিয়ে আসছে। তারা বলছে এটি শুধু নির্বাচনের দিনের ব্যাপার নয়, এটা তার আগের যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া তাকেও তারা তার মানদণ্ডে নির্বাচন হিসেবে বিবেচনা করছে। আর দেশগুলোর সঙ্গে আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং মিডিয়া চলমান যে ক্র্যাক ডাউন চলছে বিরোধীদলের ওপর সে ব্যাপারে কিন্তু তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং তাকে অমানবিক বলেও আখ্যায়িত করেছে তো এই অবস্থায় আপনারা কীভাবে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন করতে পারবেন বলে মনে করছেন এবং সেজন্য কী কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন?

কাজী হাবিবুল আউয়াল: আপনি যেটা বলেছেন নির্বাচন কমিশনের কাজ হচ্ছে নির্বাচন আয়োজন করা। বাংলাদেশ আর্টিকেল ১ অনুযায়ী একটা রিপাবলিক। রিপাবলিক কথাটার অর্থই হচ্ছে ‘এ কান্ট্রি রুল বাই এ ডেমোক্র্যাটিক্যালি ইলেকট্রেড গভর্নমেন্ট। এটা কখনোই রিপাবলিক হবে না বা থাকবে না যদি সময় মতো নির্বাচন না হয় এবং সরকার যদি নির্বাচিত না হয়। নির্বাচনটা একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে হতে হবে সেটা সংবিধানে বলে দেওয়া হয়েছে। সরকার যদি গঠন করতে হয় তাহলে একটা নির্বাচন লাগবে। নির্বাচনের মাধ্যমে একটা সংসদ গঠন করতে হবে। নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদের পক্ষে একটা সরকার গঠন করা সম্ভব। এ প্রক্রিয়াতেই আমরা নির্বাচন অনুষ্ঠান করে থাকি। আমাদের উপর যে বাধ্যবাধকতা রয়েছে একটা নির্ধারিত সময় নির্ধারিত পদ্ধতিতে নির্বাচন করতে হবে, আমরা সেটাকে অনুসরণ করে একটা অবাধ নিরপেক্ষ শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজনের চেষ্টা করে থাকি। আজ অবরোধ তো কাল হরতাল চলছে। যানবাহনে অগ্নি সংযোগ করা হচ্ছে রেললাইনের স্লিপার উল্টে ফেলে দেওয়া হচ্ছে এবং রেলগাড়ি লাইনচ্যুত হচ্ছে মানুষ হতাহত হচ্ছে, এগুলো একটা দিক এখন ঘটছে। এখানেও একটা অমানবিকতা আছে। কেউ যদি মানুষের জীবন বা মালের হানি সাধন করে তা বন্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। আপনি দেখেছেন ২৮ অক্টোবর একটা বড় ধরনের সহিংসতা হয়েছে। একই দিনে একই সময় যদি পাশাপাশি বড় সমাবেশ হয় তাহলে সংঘাতের একটা সম্ভাবনা থাকে এবং সেদিন কিন্তু বড় ধরনের সংঘাত হয়ে গেছে।

সিইসির সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগের প্রধান শতরূপা বড়ুয়া।

বিষয়টি আমাদের সচেতন করেছে। এখানে কার উপর কতটা দায় পড়বে এটা বলা খুব মুশকিল। সেটা নিয়ে আমরা গবেষণা করি না, এটা সরকার, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দেখবে। রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের কাছে তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করবে যে তাদের উপর নিবর্তন করা হচ্ছে, এটা তাদের বক্তব্য। তাদের বক্তব্যের ব্যাপারে আমরা কোনো মতামত দেবো না। সরকারের বক্তব্যের ব্যাপারে আমি সরকারকে সমর্থন করে কোনো বক্তব্য দেব না। তবে এটা সত্য যে ধরনের বিষয় নিয়ে সহিংসতা হয়েছে এটাকে নিবৃত্ত করা সরকারের দায়িত্ব।

