ঢাকার প্রতিষ্ঠার ৪১৫তম বছরে এসে, ঢাকার এত শত অর্জনের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে ঢাকার প্রাণ, মানুষ, পাখির গান আর সবুজের গল্প। আজ ঢাকার পরিমাপক অর্থ, দৌলত, বনেদিপনা—অথচ সামাজিক সম্পর্ক, মানুষ, আড্ডা, প্রকৃতিই ছিল ঢাকার প্রাণ। সবুজের মাঝে ধূসর ঢাকা আজ উল্টে ধূসরের মাঝে কয়েক ফোঁটা সবুজের ঢাকায় বদলে গেছে।
অ্যাপার্টমেন্টের ঢাকায় পাশের ফ্ল্যাটটির বাসিন্দার নামটিও জানা হচ্ছে না; অথচ এক ছাদের নিচে থাকা হয়ে যাচ্ছে একাধিক বসন্ত।
শামসুর রাহমান থেকে রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ হয়ে ইমতিয়াজ মাহমুদ—আজকের ঢাকায় তারা কি কবি হয়ে উঠতে পারতেন? সবুজের বদলে কংক্রিটের ধূসর রঙে প্রতিফলিত হয়ে তাদের ভাবনাগুলো কি আমাদের ছুঁয়ে যেত? নাকি চাপা পড়ে যেত কংক্রিটের স্তূপে?
গবেষণা বলছে, ১৯৯১ থেকে ২০১৯ অবধি ঢাকার আয়তন বেড়েছে বছরে ৮ শতাংশ করে। শুধু ১৯৯৯ থেকে ২০১৪—এই ১৫ বছরেই ঢাকার মাঝে সংযুক্ত হয়েছে স্থাপনাসহ ১২,১৫৬ হেক্টর জায়গা। প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ৮০ হাজার মানুষ নিয়ে প্রায় আড়াই কোটি মানুষের ঢাকা আজ শুধু টাকা বানানোর মেশিনেই পরিণত হয়েছে।
জনসংখ্যার ভারে নুয়ে পড়া রাজধানী গত তিন দশকে হারিয়েছে ৫৬ শতাংশ সবুজ ভূমি। ১৯৮৯ থেকে ২০২০-এ যা ১২,৭৪৫ হেক্টর থেকে ৫,৫৯৯ হেক্টরে নেমে এসেছে।
শুধু যে ঢাকার সবুজই আকাশচুম্বী দালানের কালো থাবায় আর উন্নয়নের মহাযজ্ঞে বিলীন হয়েছে তা নয়, ২০১০ থেকে ২০১৯—মাত্র ৯ বছরে এ শহরের ২৩ শতাংশ জলাভূমি ভরাট হয়ে বাড়িঘর, রাস্তা, কারখানায় পরিণত হয়েছে। বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বলছে প্রতিবছর রাজধানীতে ভরাট হচ্ছে ২,৫০০ একর জলাভূমি। কিছু দশক আগেও নৌকায় করে এক মাথা থেকে আরেক মাথায় যাওয়ার ঢাকায় জলাভূমি কমে ২০২৪ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ১৬.৯১ বর্গকিলোমিটারে। অথচ ১৯৮৯ সালেও যা ছিল ৮২.২৯ বর্গকিলোমিটার। সংখ্যার হিসাবে বেহাত জলাভূমির পরিমাণ প্রায় ৮০ শতাংশ।
এ নিয়ে শব্দ কম। আলোচনাও সীমাবদ্ধ পরিবেশবাদী, বিশেষজ্ঞ, অল্প কিছু সচেতন নাগরিক ও গবেষণাপত্রের মধ্যেই। ৫০ থেকে ৯০-এর শেষ অবধি ঢাকার বাজারগুলোয় ঢাকার মাছেই সয়লাব ছিল, চাহিদাও ছিল। ভোর বলতেই কাকডাকা ভোর ছিল। গাছগাছালি, সবুজে ঘেরা স্থান, জলাধার—আবার তা ঘিরে গড়ে ওঠা বাস্তুসংস্থান আজ প্রায় জাদুঘরে চলে গেছে। শুধু যে সবুজ, প্রকৃতি, জলাশয় নিধন হয়েছে তা নয়। হুট করে হারিয়ে গেছে খেলার মাঠও।
রাজউকের সমীক্ষায় দেখা যায়, ২০২২ সালে রাজধানীর ১২৯টির মাঝে ৩৭টি ওয়ার্ডে কোনো খেলার মাঠ বা পার্ক নেই। বস্তুত সবুজ বা মুক্ত বাতাস নেই। অথচ এই খেলার মাঠ, পার্কের যে মূল হিস্যা শিশুরা, তারা এ নগরের ৪০ শতাংশ। পিচঢালা রাস্তা আর কংক্রিটের নিচে চাপা পড়ে আছে একাধিক প্রজন্মের শৈশব, স্মৃতি, বন্ধুত্ব, সম্পর্ক, আর এ শহরের বাসিন্দাদের ইতিহাস।
