কোটা সংস্কার আন্দোলনের আমিও একজন যোদ্ধা। চলমান এই আন্দোলনের অংশ আমিও। আমিও বলছি আমাদের শিক্ষার্থীদের ওপর কুমিল্লায় পুলিশের হামলা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু তাই বলে জনদুর্ভোগ করে বা সাংবাদিক পিটিয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন চালিয়ে যেতে চাই না আমি।
আলোচনার জন্য সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা তৈরি না করে রাজপথ না ছেড়ে নতুন কর্মসূচির ঘোষণা এবং আবার জনদুর্ভোগের বিষয়টি আমাদের নতুন করে ভাবাচ্ছে। সম্প্রতি এ আন্দোলনের জন্য গড়ে ওঠা ফেসবুক গ্রুপের একটি পোস্টকে কেন্দ্র করে সবকিছু নিয়েই নতুন করে ভাবতে হচ্ছে আমাদের। যেখানে আমার মতোই এক আন্দোলনকারী জানান, ব্লকেডের কারণে তার ভাই হার্ট অ্যাটাকের পর বেশ কয়েক ঘণ্টা জরুরি অবস্থায় অ্যাম্বুলেন্সে আটকে ছিলেন রাস্তায়। ফলে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়ে এখনও সে হাসপাতালের ইনটেন্সিভ কেয়ারে ভর্তি রয়েছেন। হাসপাতালে দেরি করে আসার জন্য তার এ অবস্থা বলে জানান ডাক্তাররা। একবার একটু ভেবে দেখুন, আপনার আমার পরিবারের কেউ এমন অবস্থায় পড়লে আমরা কি করব? এবার ভেবে দেখুন, গত দুই সপ্তাহে এমন ঘটনা অসংখ্য রোগীর সঙ্গে ঘটেছে। বিশেষ ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ দুটি স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া প্রতিষ্ঠানে প্রতিদিন কয়েক হাজার জরুরি সেবা নিতে যাওয়া রোগীদের পরিবারের ওপর দিয়ে কি ধকল গিয়েছে সেটা কিছুটা বুঝতে পারি।
সর্বশেষ কর্মসূচি অনুসারে বলা হয়েছে রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি পেশ এবং রাষ্ট্রপতি বরাবর রাজধানী ঢাকা বাদে দেশের অন্যান্য এলাকায় জেলা প্রশাসক বরাবর পদযাত্রার মাধ্যমে স্মারকলিপি প্রদান করা হবে। ১ দফা দাবি নিয়ে এই স্মারকলিপি। কিন্তু এখানে শুধু আমরা দাবি জানিয়ে যাচ্ছি, আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের প্রয়াশ কোথায়?
সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি নিয়ে বৈষম্য বন্ধের দাবিতে গত পহেলা জুলাই থেকে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে অবরোধ কার্যক্রম শুরু করে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এই কর্মসূচি ঘিরে তীব্র যানজট দেখা দেয় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু সড়কে। দূরপাল্লার যাত্রীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাসে আটকে থাকতে হয়। গত বুধবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ক্যান্সারের চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন একজন নারী। তিনি বিবিসিকে জানান, এই অবরোধের কথা জানতেন না। চিকিৎসার পর এক ঘণ্টা ধরে শাহবাগে অপেক্ষা করছেন। কিন্তু কোনো যানবাহন না থাকায় ভোগান্তিতে পড়েছেন।
বাংলাদেশের শীর্ষ সংবাদমাধ্যম প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কোটা সংস্কার আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা বুধবার ঢাকা, চট্টগ্রাম নগরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সড়ক অবরোধ করেন। এতে সড়কে ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হয়। দুর্ভোগে পড়েন যাত্রীরা। দিনভর নানা ভোগান্তিতে কাটে যাত্রীদের।
অবরোধের পর থেকে বাংলামোটর মোড়ে বেশকিছু বাইকারদের সঙ্গে দফায় দফায় বাক-বিতণ্ডায় জড়িয়েছেন আন্দোলনকারীরা। শাহবাগ থেকে আসা বাইকচালক মনির বলেন, ‘আমার আত্মীয় হাসপাতালে এটা শোনার পরও আমাকে ছাড়া হচ্ছে না। আমার সঙ্গে বাজে ব্যবহার করা হয়েছে।’
কোটা সংস্কার আন্দোলনের শুরুতে মানুষের সমর্থন থাকলেও এখন জনগণই এর কারণে হওয়া দুর্ভোগের কথা বলছে। গণমাধ্যম বা সোশ্যাল মিডিয়ায় এই সাধারণ মানুষদের দিয়ে জোর করে নিশ্চয় বক্তব্য আদায় করা হচ্ছে না। রাস্তায় থাকা মানুষদের কাছে গিয়ে কথাগুলো বলা হচ্ছে। শুরুতে আমাদের আন্দোলনকে বাহবা দিয়ে যত মানুষ কথা বলেছে, এখন তার থেকেও বেশি মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, গণমাধ্যম ও সরাসরি আমাদের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। কিন্তু কেন প্রশ্ন তুলছে?
