কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) আজ আর কেবল প্রযুক্তি নয়, বরং নেতৃত্ব ও সংগঠনের ধরন পাল্টে দেওয়ার এক অনুঘটক শক্তি। তথ্য প্রক্রিয়াকরণ, পূর্বাভাসভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ কিংবা কর্মীদের পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত করা—এসবই এখন ক্রমেই অ্যালগরিদম ও তথ্যনির্ভর হয়ে উঠছে। এই প্রেক্ষাপটে নেতৃত্ব মানে আর কেবল অতীত অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করা নয়; বরং শেখা ভুলে যাওয়ার ক্ষমতা, নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি এবং মানবিক আবেগনির্ভর দক্ষতার সমন্বয়ই হয়ে উঠছে কার্যকর নেতৃত্বের মূল ভিত্তি।
শেখা ভুলে যাওয়ার ক্ষমতা : নতুনের টানে পুরোনো জ্ঞানকে ছাড়তে শেখা
এআই যুগে জ্ঞানের স্থায়িত্ব আশ্চর্যজনকভাবে কমে এসেছে। গতকাল যে নীতি বা প্রক্রিয়া কার্যকর ছিল, আজ তা অচল হয়ে যেতে পারে। তাই নেতার প্রথম দক্ষতা হলো—শেখা ভুলে যাওয়ার ক্ষমতা। বহু বছরের অভ্যাস, প্রচলিত ধারণা কিংবা পরীক্ষিত মডেল যদি আর কার্যকর না হয়, তবে সেগুলোকে সাহসের সঙ্গে বিদায় জানাতে হবে। অভিজ্ঞতা অবশ্যই অমূল্য, তবে এটিকে স্থায়ী সম্পদ নয়, বরং চলমান বিনিয়োগ হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। সিদ্ধান্ত নিতে হবে তথ্য, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও নতুন যৌক্তিক প্রমাণের ভিত্তিতে; ‘আগে যেমন করেছি’ ধরনের পুরোনো যুক্তি দিয়ে নয়। নেতৃত্ব তাই হয়ে উঠবে এক সম্মিলিত শেখার যাত্রা, যেখানে ভিন্নমতকে গুরুত্ব দেওয়া হয়, ভুল হলে দ্রুত সংশোধন আনা হয়, আর দল ও অংশীদাররা শেখার সক্রিয় অংশীদার হয়ে ওঠে।
পরামর্শ : প্রতি ত্রৈমাসিকে পুরোনো নীতিমালা ও প্রক্রিয়ার ‘সানসেট পর্যালোচনা’ চালু করা, গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে ‘বিকল্প দল’ বা ভিন্নমত পর্যালোচনা দল রাখা, ব্যবস্থাপকদের জন্য ‘আনলার্নিং’ ও ‘রিলার্নিং’ কর্মশালা আয়োজন করা।
দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি—কিন্তু পাথরে খোদাই নয়
নেতৃত্বের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো দূরদর্শিতা। তবে এআই যুগে সেই দৃষ্টিভঙ্গি হতে হবে নমনীয়। প্রতিষ্ঠানের বৃহৎ লক্ষ্য ও দিকনির্দেশনা স্পষ্ট থাকতে হবে, কিন্তু বাস্তবায়ন কৌশল হতে হবে অভিযোজনযোগ্য—যাতে পরিস্থিতি পরিবর্তন হলে দ্রুত মানিয়ে নেওয়া যায়। বাজার, প্রযুক্তি, নীতিনিয়ম কিংবা ভূরাজনীতি—সবকিছুর ওঠানামা পরিকল্পনাকে বদলে দিতে পারে। তাই নেতার কাজ হলো একাধিক সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ কল্পনা করা এবং প্রতিটির জন্য প্রস্তুতি রাখা। লক্ষ্য ও সূচক নির্ধারণ করতে হবে, তবে সময়ান্তে সেগুলো তথ্য বিশ্লেষণ করে পুনর্মূল্যায়ন জরুরি। আজকের সঠিক পথ আগামীকাল অকার্যকর হয়ে যেতে পারে। প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকার জন্য দ্রুত ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতাই হবে আসল শক্তি।