আমরা বলেছিলাম ফলাফল ঘোষণার পরও যদি নির্বাচন কমিশন বিশেষ অভিযোগের ভিত্তিতে মনে করে যে, কোনো একটা আসনে ফলটা পর্যালোচনা করে দেখা উচিত, তাহলে নির্বাচন কমিশন ফল গেজেট না করে স্থগিত রেখে তদন্ত করে দেখতে পারে। দেখে যদি মনে করে কোনো একটি কেন্দ্রের বা পুরো কনস্টিটিউয়েন্সের ফল ডিফেক্টিভ হয়ে গেছে তাহলে এখানে নতুন করে নির্বাচন দিতে পারবে। সেখানে একটু মডিফিকেশন করেছে পার্লামেন্ট। আমরা যে প্রস্তাব করেছিলাম সে প্রস্তাবটাকেই মেনে নিয়ে পার্লামেন্ট সেখানে একটা যৌক্তিক মডিফিকেশন করেছে সেটা হলো, পুরো কনস্টিটিউয়েন্সের নয় যে, যে কেন্দ্রগুলোতে অভিযোগ, সেগুলো বতিল করতে পারবে নির্বাচন কমিশন। ধরেন ১০০টার মধ্যে ৯৯টা কেন্দ্রের ফল আমাদের দৃষ্টিতে ম্যাল প্র্যাকটিস হয়েছে তাহলে আমরা সেই ৯৯ কেন্দ্রের ফল বাতিল করে দেব। বাকি একটার যেটা নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই সেটা থাকবে। তাহলে পুরো কনস্টিটিউয়েন্সের নির্বাচন অটোমেটিক্যালি বাতিল হয়ে যাবে। ৯৯টা কেন্দ্রে স্থগিত রেখে একটি আসনের ভিত্তিতে কাউকে বিজয়ী ঘোষণা করা যাবে না। কাজেই এমন যদি হয় ১০০টার মধ্যে ৫০-৬০টি ফল আমরা স্থগিত করে দিয়েছি, সেই ক্ষমতা আমাদের আছে, তাহালে উক্ত সংসদীয় আসনের ফল এমনিতেই বাতিল হয়ে যাবে। সরকার কিন্তু বাধা দেয়নি পার্লামেন্ট বলেছে, তোমরা যে যে পোলিং স্টেশন সম্পর্কে আপত্তি আসবে তার সব স্থগিত করে দাও পুরো কনস্টিটিউয়েন্সের নয়।

শতরূপা বড়ুয়া: বর্তমানে আইনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে মনে করেন কী যে নির্বাচন কমিশনকে একটি সুষ্ঠ অবাধ নিরপেক্ষ এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচন পরিচালনা করার জন্য পর্যাপ্ত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে?

কাজী হাবিবুল আউয়াল: আমার অভিমত পর্যাপ্ত ক্ষমতা আছে এবং কেউ কখনো বলেননি যে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা অপর্যাপ্ত। এটা নিয়ে মোটা দাগে কোনো অভিযোগ-আপত্তি করা হয়নি। নির্বাচন কমিশন কিন্তু সে তুলনায় খুবই ছোট্ট একটি সংগঠন। নির্বাচন কমিশনের জনবল আছে ১৫০০। কিন্তু নির্বাচন পরিচালনা করতে আমার লাগবে ১২ লাখ মানুষ। তারা সবাই কিন্তু বিভিন্ন দপ্তর থেকে হায়ার করা লোক। তাদের উদ্বুদ্ধ করা, সচেতন করা তাদের বারবার করে বলা হচ্ছে সততার সঙ্গে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে। তারা যদি প্রপারলি এডুকেটেড হতে পারে। তাদের মধ্যে যদি অসততা না থাকে, পক্ষপাতিত্ব না থাকে, তাহলে বর্তমানে যে আইন আছে তা দিয়ে সুন্দর সুষ্ঠু নির্বাচন অবশ্যই হতে পারে ।