অথচ এতে কারও তেমন কোনো সাড়াশব্দ নেই। খোদ সরকারি বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা আবার বলছে প্রতি ১২,৫০০ মানুষের জন্য থাকতে হবে ২ একর খেলার মাঠ। সে হিসাবে এ শহরে ১,১৩৭ একর খেলার মাঠ সঙ্গে ১,৮৭৬ একর পার্ক থাকবার কথা ছিল।
আমরা খেলার মাঠে শুধু খেলার মাঠ হারাইনি তা নয়; আমরা ইন্টারনেট, মোবাইল আসক্ত, রোগাক্রান্ত, স্থূলকায় একটা প্রজন্মের সৃষ্টি করছি। আমরা কেউ কাউকে না চেনা এক সমাজের দিকে যাচ্ছি। যে সমাজে কবি হবে না, সম্পর্ক হবে না, পাখির গান হবে না, আড্ডা হবে না, নিঃস্বার্থ বন্ধুও হবে না। ঢাকার রেস্তোরাঁ ব্যবসার যে ঊর্ধ্বগতি তার পেছনেও অন্যতম কারণ সবুজ, খোলা মাঠ, পার্কের বিলীন। মাঠ, পার্কের সন্ধ্যার পরের আড্ডা রেস্তোরাঁর বদ্ধ খাঁচায় চলে গেছে। তাও আবার মাসে এক-দুবারের জন্য। আবার সে আকাশচুম্বী ভবনে রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়ে আগুনে পুড়ে মরছে মানুষ।
শুধু যে আমাদের সমাজব্যবস্থাই ভেঙে পড়ছে, তা নয়। হুট করে গত কয়েক বছর ধরে গ্রীষ্মকালে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো আসছে হিট ওয়েভ। মানুষের স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হচ্ছে, মানুষ হিট স্ট্রোকসহ গরমজনিত রোগাক্রান্ত হয়ে আর্থিক, শারীরিকভাবে সর্বস্বান্ত হচ্ছে, হারাচ্ছে জীবনও। অথচ জলাভূমি, সবুজ, মাঠে ঘেরা ঢাকা অনেক শীতল ছিল। রোদ নরম ছিল। বৈজ্ঞানিক গবেষণা বলছে, গত বিশ বছরে এ শহরের তাপমাত্রা বেড়েছে ২.৭৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গত ৩০ বছরে তাপদাহপূর্ণ দিনের সংখ্যাও (৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তদূর্ধ্ব) বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। অথচ অবকাঠামো দিয়ে না মেপে আমরা যদি ঢাকাকে সামাজিক মূলধন, সবুজ, সংস্কৃতি, প্রকৃতি দিয়ে মাপতাম— এ শহর আজও শীতল থাকত, ধীরে ধীরে বসবাসের অযোগ্য হতো না।
প্রায় ৩ কোটি জনসংখ্যার মানুষের এ নগরীতে প্রতি বছর যোগ হচ্ছে গড়ে আরও ৫ লাখ মানুষ। বিশালসংখ্যক জনসংখ্যায় সৃষ্ট মানুষের আবাসন, ব্যবসায়িক চাহিদা মেটাতে গিয়ে যে এক আকাশচুম্বী, অবসবাসযোগ্য, উত্তপ্ত উনুনের মতো নগরীতে পরিণত হচ্ছে ঢাকা, এর কোনো সম্ভাব্য নিয়ন্ত্রণ চোখে পড়ছে না, পড়ছে না চোখে মুক্তির পথও।
অথচ ঢাকার বিস্তৃত হতে পারত প্রস্থে, লম্বে নয়। সেই বিস্তৃতি প্রস্থে কেন হয়নি, তা এক বিরাট আলাপ। তবে তার অন্যতম মূল কারণ নাগরিক সুবিধার ঘাটতি, ট্রাফিক সমস্যা, জ্যাম, জনদুর্ভোগ তথা যাতায়াতে লম্বা সময় নষ্ট। এই গণপরিবহন ব্যবস্থার মাঝেও শুভংকরের ফাঁকি। প্রাথমিক বাস ব্যবস্থার উন্নয়ন বা স্থায়ী উন্নত বন্দোবস্ত না করেই দ্বিতীয় ধাপ মেট্রোতে চলে গেছি আমরা। বিশাল এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণও করে ফেলেছি। নগর পরিকল্পনাবিদ, স্থপতি, বিশেষজ্ঞ, সরকারের কর্তাব্যক্তি—কারও মাথায় কি এ প্রশ্ন এলো না? স্কুল পাস না করে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া যায় না?
