জেমস গেথিন ইভান্স
প্রকাশ : ২৭ আগস্ট ২০২৩, ০৭:৫৩ পিএম
আপডেট : ২৭ আগস্ট ২০২৩, ১০:২৩ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
ডিপ্লোম্যাটের নিবন্ধ

যে ছকে সাজানো প্রিগোজিনের মৃত্যু

প্রিগোজিনের ছবি: নিউইয়র্ক পোস্ট
প্রিগোজিনের ছবি: নিউইয়র্ক পোস্ট

অন্দরখান মঙ্গোলিয়ার এক ঘুমকাতুরে শহর, যেখানে বাতাসের আচ্ছাদনে থাকা কোমল ঘাসে আবৃত এশীয় সমতলে ২০ হাজার মানুষের বাস। প্রথম দেখায় একে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র নিয়ে নাটকীয়তায় ভরপুর কোনো নাটকের স্টেজ মনে হতে পারে ।

তবুও ১৯৭১ সালে অন্দরখান (যার নাম পরিবর্তন করে মঙ্গোলিয়ার ঐতিহাসিক শাসক চেঙ্গিস খানের নামে চিঙ্গিস সিটি রাখা হয়েছে) একটি বৈশ্বিক ষড়যন্ত্রের কেন্দ্রতে পরিণত হয় যেটা চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিসিপি) ভেতর প্রতিশোধের জন্য শক্তি ব্যবহারের ঘটনার কথা মনে করিয়ে দেয়। একটি ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনায় পিপলস রিপাবলিক অব চায়নার প্রতিষ্ঠাতা মাও সে–তুংয়ের নির্বাচিত উত্তরসূরি ও উপপ্রধানমন্ত্রী লিন পিয়াও নিহত হন। এ সময় বিমানে থাকা সবাই নিহত হয়েছিলেন।

বিমান দুর্ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন গুজব ছড়িয়েছে। সাধারণত বিমান দুর্ঘটনাকে ধারাবাহিক নাটক বা ষড়যন্ত্র তত্ত্বের প্লট নির্মাণে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সিসিপির আনুষ্ঠানিক বক্তব্যে বলা হয়, মাওকে হত্যার ষড়যন্ত্রে তার কাছের সমর্থকদের নিয়ে একটি র‍্যালির আয়োজন করেছিলেন লিন, এর ডাক নাম ছিল প্রজেক্ট ৫৭১। এটা ব্যর্থ হলে লিন বেইজিং থেকে পালিয়ে মস্কোর উদ্দেশ্যে রওনা হন। পাইলট পর্যাপ্ত জ্বালানি বহনে ব্যর্থ হওয়ায় বিমানটি মঙ্গোলীয় তৃণভূমিতে মুখ থুবড়ে পড়ে।

রহস্যময় মৃত্যুর আগে লিন পিয়াও মাওকে বিশ্ববিপ্লবের আইকন এবং চীনা রেড গার্ড আর্মি এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধীদের জন্য শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্বে পরিণত করতে সাহায্য করেন। ১৯৬৯ নাগাদ লিন পিয়াও সিসিপির শীর্ষে পৌঁছান এবং চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মাস্টারমাইন্ডও ছিলেন তিনি। তিনিই ১৯৬০ ও ১৯৭০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে মাও-এর দেওয়া লেখাগুলোকে লিটল রেড বুকে সংকলিত করেন।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, চীনা লিবারেশন আর্মিতে লিন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন বিধায় তিনি অনেক গৃহযুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছিলেন। এ কারণে তিনি সামরিক বাহিনীতে সমর্থন পেয়েছিলেন। এই সমর্থনকে তিনি চীনের সংবিধান পরিবর্তনে চাপ হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। আর এটিই তাকে মাওয়ের উত্তরসূরি হিসেবে এগিয়ে নিয়ে যায়। পার্টিতে মাওয়ের প্রচারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণভাবে, চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির (পিএলএ) একজন জেনারেল হিসেবে লিনের সিনিয়র পদে যিনি গৃহযুদ্ধে সিসিপিকে অসংখ্য বিজয়ের জন্য নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তার অর্থ ছিল তার সামরিক সমর্থন ছিল। তিনি এটিকে চীনের সংবিধানে পরিবর্তনের জন্য চাপ দেওয়ার জন্য ব্যবহার করেছিলেন যা তাকে মাওয়ের উত্তরসূরি হিসেবে নামকরণ করেছিল। পার্টির মধ্যে তার জ্যেষ্ঠতার প্রদর্শন হিসেবে লিন বিয়াওর নাম নিয়মিতভাবে প্রচারে মাওর পাশাপাশি উপস্থিত হয়।