এটা কিন্তু একটা সামষ্টিক ব্যাপার এটা নির্বাচন কমিশন একক প্রয়াশে কখনোই কোনো নির্বাচন সফল করতে পারবে না। দুই বা আড়াই হাজার প্রার্থী প্রতিযোগিতা করবে। তাদের একটা মনস্তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে করেই হোক আমাকে জিততে হবে। এখান থেকে সরে আসতে হবে, বিশ্বাস করতে হবে একজন জিতবে বাকিরা পরাজিত হবে। মেনে নিতে হবে নির্বাচনটা যদি অবাধ সুষ্ঠু হয় তাহলে আমাকে বা আমাদের সেই পরাজয়টা মেনে নিতে হবে। এ ধরনের একটা সংস্কৃতি যদি আমরা ডেভেলপ করতে পারি তাহলে নির্বাচন অনেক সহজ হয়। আর মনস্ত্ত্বাত্তিক পরিবর্তন যদি আরও ব্যাপকভাবে ইতিবাচক না হয় তাহলে সেখানে একটা সংকট থেকে যাবে, নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক চলতেই থাকবে।

শতরূপা বড়ুয়া: কিন্তু বর্তমান আইনে নির্বাচন আটকানো বা প্রতিকার করার পর্যাপ্ত ক্ষমতা কী নির্বাচন কমিশনের আছে?

কাজী হাবিবুল আউয়াল: হ্যাঁ পর্যাপ্ত ক্ষমতা আছে। যেটা আমরা বললাম আমরা প্রথম রিটার্নিং অফিসার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ দায়িত্ব পালন করবে। ইলেকটোরাল ম্যাজিস্ট্রেট, ইলেকটোরাল ইনকোয়ারি কমিটি আছে যেখানে জুডিশিয়াল অফিসার, অ্যাক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটরা দায়িত্ব পালন করবেন। দায়িত্ব পালন করে যদি তাৎক্ষণিকভাবে কোনো একটা কেন্দ্র থেকে যদি আপত্তি ওঠে যে এখানে অনিয়ম হচ্ছে তখন ম্যাজিস্ট্রেট ভেতরে যেতে পারবে। ভেতরে গিয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারবে। প্রিসাইডিং অফিসার সবচেয়ে বড় দায়িত্ব পালন করে থাকে। প্রিসাইডিং অফিসার একটা কেন্দ্রের দায়িত্ব পালন করে। প্রিসাইডিং অফিসারকে দায়িত্বশীল করার জন্য পর্যাপ্ত ট্রেনিং আমরা দিয়ে থাকি।

শতরূপা বড়ুয়া: ৭ জানুয়ারির নির্বাচন যদি দেশে বিদেশে গ্রহণযোগ্য না হয় তার দায় নির্বাচন কমিশনের উপর অনেকাংশেই বর্তায়। যদি সে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য না হয় তাহলে কী আপনি পদত্যাগ করবেন?

কাজী হাবিবুল আউয়াল: এসব ব্যাপারে আমি কোনো জবাব দেব না, আমি মনে করি এটা সঙ্গত প্রশ্ন নয়। আমরা আমাদের দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কাজ করে যাব। আমরা আশাবাদী সকলের প্রচেষ্টায় নির্বাচন অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ হবে। আমাদের নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে চেষ্টা থাকবে। একই সঙ্গে আমরা ঘরে ঘরে এই মেসেজ দিয়ে যাচ্ছি যারা নির্বাচনকে প্রত্যক্ষভাবে পরিচালনা করবেন তারা যেন যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করেন। যদি দায়িত্ব পালনে অনিয়ম হয় তাহলে কিছুটা দায়ভার আমাদের উপরে পড়বে। কিন্তু সার্বিকভাবে বা এককভাবে নির্বাচন কমিশনকে কোনোভাবে দায়বদ্ধ করা যাবে না।

