সাম্যের কবি, বিরহ-বেদনার কবি, বিদ্রোহের কবি, বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৭তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রয়াণ দিবসে জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি এবং তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। সেই সাথে স্মরণ করছি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। কারণ তার কারণে আজ আমরা কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি বলতে পারি।
বঙ্গবন্ধুর জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে অন্যতম হলো, জাতীয় কবি নজরুলকে বাংলাদেশে নিয়ে আসা। এই সিদ্ধান্তটি ছিল চমৎকার। কবি নজরুল স্বাধীন বাংলাদেশে আসেন ১৯৭২ সালের ২৪ মে। সেদিন কবির ছিল ৭৩তম জন্মবার্ষিকী। কিন্তু ১৯৪২ সালে তার জাগতিক চেতনা লুপ্ত হয় এবং সে কারণে কবি হিসেবে তার মৃত্যু হয় ৭৯ বছর আগে। বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে তার সম্মান ও স্বীকৃতি পাওয়া ছিল যথার্থ এবং সঠিক। নজরুল যেমন দুঃখী মানুষের কষ্ট দেখে ফুঁসে উঠেছিলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তেমনি দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছিলেন। এই একই উদ্দেশ্যে যেহেতু দুজনের জীবন ধাবিত ছিল, এটি প্রায় একটি ঐতিহাসিক নিশ্চয়তা- বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ নামে যে রাষ্ট্রকে স্বাধীন করলেন, সেটারই জাতীয় কবি হবেন নজরুল। বঙ্গবন্ধুকে রাজনীতির কবি বলা হয়, তেমনি নজরুলকে কবিতার রাজনীতিক বলা যায়। হাসপাতালে অসুস্থ কবি নজরুলের শয্যাপাশে উদ্বিগ্ন বঙ্গবন্ধু তার (কবির) শিয়রে হাত রেখে সমবেদনা জানাচ্ছেন, এই সাদা-কালো ছবিটি এ দুই মহাপুরুষের মেলবন্ধনের একটি অনুপম স্বাক্ষর।
তিনি ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম অগ্রণী বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সংগীতজ্ঞ ও দার্শনিক যিনি বাংলা কাব্যে অগ্রগামী ভূমিকা রাখার পাশাপাশি প্রগতিশীল প্রণোদনার জন্য সর্বাধিক পরিচিত। তিনি বাংলা সাহিত্য, সমাজ ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব হিসেবে উল্লেখযোগ্য। নজরুল এক দরিদ্র মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রাথমিক শিক্ষা ছিল ধর্মীয়। স্থানীয় এক মসজিদে সম্মানিত মুয়াজজিন হিসেবেও কাজ করেছেন।
কৈশোরে বিভিন্ন থিয়েটার দলের সাথে কাজ করতে গিয়ে তিনি কবিতা, নাটক এবং সাহিত্য সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান লাভ করেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কিছু দিন কাজ করার পর তিনি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন।
বিদ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলাম উসকে দিয়ে গেছেন তরুণ প্রজন্মকে। যদি করার মতো কোনো কাজ কেউ করতে পারে- তা হলে তা তরুণই, অন্য কেউ নন। তাই কবি নজরুল তার বিভিন্ন লেখায় ও অভিভাষণে করে গেছেন তারুণ্যের জয়গান। তিনি বলেন- ‘তারুণ্যকে, যৌবনকে আমি যেদিন হইতে গান গাহিতে শিখিয়াছি সেইদিন হইতে বারেবারে সালাম করিয়াছি, সশ্রদ্ধ নমস্কার নিবেদন করিয়াছি; জবা-কুসুম-সঙ্কাশ তরুণ অরুণকে দেখিয়া প্রথম মানব যেমন করিয়া সশ্রদ্ধ নমস্কার করিয়াছিলেন, আমার প্রথম জাগরণ প্রভাতে তেমনি সশ্রদ্ধ বিস্ময় লইয়া যৌবনকে অন্তরের শ্রদ্ধা নিবেদন করিয়াছি; তাহার স্তবগান গাহিয়াছি।’
নজরুল ছিলেন বিদ্রোহী কবি, তার বিদ্রোহী কবিতা মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে যেতে উৎসাহিত করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে নজরুলের কবিতা ও গান ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার বিভিন্ন পঙ্ক্তি, যেমন ‘চির-উন্নত মম শির’- এই কবিতা শুনলে সবার মনে এক ধরনের বিদ্রোহী মনোভাব সৃষ্টি হয়, যা সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে আমাদের সাহস জোগায়। আজও শুধু কবিতার কথা ধারণ করে অনেক অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে শুনে এবং আমার নিজের মনে এই বিদ্রোহী কবিতার তাৎপর্য ধারণ করি।