পরামর্শ : বার্ষিক পরিকল্পনার পাশাপাশি প্রতি নব্বই দিন অন্তর অভিযোজন পর্যালোচনা রাখা, নতুন এআই–ভিত্তিক প্রকল্পে ‘পাইলট–লার্নিং–স্কেল’ নীতি অনুসরণ করা এবং শীর্ষ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণে সরাসরি তথ্যচিত্র ব্যবস্থাপনা চালু করা—যাতে তাৎক্ষণিক তথ্য দেখে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া যায়।
মানবিক দক্ষতা ও আবেগনির্ভর বুদ্ধিমত্তা : প্রযুক্তির যুগে মানুষের কাছে ফিরে যাওয়া
এআই যত উন্নত হচ্ছে, মানবিক দক্ষতার গুরুত্ব তত বাড়ছে। কারণ তথ্য বিশ্লেষণ ও প্রক্রিয়া সামলাতে পারে যন্ত্র, কিন্তু বিশ্বাস গড়ে তোলা, ভয় দূর করা, সংঘাত মীমাংসা কিংবা কর্মীদের উদ্দেশ্যের সঙ্গে যুক্ত করা—এসব কেবল মানুষের পক্ষেই সম্ভব। আজকের নেতা হতে হবে সহানুভূতিশীল প্রশিক্ষকের মতো—যিনি নির্দেশ দেওয়ার পাশাপাশি শোনেন, বোঝেন এবং মানুষকে ক্ষমতায়িত করেন। একই সঙ্গে বিবেচনায় রাখতে হবে কর্মশক্তির বৈচিত্র্য। স্থায়ী, চুক্তিভিত্তিক কিংবা স্বল্পমেয়াদি কর্মী—সবাই মিলে আজকের দল গড়ে ওঠে। তাই নেতৃত্বের জন্য প্রয়োজন মাঠপর্যায়ে উপস্থিতি, সরাসরি কথোপকথন, স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা।
পরামর্শ : এআই–ভীতি দূর করতে নিয়মিত উন্মুক্ত সভা আয়োজন করা; স্পষ্ট বার্তা দেওয়া—‘এআই কাজ কেড়ে নেবে’ নয়, বরং ‘এআই কাজকে উন্নত করব;’ প্রতিষ্ঠানজুড়ে তথ্য সাক্ষরতা প্রশিক্ষণ চালু করা; স্বল্পমেয়াদি ও চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের জন্য ন্যায়সংগত নীতি ও পারিশ্রমিক নিশ্চিত করা; ব্যবস্থাপকদের জন্য প্রশিক্ষণ, প্রতিক্রিয়া প্রদান ও সংঘাত–সমাধান দক্ষতা উন্নয়ন করা; এবং বছরে অন্তত দু’বার পূর্ণাঙ্গ প্রতিক্রিয়া পর্যালোচনা নেওয়া।
কেন এখনই শুরু করবেন?
এআই কোনো সাময়িক উপকরণ নয়; এটি গভীর সাংগঠনিক সংস্কৃতির পরিবর্তনের সূচনা। আজ যারা শেখা ভুলে আবার শিখতে পারে, নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি আঁকতে পারে এবং মানবিক নেতৃত্বকে শক্তিশালী করে, আগামীকাল তারাই বাজারে এগিয়ে থাকবে। দেরি করলে প্রযুক্তি নয়, বরং মানসিকতার ঘাটতিই পিছিয়ে দেবে। এআই যুগ শিখিয়েছে—নেতৃত্ব মানে কেবল কর্তৃত্ব বা অতীত অভিজ্ঞতার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা নয়। কার্যকর নেতৃত্ব হলো গতিশীল দক্ষতার সমন্বয়। বিশেষ করে পুরোনোকে ছাড়তে পারা ও নতুনকে গ্রহণের সাহস, স্পষ্ট কিন্তু নমনীয় দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি, মানুষের সঙ্গে গভীর সংযোগ গড়ার আবেগনির্ভর বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগানো।
ভুলে গেলে চলবে না—প্রযুক্তি পথ দেখায়, কিন্তু মানুষই সেই পথের দিশা দেয়। যিনি ডেটার শীতল নির্ভুলতার সঙ্গে মানবিক উষ্ণতার সেতুবন্ধন ঘটাতে পারবেন—সত্যিকার অর্থেই তিনিই হবেন আগামী দিনের কার্যকর নেতা।
এম এম মাহবুব হাসান : ব্যাংকার, উন্নয়ন গবেষক ও লেখক
মন্তব্য করুন