এ শহরের বায়ুও কদিন বাদে বাদে দূষণে চ্যাম্পিয়ন হয়। বছরে খুব অল্প কদিনই আমরা বায়ুদূষণের সেরা ১০ তালিকার বাইরে থাকি। আমাদের খেলার মাঠ, সবুজ, প্রকৃতি, জলাভূমি, বাতাস—সবই আমাদের ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিচ্ছে। হিসাব বলছে ঢাকার নাগরিক মানুষের ছোট-বড় রোগের একটা বড় কারণ বসবাস-অযোগ্যতা সৃষ্ট কারণ থেকে। এ নগরের মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যও মারাত্মকভাবে আক্রান্ত করছে দিনে রাতে বছরব্যাপী অন্ধকারের মাঝে বসবাস। কারণ আমাদের শহরের জানালাগুলো থেকে আকাশ দেখা যায় না, সূর্যের আলো পৌঁছায় না।
এখন প্রশ্ন এর সমাধান কী? ঢাকার এত বড় ক্ষতি ঠেকাতে কি কোনো আইন ছিল না? সরকারের ভূমিকা কী ছিল?
ঢাকাকে রক্ষায় সরকারি আইন অবশ্যই আছে ডজনখানেক। কিন্তু পরিবেশ রক্ষার গুরুদায়িত্বে থাকা পরিবেশ অধিদপ্তরসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থার লোকবল সংকট, আইন প্রয়োগে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপসহ অন্যান্য কারণ আজ শুধু ঢাকাই নয়, বাংলাদেশের প্রতিটি নগরকে বসবাস অযোগ্য করে তোলার পেছনে দায়ী। আরও দায়ী ডজনের পর ডজন করা আইনের মাঝে ফাঁক, নীতিনির্ধারণে এ শহরের সাধারণ মানুষের অনুপস্থিতি আর আইন প্রণয়নে বসে থাকা ভূমিদস্যু, পরিবেশখেকোদের দল।
অর্থ দিয়ে যেদিন আমরা মানুষ, শহর, সমাজকে মাপা শুরু করেছি, সেদিন থেকেই ঢাকার মৃত্যুর ক্ষণগণনা শুরু হয়ে গেছে। আমরা সফলতা মেপেছি অর্থে, অট্টালিকায়। অথচ এ নগরের সফলতা হওয়ার কথা ছিল নাগরিকের কোলাহল, প্রাণ, কলকাকলি, পরিবেশ, প্রকৃতি। মেগাপ্রকল্পের জাঁতাকলে পিষ্ট এ নগরের নাগরিকের কথা বলার কথা ছিল রাষ্ট্রের, সরকারের। নতুন বন্দোবস্তে আমরা দেখলাম পান্থকুঞ্জকে বাঁচাতে নাগরিকরা নেমে এলেন, আওয়াজ তুললেন। হৈচৈ হলো সবার মাঝে, শুধু নীরব থাকল রাষ্ট্রযন্ত্র। আন্দোলনকারীরাও নিরুপায় হয়ে আশু সমাধান না পেয়ে নিজেরাই আদালত করে, নিজেই রায় নিয়ে চলে গেলেন। নামে, চরিত্রে, আকাঙ্ক্ষায় পরিবর্তন হলেও পরিবেশের ব্যাপারে ভূমিকায় বন্দোবস্ত আগেরটাই রয়ে গেল কি না, এই সিদ্ধান্ত ইতিহাস নেবে।
এ শহরের এত বড় বিপদ ঘটিয়ে আমরা ঘাপটি মেরে বসে আছি। ইতিহাস দেখে মনে রাখা ভালো, প্রকৃতি সব কিছুর হিসাব নেয়—হয় ধীরে নয় জোরে।
লেখক : বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রিসার্চ ফেলো, ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি)
মন্তব্য করুন