এক ছেলে তার বাবাকে রাতের খাবারের জন্য এক নাম করা রেস্তোঁরায় নিয়ে গেল। সেটা ছিল শহরের এক অভিজাত এলাকায়। তারা তাদের রিজার্ভ করা স্থানে বসে কিছু অর্ডার দিল উপস্থিত ওয়েটার-কে। ওর্ডার দেওয়া বেশিরভাগ আইটেম-ই তার বাবার খুব প্রিয় । মনে পড়ল, অনেক দিন আগের কথা, বাসার সবাই মিলে একটা হোটেলে গিয়েছিল একবার। তখনো ও স্কুলে-ই পড়ে। বাবা খেতে বসে বলেছিলেন, কারো চরিত্র বুঝতে হলে, লক্ষ্য করবে, সে ওয়েটারের সাথে কিম্বা ব্যক্তিগত গাড়িচালকের বা গৃহকর্মীদের সাথে কেমন আচরন করে! জীবনে সে যখন যেখানে গিয়েছে, এই কথাটা আর ভুলেনি কোনো দিন। বাবা সব সময় বলতেন, কাউকে ভালবাসলে, তাকে দুটো জিনিস দিতে হয় ; সময় আর সম্মান। মনে হয় আরও একটু বেশি সময় দেয়া উচিত ছিল বাবাকে। কেন জানি বারবার এসব মনে হচ্ছিল আজ। দূর থেকে খাবার নিয়ে আসতে দেখে, বুক-পকেট থেকে ছোট্ট ওষুধ-বাক্সটা বের করে সে। বাবা-কে তিনটে ছোট ছোট ট্যাবলেট দেয় খাবার জন্যে। সেগুলো খেতে গিয়ে এক ছিলকে পানি গড়িয়ে পরে ওনার মুখের কোনা বেয়ে। তার বাবা হটাৎই অনেক দুর্বল হয়ে গেছেন। বয়েসের চেয়েও বেশি বৃদ্ধ মনে হয়। বাবাকে শখ করে খেতে দেখে ওর খুব ভাল লাগে। খাওয়ার সময় তার ধবধবে সাদা চেক শার্টে ও ট্রাউজারে খাবার মাখামাখি হয়ে যাচ্ছিল। পুরো রেস্তোরাঁ তখন ধনাঢ্য আর সৌখিন লোকে ভরা। বৃদ্ধ বাবা খেতে গিয়ে বেশ অস্বস্তি বোধ করছিলেন। মুখের খাওয়া হাত থেকে, মুখ থেকে পড়ে যাচ্ছিল। আশপাশের সবাই তখন বিরক্তি নিয়ে তাদের দিকে তাকাচ্ছে। ছেলেটি কিন্তু শান্তভাবে খেতে খেতে বাবার সাথে কথা বলতে থাকে। সে মোটেও বিব্রত বোধ করে না। বাবার খাওয়ার শেষে ছেলে তাকে ধির-স্থিরে ‘ওয়াশ রুমে’ নিয়ে গেল। তারপর কাপড়ে লেগে যাওয়া খাবারগুলো মুছে দিল পরম যত্নে। দাগ তুলে দিল চামড়ার পাম-শু জোড়া থেকে, চুল আঁচড়ে দিল এবং তার কালো চশমাটা ভালোভাবে মুছে, আবার পরিয়ে দেয়। যখন তারা ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে আসল, পুরো রেস্তোরাঁয় পিনপতন নীরবতা। সবাই তাদের দুজনকে দেখছিল। আধুনিক সংস্কৃতিতে বুঝতে পারছিল না কীভাবে একজন মানুষ নিজেকে জনসম্মুখে এভাবে বিব্রত করতে পারে। ছেলেটি বিল পরিশোধ করে দিয়ে, তার বাবাকে নিয়ে তখন হেঁটে বের হয়ে যাচ্ছে। এমন সময় রেস্তোরার অতিথিদের মধ্যে একজন বৃদ্ধ কিন্তু শক্ত গড়নের মানুষ চেঁচিয়ে ওঠে ছেলেটিকে বললেন, তুমি কি কোনো কিছু রেখে গেছ বাবা? হটাৎই এমন স্নেহমাখা কথা শুনে ছেলেটি একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল। প্রত্যুত্তরে বলল, না-তো স্যার। তখন বৃদ্ধ মানুষটি দৃঢ় ভাষায় বলল, অবশ্যই তুমি কিছু রেখে গেছ! তুমি সব পুত্র, কন্যা ও আশা করি সব বাবা-মার জন্য আজ এখানে একটা বিশাল শিক্ষা রেখে গেলে। মুহূতেই পুরো রেস্তোরাঁয় এক ঝটকা লিলুয়া বাতাস বয়ে গেল। আরো নীরব হয়ে গেল পুর পরিবেশ আহঙ্কার আর লজ্জার এক যুগল মিশ্রণে।
নির্যাস : একজন সুন্দর মানুষের বৈশিষ্ট্য হলো সে সব সময় অন্যের মধ্যে সৌন্দর্য দেখতে পায়।
ডা. রুবায়ুল মোরশেদ : চিকিৎসক, গবেষক, কাইন্ডনেস এবং হ্যাপিনেস
মন্তব্য করুন