সাধারণ খেটে খাওয়া দিনমজুর, যানবাহন শ্রমিক থেকে শুরু করে সমাজের বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষদের কষ্টে ফেলা হচ্ছে শুধু পাবলিক সার্ভিস হোল্ডার হবার জন্য! কিন্তু পাবলিক সার্ভিস হোল্ডার হবার আগেই কি আমরা সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে তাদের মধ্যে এক নেতিবাচক অবস্থান তৈরি করে ফেলছি না?
আমরা মেধাবীদের আন্দোলন হিসেবে বলছি আমাদের এই আন্দোলনকে। 'অসির চেয়ে মসি বড়'- বাংলা এই প্রবাদকে মনেপ্রাণে ধারণ করা উচিত শিক্ষিত যে কোনো মানুষের। কিন্তু গণমাধ্যম কর্মীদের ওপর হামলা করে আমরা কি প্রমাণ করতে চাচ্ছি। যদি ধরেও নেই গণমাধ্যম আমাদের বিরুদ্ধে কথা বলছে, তাহলে আমাদের মেধাবী হিসেবে সেটা মেধা দিয়ে মোকাবিলা না করে হাতে অস্ত্র তুলে নিতে হবে গণমাধ্যম কর্মীদের বিরুদ্ধে! এ কেমন মেধার পরিচয়! তার থেকেও দুঃখের বিষয় হলো, এ ঘটনায় সাধারণ একটি বিবৃতি দিয়েই কি আমরা দায় এড়াতে পারি। আমাদের তরুণদের শক্তিকে ব্যবহার করে ভবিষ্যতেও যদি এ ধরনের কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়, তার বিরুদ্ধে শক্ত কোনো প্রতিরোধ বা প্রতিবাদ কী আমরা এখন থেকেই জানাতে পারতাম না অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনার দাবির মাধ্যমে। সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনেও সাংবাদিকদের ওপর হামলার জন্য দুঃখ প্রকাশ করা বা এ ধরনের ঘটনা যেন আর না ঘটে সে জন্য নির্দেশনা প্রদানের মতো কূটনৈতিক মেধাও আমাদের হলো না! আমরা দেশ পরিচালনার জন্য কী সত্যিই যোগ্য? উল্টো সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এক রকম হুমকি দিয়েই আন্দোলনের পক্ষে থাকার নির্দেশনা দেওয়া কতটা যৌক্তিক হচ্ছে? এটা কি মেধার পরিচয়। রাষ্ট্রের চতুর্থ কাঠামো হিসেবে গণমাধ্যম তার স্বাধীন মত প্রকাশ করবে এবং যে কোনো ঘটনার সব পক্ষের বক্তব্য উপস্থাপন করবে, এটাই কী যৌক্তিক নয়? নাকি গণমাধ্যমকে আমরা আমাদের মুখপত্র হিসেবে দেখতে চাই? সরকারি চাকরির সময়েও গণমাধ্যমকে আমরা এভাবেই কী হুকুম দিতে চাই এবং আমাদের কথা মতো না চললে বিভিন্ন উপায়ে তাদের ওপর আক্রমণ করতে চাই? এটাই কি আমাদের মেধার পরিচয়? মেধাবী হিসেবে এমন কথা বলাটা হাস্যকর নয়কি? আমার মতের বিরুদ্ধে গেলে একজন শিক্ষিত ও মেধাবী মানুষ হিসেবে আমি তেড়ে মারতে যাব বা হুমকি দেব?
আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আরও একটি বিষয় আমাকে দুশ্চিন্তায় ফেলেছে। কুমিল্লায় এক শিক্ষার্থী পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে এমন গুজব শোনার পর আমারও মনে হয়েছে আন্দোলনে গিয়ে সব বাধা ভেঙে ফেলি। আমার ভাইকে হত্যা করা হলে রাজপথে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলব এটাই স্বাভাবিক চেতনা। সব শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রেই সম্ভবত তাই। কিন্তু যখন জানলাম এমন কিছুই ঘটেনি, বিষয়টি গুজব, তখন বুঝলাম আমাদের আবেগ নিয়ে একটি পক্ষ খেলার চেষ্টা করছে। আমার দুশ্চিন্তার কারণ, অন্যদের দ্বারা ব্যবহৃত হচ্ছি না তো আমরা। এভাবে দীর্ঘদিন জনদুর্ভোগ চালিয়ে গেলে একটা সময় আমরা অন্য কোনো গোষ্ঠীর দ্বারা ব্যবহার হবো এটা নিশ্চিত। এটা সাম্প্রতিক কার্যক্রমে একেবারেই স্পষ্ট। আমাদের কর্মসূচিকে কাজে লাগিয়ে অন্য গোষ্ঠীগুলো সহিংস কার্যক্রম গ্রহণ করলে তার দায় কে নেবে?