এখানে সরকার একটা বড় বিষয়। সরকারের উপর আমাদের অনেকাংশের নির্ভর করতে হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক সদিচ্ছা বারবার ব্যক্ত করা হয়েছে, এবারের নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ হবে। আমাদের আইনে রয়েছে সরকার আমাকে সহায়তা দিবে। সেই সরকারের সহায়তার মধ্যে যদি আন্তরিকতা থাকে, সদিচ্ছা থাকে নিশ্চয়তা থাকে, সততা থাকে, আমরা শুধু এটাকে গাইড করব। সে দিক থেকে সরকার যদি নির্বাচন অনিরপেক্ষ হয় বা নির্বাচন যদি খুব বেশি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায় বিভিন্ন কারণে, সরকারের উপরও তার দায় পড়বে। সেজন্য সরকারও খুব সচেতন।

শতরূপা বড়ুয়া: আমরা যদি বাংলাদেশের ইতিহাসের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই যে, ’৯০-এর পর থেকে বাংলাদেশের যে নির্বাচন হয়েছে তার মধ্য যে নির্বাচনগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয়েছে সেগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে এবং দেশে-বিদেশে স্বীকৃতি পেয়েছে। কিন্তু দলীয় সরকারের অধীনে যে নির্বাচনগুলো হয়েছে ১৯৯৬ এর ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ এবং ২০১৮ নির্বাচন—এই নির্বাচনগুলো কিন্তু দেশে-বিদেশে প্রশ্নবিদ্ধ। বাংলাদেশের মতো একটি দেশে আপনি কি নির্দলীয় সরকারের অধীনে বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন?

কাজী হাবিবুল আউয়াল: এই বিষয়টা নিয়ে আমি খুব বেশি বলব না কারণ এটা একটি রাজনৈতিকভাবে বিতর্কিত প্রশ্ন। এরপর আরও জটিলতা বেড়ে গেছে এই বিষয়ের উপর বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের একটা রায় হয়ে গেছে। রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিষয়টা নিয়ে দেন দরবার করবেন তারা বিষয়টাকে মীমাংসা করবেন। তার ভিত্তিতে বিষয়টা যদি কখনো নিরপেক্ষ হয় পরিবর্তিত হয় তখন সেই পরিবর্তিত অবস্থানে নির্বাচন কেমন অবাধ হবে তখন সেটা বোঝা যাবে। আমার তরফ থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে মন্তব্য করা সমীচীন হবে না।

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

ঘটনাপ্রবাহ: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

দেশের সব সমুদ্রবন্দরে ৩ নম্বর সতর্কসংকেত

রাগিনী এমএমএস ৩’তে যুক্ত হচ্ছেন তামান্না ভাটিয়া

পর্তুগালের তারকা ফুটবলারের সঙ্গে চুক্তি বাড়াল ম্যানসিটি

ছবিতে কী দেখছেন, উত্তরই বলে দেবে আপনি অলস না পরিশ্রমী!

এশিয়া কাপের জন্য স্কোয়াড ঘোষণা করল বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ

 গাজায় দুর্ভিক্ষ হচ্ছে কি না, জানালেন জাতিসংঘ মহাসচিব

কেন্দ্র দখল করলেই ভোট বাতিল : সিইসি

গোপালগঞ্জে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আ.লীগের ৬ নেতার পদত্যাগ

সিপিএলে সাকিবের ব্যর্থতা চলছেই, দল হারল ৮৩ রানে

কটাক্ষের শিকার আলিয়া

১০

ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েলের বেন গুরিয়নের ফ্লাইট স্থগিত

১১

ওজন কমাতে চা

১২

‘কাউকে দোষারোপ করছি না’, বিভুরঞ্জনকে নিয়ে ছেলে ও ভাই

১৩

আজ ঢাকার বাতাসে দূষণের পরিমাণ কত?

১৪

রাজধানীতে ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত

১৫

সেরা অধিনায়ক কে? অপ্রত্যাশিত নাম বলে চমকে দিলেন দ্রাবিড়

১৬

মাইলস্টোনে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় দগ্ধ আরেক শিক্ষার্থীর মৃত্যু

১৭

শাহরুখের ওপর বিরক্ত বোমান ইরানি

১৮

জেনে নিন আজকের স্বর্ণের বাজারদর

১৯

প্রীতি ম্যাচ খেলতে কবে ভারত আসছে মেসির আর্জেন্টিনা জানাল এএফএ

২০
X