বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো সম্প্রতি বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। গেল সপ্তাহে রাশিয়ায় ওয়াগনার বাহিনীর সশস্ত্র বিদ্রোহের অবসানে মধ্যস্থতা করে আন্তর্জাতিক রাজনীতির মঞ্চে নিজেকে প্রকাশ করছেন তিনি। মিডিয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কোর নাম। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেই বেলারুশের এই একনায়ক তার দেশের মাটিতে রাশিয়ান কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েনের ঘোষণা করেছিলেন। প্রয়োজনে এসব পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে দ্বিধা করবেন না বলেও জানান তিনি।
যে চুক্তিতে আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো রুশ প্রশাসন এবং ইয়েভজেনি প্রিগোজিনের মধ্যে সমঝোতা করলেন আমরা এখনো তার বিশদ জানি না। প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এ সময় লোকচক্ষুর আড়ালেই ছিলেন। ওয়াগনার বাহিনী মস্কোর দিকে অগ্রসর হওয়ার পর ধারণা করা হচ্ছিল ওয়াগনার প্রধান ইয়েভজেনি প্রিগোজিনকে হত্যার নির্দেশ দেবেন পুতিন। এ সময় ইয়েভজেনি প্রিগোজিনের সামনে কয়েকটি বিকল্প দেন আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো।
মঙ্গলবার বেলারুশের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, প্রেসিডেন্ট পুতিনকে তাড়াতাড়ি কিছু না করার জন্য রাজি করান আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো। আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কোর জোর প্রচেষ্টায় সংঘর্ঘ এড়ানোর সুযোগ পায় দুপক্ষ। এই জটিল পরিস্থিতিতে নিজের আত্মবিশ্বাসী চরিত্রের পরিচয় দিয়েছেন আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো। এটি তার বিশ্বনেতা হিসেবে নিজেকে তুলে ধরার আকাঙ্ক্ষাকেও প্রতিফলিত করে।
বেলারুশের প্রেসিডেন্টের এই আকাঙ্ক্ষা অবাস্তব বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, প্রিগোজিনকে পিছিয়ে দেওয়ার জন্য আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কোর ভূমিকাই মুখ্য ছিল। প্রেসিডেন্ট পুতিনকে একজন বিদ্রোহীর সাথে সরাসরি সম্পৃক্ততার মাধ্যমে নিজেকে হেয় করা থেকে বাঁচিয়েছেন লুকাশেঙ্কো।
এটা সত্য যে, বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো স্বাধীন কোনো রোল প্লে করছেন না। তিনি ক্রেমলিন নীতির একটি হাতিয়ার হিসেবে ভূমিকা রাখছেন এবং বছরের পর বছর ধরে রেখেছেন। তিনি আশা করেন, প্রয়োজনের সময় ক্রেমলিন তাকে সাহায্য করবে এবং বেলারুশের ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখবে।
১৯৯৪ সালে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো বৃহৎ ঘটনাগুলোতে নিজেকে জড়ানোর চেষ্টা করেছেন। ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে তিনি বেলারুশ এবং রাশিয়ার মধ্যে একটি ইউনিয়ন-রাষ্ট্র তৈরি করতে ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি আশা করেছিলেন, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে রুশ নেতা বরিস ইয়েলৎসিন অনাগ্রহের সুযোগে এই ইউনিয়ন-রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দেবেন তিনি।