শুরু থেকেই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া সবাই এবং আন্দোলনকারীরা বলে আসছেন, কোটা সংস্কার আন্দোলন সরকারবিরোধী আন্দোলন নয়। এটি আমাদের প্রাণের দাবি। এর সঙ্গে কোনো রাজনীতি যেন যুক্ত না হয়। আর সে জন্য আমাদের গঠনমূলক সমাধানের দিকে এগিয়ে যাওয়া যৌক্তিক নয় কী? আর আলোচনা ছাড়া গঠনমূলক সমাধান কি সম্ভব? শুধু একপক্ষের দাবি অনুসারেই কি গঠনমূলক কিছু হবে?
সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনে রাষ্ট্রপতিকে স্মারকলিপি প্রদানের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আমাদের দাবিগুলো কি, সাধারণ শিক্ষার্থীদের চাওয়া কি, সামনে আমরা জনদুর্ভোগ না করে গঠনমূলক আলোচনার জন্য কি করব এ বিষয়ক কোনো বার্তা নেই। সে হিসেবে উল্টো ছাত্রলীগ এখন যে কার্যক্রম গ্রহণ করেছে সেটা বরং একটি সমাধানের দিকে এগোনোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আন্দোলনকারীরাও এমন কার্যক্রম গ্রহণ করতেই পারে। ছাত্রলীগ বা সরকার কোটা সংস্কারের বিপক্ষে কোনো কথা বলেনি। আদালতেও রাষ্ট্র আমাদের পক্ষে। সরকার কোন শঠতা করেনি। আদালতের ওপর ভরসা রাখতে বলেছিল এবং শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রপক্ষ মামলা বিজয়ী হয়েছে। সরকারের কোনো পক্ষ বলেনি ৫৬ শতাংশ কোটা রাখবে। তারাও সংস্কার চায়। আদালত কোটা বহালের রায় বাতিল করে নির্বাহী বিভাগকে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ দিয়েছে সংস্কারের জন্য। এখন আমাদের দায়িত্ব কীভাবে সংস্কার হবে সে বিষয়ে একটি আলোচনার মাধ্যমে পরিপূর্ণ গাইডলাইন তৈরি করা। রাস্তা ব্লকেডের মতো কর্মসূচি আমরা দেব কি না, তা আরও ভাবা উচিত। নাকি আমরা এখন আমাদের মতামতগুলো লিখিত আকারে যৌক্তিকভাবে উপস্থাপন করব। কীভাবে উপস্থাপন করব। কার কাছে জানাব। সে বিষয়গুলো স্পষ্ট করে আলোচনা করা উচিত।
অন্য চাকরিজীবী বা কর্মসংস্থানে থাকা ব্যক্তিদের কথা না ভেবে শুধু জনদুর্ভোগের কর্মসূচি দিয়ে গেলে বিষয়টি হবে পাগলামি, অসামাজিক ও অযৌক্তিক। গণমাধ্যম কর্মীদের ওপর হামলা। পুলিশের আর্মড গাড়ির ওপর উঠে লাফানো, পুলিশের ওপর হামলা- এসবের মাধ্যমে আমরা কি পাবলিক সার্ভিসের জন্য নিজেদের যোগ্য ভাবছি? আসলেই কি আমরা এখন মেধার পরিচয় দিচ্ছি। নাকি যা হচ্ছে তার সঙ্গেই গা ভাসিয়ে যাচ্ছি। আমার মতো যারা সাধারণ শিক্ষার্থী আন্দোলন করছেন, তাদের সময় এসেছে বিষয়গুলো বিবেচনার। গঠনমূলক আলোচনার জন্য নির্বাহী বিভাগের সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এটি। কেননা আদালতে এরই মধ্যে আমাদের দাবি বিজয়ী হয়েছে। তাই জনদুর্ভোগ না করে নির্বাহী বিভাগের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কেন্দ্রিক আলোচনার দাবি জানানোটাই কি এখন যৌক্তিক নয়?
লেখক : ইমরান নাজির, চাকরিপ্রত্যাশী সাবেক ঢাবি শিক্ষার্থী
মন্তব্য করুন