তিনি ছিলেন এক অসাম্প্রদায়িক কবি, কারণ তিনি ইসলামি গান-গজল রচনা করছেন এবং সাথে সাথে শ্যামা সংগীত লিখেছেন। কবি নজরুল সাম্যের কবি, প্রেমের কবি- সব বিশেষণেই আমরা তাকে বিশেষায়িত করতে পারি। কিন্তু সবার আগে কাজী নজরুল ইসলামের মূল্যায়ন হওয়া উচিত- মানুষের কবি, অসাম্প্রদায়িক চেতনার কবি হিসেবে।
‘গাহি সাম্যের গান- যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান, যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান।’
বাঙালি যতদিন বঙ্গবন্ধু, নজরুল এবং রবীন্দ্রনাথের চেতনা ধারণ করতে পারবে, ততদিন জাতীয় জীবনে যতই বিঘ্ন-বিপদ আসুক, যতই প্রতিকূল অবস্থা হোক না কেন, বাংলাদেশ ও বাঙালির জয় সুনিশ্চিত। এখনো সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে, সব গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামে তার রচনা আমাদের গভীরভাবে উদ্দীপ্ত এবং অনুপ্রাণিত করে। মানবতার কবি নজরুল একুশ শতকে এসে হয়ে উঠেছেন মনুষ্যত্বের কবি। যখন দেশে সাম্প্রদায়িকতা জঙ্গিবাদ, ধর্মীয় কুসংস্কার বেড়ে চলছে। তখন তার অসাম্প্রদায়িক ও মানবতার চেতনা বারবার মনে পড়ে। তাই জাতীয় কবি নজরুল চর্চার কোনো বিকল্প নেই। তাহলে দেশ হবে জঙ্গি এবং সাম্প্রদায়িকতামুক্ত। এটাই হোক আজকের দিনের প্রত্যাশা।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ‘বিদ্রোহী কবি’ এবং আধুনিক বাংলা গানের ‘বুলবুল’ নামে খ্যাত কাজী নজরুল ইসলাম উপমহাদেশের অবিভক্ত বাংলার সাংস্কৃতিক জগতে সবচেয়ে বর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি যদি তার সম্পূর্ণ সময়টুকু স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন তাহলে তিনি যে কোনো মাত্রায় থাকতেন বা সাহিত্যের কোন পর্যায়ে আসীন হতেন তা আর বলে বা লিখে শেষ করা যাবে না। তিনি এক উচ্চ লেভেলে থাকতেন, যা কারও সাথে হয়তবা তুলনা করা যেত না। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, তিনি বেঁচেছিলেন ৭৭ বছর। জন্মের পর থেকে মাত্র ৪৩ বছর বয়স পর্যন্ত স্বাভাবিক জীবন কাটিয়েছেন। এর মধ্যে সাহিত্য রচনার কাল ছিল মাত্র ২৪ বছর। তারপরও বাঙালির জীবনে নজরুলের দিগন্তবিস্তারি প্রভাব! কেন? গবেষক বা বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, সাহিত্য রচনার সময়কালের ব্যাপ্তি যাই হোক না কেন নজরুলের প্রভাব শতাব্দী পেরিয়ে আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। পৃথিবী যতদিন আছে নজরুল ততদিন তার সাহিত্যের মাধ্যমে বেঁচে থাকবেন মানুষের জীবনে এবং কর্মে।
আজকের দিনে রাষ্ট্র বা সরকারের নিকট একটি অনুরোধ কবি নজরুলের জাতীয় কবির স্বীকৃতি দেওয়া যেন সরকারি প্রজ্ঞাপন দিয়ে প্রকাশ করা হোক। কারণ কোনো সরকার কর্তৃক কোনো গেজেট আজও প্রকাশ পায়নি। যদিও তিনি জাতীয় কবি এটা সব জনগণ জানে এবং বিশ্বাস করে। বই বা পুস্তক সব জায়গায় কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে বা লেখা হয়। কিন্তু তারপরও একটি সরকারি প্রজ্ঞাপন থাকলে খুবই ভালো হতো। যারা আমরা নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা বা কর্ম করি তাদের অবশ্যই সবাইকে বঙ্গবন্ধু ও নজরুলের চেতনা ধারণ করতে হবে। এটা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। আমরা যদি নজরুলকে চর্চা করি তাহলেই নজরুলের নামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়া স্বার্থক এবং সফল হবে।
ড. মো. শফিকুল ইসলাম : সহযোগী অধ্যাপক, হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য-পদ্ধতি বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।
মন্তব্য করুন