কিন্তু মি. ইয়েলৎসিনের উত্তরসূরি হলেন ভ্লাদিমির পুতিন, যার একটি ছোটখাটো ইউরোপীয় রাষ্ট্রের প্রধানের নেতৃত্ব গ্রাহ্য করার কোনো ইচ্ছা ছিল না। তাই তিনি ক্ষমতা কুক্ষিগত করার সাথে সাথে বেলারুশের অর্থনীতিকে গভীরভাবে রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল করে ফেলেন। বিশেষ করে প্রচুর ভর্তুকিযুক্ত রাশিয়ান জ্বালানির ওপর। এরপর পুতিন বেলারুশের সার্বভৌমত্বকে নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করেন। একটি প্রধান বিশ্বশক্তির নেতৃত্ব দেওয়ার পরিবর্তে আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো নিজেকে একটি শ্বাসরুদ্ধকর রাশিয়ান আলিঙ্গনের মধ্যে আবিষ্কার করেন।
২০০৪ সালে রাশিয়া অবৈধভাবে ক্রিমিয়া দখল করার পর, আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো নিজেকে জাহির করার সবচেয়ে সুবর্ণ সুযোগ দেখেছিলেন। আক্রমণের পরে রাশিয়া ও পশ্চিমের মধ্যে বিচ্ছিন্নতার সুযোগ নিয়ে তিনি বেলারুশের রাজধানী মিনস্ককে পূর্ব-পশ্চিম সংলাপের একটি ‘নিরপেক্ষ’ স্থান হিসেবে প্রচার করেন। সংকট সমাধানে শহরটি রাশিয়ান ও ইউরোপীয় নেতাদের আলোচনার ভেন্যুতে পরিণত হয়। এ সময় সেখানে যুদ্ধরত দলগুলো এবং রাশিয়ান ও ইউরোপীয় নেতারা একত্র হয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে সেখানে হওয়া সমঝোতা চুক্তিগুলো মিনস্ক চুক্তি হিসেবে নামকরণ করা হয়। যে চুক্তিতে ছিল যুদ্ধবিরতি এবং ইউক্রেনের বিদ্রোহী অঞ্চলগুলোকে পুনঃএকত্রীকরণের বিধানসমূহ।
যদিও এ চুক্তি কখনোই তা কার্যকর করা হয়নি তা সত্ত্বেও, আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো আলোচনাস্থল হিসেবে মিনস্কের সম্ভাব্যতা দেখিয়েছিলেন। ২০১৮ সালে মিনস্ক ডায়ালগ ফোরামের উদ্বোধন করেন লুকাশেঙ্কো, যা আমেরিকান, ইউরোপীয় এবং রাশিয়ান বৈদেশিক নীতি বিশেষজ্ঞদের বৈশ্বিক সমস্যা নিয়ে বিতর্কের জন্য একটি জায়গায় একত্র করেছিল। এই ফোরাম আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কোকে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে উত্তেজনা কমাতে অনন্যভাবে যোগ্য একজন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করতে একটি অমূল্য প্ল্যাটফর্ম প্রদান করে।
বেলারুশের বিকাশমান প্রযুক্তি শিল্পের মাধ্যমে রাশিয়ার ওপর নির্ভরতা কমানোর দ্বিতীয় সুযোগ আসে লুকাশেঙ্কোর সামনে। ২০০০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে প্রযুক্তি শিল্পে বেলারুশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির একটি মূল চালক হিসেবে জায়গা করে নেয়। ২০২০ সাল নাগাদ বেলারুশের মোট জিডিপির সাত শতাংশ আসে এখান থেকে। এটি বেলারুশের একটি গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি খাতও ছিল। প্রযুক্তি শিল্পের বেশিরভাগ পণ্য পশ্চিমে পাঠায় বেলারুশ।
বেলারুশের সুশিক্ষিত জনশক্তি এবং কম মজুরি পশ্চিমা বিনিয়োগকারীদের সে দেশে বিনিয়োগ করতে আকৃষ্ট করে। প্রযুক্তি শিল্পের এই মুনাফা মিনস্ককে একটি আরামদায়ক ইউরোপীয় শহরে রূপান্তরিত করার জন্য তহবিল সরবরাহ করতে সাহায্য করে। যা পূর্ব-পশ্চিম মিলনস্থল হিসেবে এর আবেদন বাড়িয়ে তোলে।
কিন্তু মি. লুকাশেঙ্কোর সৌভাগ্য কয়েক বছর পরেই থেমে যায় এবং এটি ছিল সম্পূর্ণরূপে তার নিজের কর্মফল। ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে স্পষ্ট কারচুপি করেন তিনি। নির্বাচনে লুকাশেঙ্কো 80 শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী হওয়ার দাবি করেন এবং একটি বিশাল দেশব্যাপী প্রতিবাদ আন্দোলনকে জোর প্রদর্শন করে থামিয়ে দেন তিনি। এ সময় লুকাশেঙ্কো সরকার কয়েক হাজার নাগরিককে আটক করে। কারাগারে নির্যাতন চালানো হয় শত শত মানুষের ওপর। কয়েক ডজন সংবাদমাধ্যম বন্ধ করে দেওয়া হয়।