লিনের সেনাবাহিনীর ওপর প্রভাব এবং আরও সামরিক সমর্থন জোগাড়ের ইচ্ছাই তার পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যে কোনো স্বৈরাচারীর জীবনে অসংখ্য হুমকি থাকলেও সবচেয়ে বড় হুমকিগুলো বা পিঠে ছুরিকাঘাতের ঘটনাগুলো প্রাসাদের ভেতর থেকেই ঘটে।

পিএলএ-র অভ্যন্তরে লিনের বিকল্প শক্তির ভিত্তি গঠন মাওয়ের একচেটিয়া শাসনের জন্য সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছিল। এর ভেতর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে তার প্রচেষ্টাও তার পতনের বিষয়টিকে এগিয়ে নেয়। মাও এটা কোনোভাবেই সহ্য করতেন না। লিনের চলে যেতেই হতো। কিন্তু এমন একটা উপায়ে যেটাতে কোনো সামরিক বিপ্লবের আশঙ্কা থাকত না। বিমান দুর্ঘটনা, কর্তব্যচ্যুতি এবং পিএলএতে তার সমর্থকদের জড়ো করা সবকিছু যেন একইসূত্রে ছিল।

দুই বছরের ভেতর সিসিপির প্রপাগান্ডার মাধ্যমে তাকে সম্মানিত সিনিয়র নেতা হিসেবে প্রশংসা বাদ দিয়ে বিপ্লবের পথে বিশ্বাসঘাতক তকমা দেওয়া হয়। যেমনটা এর আগে স্বার্থ না মিললে পার্টির অনেক নেতার সঙ্গেই করা হয়েছিল। এমনটা করার মাধ্যমে সিসিপি সাংস্কৃতিক বিপ্লবকে থামাতে পেরেছিল এবং পূর্বেকার ২০ বছরের শত্রু যুক্তরাষ্ট্রকে আলিঙ্গন করেছিল।

বিমান দুর্ঘটনা প্রতিদ্বন্দ্বীদের পরাস্ত করার নাটকীয় একটি উপায় হলেও এর একটি খরচ আছে। স্বৈরাচারী শাসকদের হাতে অনেক অস্ত্রই থাকে যার মাধ্যমে প্রতিদ্বন্দ্বীদের নির্মূল করা যায়। বিমান দুর্ঘটনা একটি চাঞ্চল্য জাগানিয়া বিষয় যেখানে যান্ত্রিক ত্রুটিসহ এমনসব প্রমাণ দেওয়া যায় যা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েই যায়। এটা এমন একটা উপায় যা জনসাধারণের মনোযোগ প্রতিষ্ঠিত সত্য থেকে দ্রুত সরিয়ে নেয়। মাওয়ের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। বিমান দুর্ঘটনা লিন পিয়াওকে জনগণের দৃষ্টিতে নেতা থেকে বিশ্বাসঘাতকে পরিণত করতে সাহায্য করেছিল।

ইয়েভজেনি প্রিগোজিনের প্লেন বিধ্বস্তের ঘটনা নিয়ে আমরা এখনো অনেক কিছু জানি না। বিভিন্ন প্রতিবেদনে জানা যায়, বিমানটিতে রাশিয়ান ক্ষেপণাস্ত্র দ্বারা গুলি করা হয়েছিল। প্রিগোজিনের বিমান দুর্ঘটনাটি লিনের বিমান দুর্ঘটনার মতোই আরেকটি ঘটনা। প্রিগোজিনের অন্তর্ধানের পর তাকে নিয়ে জনগণের মনে থাকা চিত্রের পরিবর্তন ঘটবে। যে প্রিগোজিনকে পুতিনের শাসনের জন্য হুমকি ভাবা হতো তাকে একজন অকৃতকার্য বিশ্বাসঘাতক হিসেবে প্রচার করা হতে পারে।