ক্ষমতায় টিকে থাকতে এ সময় লুকাশেঙ্কো রাশিয়ার সাহায্য গ্রহণ করে, যেটি তার দেশের স্বায়ত্তশাসনকে মূল্য দিতে ইচ্ছুক ছিল না।
প্রেসিডেন্ট পুতিন লুকাশেঙ্কোর কঠোর কৌশলকে সমর্থন করে তাকে উদ্ধারে এগিয়ে আসেন। তিনি মিনস্কের ঋণের বোঝা লাঘব করার জন্য ১.৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণ অনুমোদন করেন। বিদেশি শক্তির চাপ থেকে লুকাশেঙ্কোকে হেফাজত করেন পুতিন। পুতিন লুকাশেঙ্কোর পক্ষে প্রচারের জন্য ‘মিডিয়া’ বিশেষজ্ঞদের প্রেরণ করেন এবং একটি রাশিয়ান ‘রিজার্ভ পুলিশ’ গঠনের ঘোষণা দেন যা পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে বেলারুশে মোতায়েন করা যেতে পারে।
লুকাশেঙ্কোর বিরুদ্ধে যারা বিক্ষোভের অগ্রভাগে ছিল তাদের দেশ থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়। এ সময় পশ্চিমারা বেলারুশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় এবং প্রেসিডেন্ট লুকাশেঙ্কোকে কূটনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করার কারণে এটি মিনস্ককে শুধু একটি মিটিং স্থান হিসেবে সীমাবদ্ধ করে তোলে। রাশিয়া ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন আক্রমণের জন্য বেলারুশকে একটি মঞ্চের স্থল হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে যায়। লুকাশেঙ্কো প্রতিরোধ করার কোনো অবস্থানেই ছিলেন না। কারণ, ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকার জন্য তিনি ক্রেমলিনের ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন।
এখন আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো মি. প্রিগোজিন এবং তার কিছু অজানাসংখ্যক ভাড়াটেদের আশ্রয় দিতে রাজি হয়েছেন যারা তার সাথে বেলারুশে যাবেন। পুতিনের রোষাণলে পড়ে অন্যদের ভাগ্যে যা ঘটেছিল তা জেনে প্রিগোজিন বেলারুশে নিরাপদ বোধ করতে পারেন না। প্রিগোজিন জানেন, পুতিনের সিদ্ধান্তই বেলারুশের সিদ্ধান্ত। আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো তার ভূখণ্ডে প্রিগোজিনের মৃত্যুতে কোনোভাবেই উপকৃত হবেন না এবং তিনি সম্ভবত আশা করেন বেলারুশে প্রিগোজিনের অবস্থান সংক্ষিপ্ত হবে।
এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সত্ত্বেও, মি. লুকাশেঙ্কো সম্ভবত ওয়াগনার ও রুশ প্রশাসনের মধ্যে সমঝোতায় তার ভূমিকাকে অলঙ্কৃত করার লোভ প্রতিরোধ করতে সক্ষম হবেন না। তিনি ইতিমধ্যেই প্রেসিডেন্ট পুতিনকে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন বলে দাবি করেছেন। লুকাশেঙ্কো যতদিন পারেন মহান রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে খেলার চেষ্টা করবেন।
যাইহোক, কোনোকিছুতেই বাস্তবতার পরিবর্তন হবে না। এমনকি মি. লুকাশেঙ্কো তার গৌরবের ক্ষণস্থায়ী মুহূর্তে নিজেকে স্বাধীন এবং বিশ্ব রাজনীতির একজন নেতা হিসেবে দেখবেন। লুকাশেঙ্কো তার দেশের মানুষকে দেখাতে চাইবেন যে, বেলারুশ কীভাবে ইউরোপীয় বিষয়ে একটি সম্মানজনক খেলোয়াড় হিসেবে নিজেকে স্থাপন করতে সক্ষম। তিনি দেখাতে চান, বেলারুশ একটি গতিশীল প্রযুক্তি খাতের সাথে সাথে গঠনমূলক পূর্ব-পশ্চিম সংলাপের স্থান হিসেবে অগ্রাধিকার পাওয়ার দাবি রাখে।
মূল: থমাস ই. গ্রাহাম (Thomas E. Graham)
ভাষান্তর: মুজাহিদুল ইসলাম
মন্তব্য করুন