যে কোনো শর্তে এটা বলাই যায়, এমন একটি বিমান দুর্ঘটনা পুতিনের বিরুদ্ধে ক্যু'র চেষ্টা করা মানুষদের একটি বার্তাই দিবে- সাবধান, নিজেদের পরিণাম মাথায় রেখে নিজস্ব ঝুঁকিতে এগিয়ে যান। আগামী সপ্তাহগুলোতে সম্ভাব্য কয়েকটি পরিবর্তন দেখা যাবে। প্রিগোজিনকে মৃত ঘোষণা ক্রেমলিনের জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক ঘটনা হবে। বিমান বিধ্বস্তের কারণ হিসেবে রাশিয়ান অ্যান্টি-এয়ারক্রাফ্ট, ইউক্রেনীয় বা ন্যাটোর বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রকে দায়ী করা হবে। মস্কো অভিমুখে ওয়াগনার মার্চের অনুরূপ বিদ্রোহ ঘটাতে চাওয়া রুশ প্রতিদ্বন্দ্বীদের ভাগ্য সম্বন্ধে কতটুকু তথ্য জনসমক্ষে জানানো হবে সেটা ক্রেমলিনের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে।

চলমান অবস্থায় দুই ধরনের ব্যাখ্যা দেওয়া হতে পারে। প্রিগোজিনের বিমান দুর্ঘটনা ইউক্রেনের প্ররোচনায় ঘটেছে, অথবা রাশিয়ার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। যে ব্যাখ্যাই ক্রেমলিন দিক না কেন, এখন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো ইউক্রেনে রাশিয়ার তৈরি করা সমস্যা বাদ দিয়ে প্রিগোজিনের মৃত্যুর সম্ভাব্য কারণ নিয়ে ভাববে। এটাই মস্কোর প্রপাগান্ডা মিশনের সফলতা।

যে কোনোভাবেই বিমান দুর্ঘটনা একটি নাটকীয় পদক্ষেপ এবং প্রিগোজিনের সমর্থকরা যে প্রতিবাদে মেতে উঠবে না তার নিশ্চয়তাও দেয়। স্বৈরাচারী দেশের শাসনব্যবস্থায় এমন অনেক কিছুই ঘটে যেগুলো সম্বন্ধে আমরা কিছুই জানতে পারি না। তবে চীনের ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে, পুতিন ও রাশিয়ার ভবিষ্যতের জন্য এ পদক্ষেপের অর্থ হতে পারে সে সম্বন্ধে কিছু সূত্র দেয়। জেমস এথিন ইভান্স: অ্যাডজাঙ্কট ইন্সট্রাক্টর, জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি শিক্ষার্থী।

ভাষান্তর: সরকার জারিফ।

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বিএনপিকে শুভেচ্ছা জানালেন সারজিস

দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টির আগে ‘মধুর’ সমস্যায় বাংলাদেশ দল

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে জিয়াউর রহমানের মাজারে বিএনপির শ্রদ্ধা

বিএনপিকে ধ্বংস করতে বারবার চেষ্টা হয়েছে: মির্জা ফখরুল 

টিকটকে এবার যেসব সুবিধা যোগ হলো

মোবাইলে যেভাবে দেখবেন বাংলাদেশ-নেদারল্যান্ডস টি-টোয়েন্টি ম্যাচ

হত্যা মামলায় সাবেক সিনিয়র সচিব জিয়াউল গ্রেপ্তার 

শুটিং শেষ করে শাহিদ কাপুরের আবেগঘন স্ট্যাটাস

৬০০ বিঘার এই বিলে মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে সাদা শাপলা 

ভূমিকম্পে ভয়াবহ বিপর্যয়ে আফগানিস্তান, নিহত বেড়ে ৫০০

১০

নুরের নিরাপত্তা বিবেচনায় বিদেশে চিকিৎসার দাবি জানালেন রাশেদ 

১১

কে এই লিভারপুলের ২০০০ কোটি টাকার স্ট্রাইকার?

১২

অনার্স চতুর্থ বর্ষের ব্যবহারিক ও মৌখিক পরীক্ষার সূচি পরিবর্তন

১৩

বিশ্বের মুসলিমদের উদ্দেশে ইরানের প্রেসিডেন্টের বার্তা

১৪

সুসজ্জিত গাড়িতে পুলিশ সদস্যের রাজকীয় বিদায়

১৫

বিদ্রোহী সরকারের প্রধানমন্ত্রী নিহত, ইয়েমেনের পক্ষে ইরানের হুংকার

১৬

চোখের পাতা লাফানো কি অশুভ, নাকি কোনো রোগের লক্ষণ

১৭

সিডনিতে রুশ কনস্যুলেটের গেটে গাড়ির ধাক্কা, অতঃপর...

১৮

চবি ক্যাম্পাসে সুনসান নীরবতা

১৯

মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ওসমানীর ১০৭তম জন্মবার্ষিকী আজ

২০
X