বছর ঘুরে এসে আবারও দুয়ারে হাজির ১৪ ডিসেম্বর। এ দেশটা আমাদের মায়ের মতো না, এ দেশটাই আমাদের মা। বাংলা মায়ের বুকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তার পরিবারের ওপর সংঘটিত নৃশংস হত্যাকাণ্ড, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক নিরস্ত্র ও ঘুমন্ত জাতির প্রতি নির্মমভাবে ঝাঁপিয়ে পড়া আর ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর স্বাধীনতার প্রাক্কালে এ দেশের সকল সূর্যসন্তান, ৩০ লাখ শহীদের দেশে যাদের মেধা আর জ্ঞান গরিমা ভবিষ্যতে স্বাধীনতাকে করে তুলত আরও বেশি অর্থবহ তাদের হত্যা করা হয়।
বাংলা মায়ের ইতিহাসে এ তিন হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য একটি আরেকটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। ঘাতকদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া, নেতৃত্বহীন করে দেওয়া, ভবিষ্যতে বাংলা নামক শব্দটি উচ্চারণ না করতে পারে সেই লক্ষ্য পূরণ করা। আর সেই লক্ষ্য পূরণে কখনো জেনারেল ইয়াহিয়া, কখনো জুলফিক্কার আলী ভুট্টো, কখনো জেনারেল নিয়াজী বলেছে ‘বাংলার সবুজ মঠকে বাঙালির রক্তে লালা করে দাও’, কখনো বলেছে ‘বাংলা শব্দ উচ্চারণকারীকে হত্যা কর’, আবার কখনো বলেছে ‘বাঙালি মায়েদের, মেয়েদের গর্ভে পাকিস্তানি সেনাদের সন্তান ধারণ করাও, যাতে ভবিষ্যতে বাংলার মাটিতে জন্ম নেওয়া সন্তানেরা পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধচারণ না করে।’
আর এ সকল লক্ষ্য পূরণে তাদের সর্বশেষ ধাপ ছিল ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর। ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হওয়ার পর, দীর্ঘ দুই শতাধিক বছর পরাধীনতার গ্লানি বহন করার পর, আমার দুঃখিনী বাংলার ভাগ্যাকাশে স্বাধীনতা অর্জনের ঠিক পূর্ব মুহূর্তেই।
১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের সর্বত্র বুদ্ধিজীবী ও উচ্চ শিক্ষিত শ্রেণিকে সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করার একটি আন্তর্জাতিক চক্রান্ত সফলভাবে বাস্তবায়ন করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগী আল বদর বাহিনী। এ দিনে তারা রাজধানী ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থান করা প্রখ্যাত সাংবাদিক, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ,চলচ্চিত্রকার, বিজ্ঞানী, লেখকসহ অসংখ্য প্রথিতযশা বাঙালি সন্তানকে ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। সেই হত্যাযজ্ঞের নির্মমতা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। সেই নির্মম হত্যাযজ্ঞের ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে দুঃখিনী বাংলার আকাশ বাতাস আজও উদাস হয়। ঘাতকদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের অর্জিত স্বাধীনতা যেন সফল ও অর্থবহ না হয়, বাঙালি জাতি তাদের সূর্য সন্তানদের হারিয়ে বিশ্বের বুকে যেন কখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে।
১৯৭১ সালের ২৭ ডিসেম্বর ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকার হেড লাইনে লেখা হয়েছিল ‘আর একটা সপ্তাহ সময় পেলে তারা সকল বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করত।’
বাঙালি জাতিকে বুদ্ধিমত্তা এবং শিল্প, সাহিত্য,সাংস্কৃতি ও কারিগরি উৎকর্ষের দিক থেকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে, বাংলার বুকে চিরকাল ঔপনিবেশিক শাসনের জগদ্বল পাথর চাপিয়ে দেওয়ার হীন উদ্দেশ্যেই বদর বাহিনী এ হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত করে।
১৯৭২ সালের ২ জানুয়ারী দৈনিক আজাদে প্রকাশিত অধ্যাপিকা হামিদা রহমানের লেখা ‘কাটাসূরের বধ্যঙূমি’ পড়ে জানতে পারা যায় ভয়াবহ এ হত্যা যজ্ঞের চরম নৃশংসতার কথা।
তিনি লিখেছেন, ‘আর একটু এগিয়ে যেতেই সামনে মস্তবড় দুটি মানুষ নাক কাটা, কান কাটা। মুখের কাছ থেকে কে যেন খামছিয়ে মাংস তুলে নিয়েছে, হাত পা বাঁধা।’
আর একটু এগিয়ে যেতেই বা হাতে যে মাটির টিপিটা ছিল তারই পাদ দেশে একটি মেয়ের লাশ। মেয়েটির চোখ বাঁধা। তার মুখ ও নাকের কোনো আকৃতি নেই। কে যেন অস্ত্র দিয়ে কেটে তা খামচিয়ে তুলে নিয়েছে। যেন চেনা যায় না। মেয়েটি ফর্সা ও স্বাস্থবতী। স্তনের একটা অংশ কাটা। বীভৎস চেহারার দৃশ্য বেশিক্ষণ দেখা যায় না। আর একটু দূরে যেতেই দেখতে পেলাম একটি কঙ্কাল। শুধু পা দুটো ও বুকের পাঁজরটিতে তখনো অল্প মাংস আছে। বোধ হয় চিল শকুনে খেয়ে গেছে। কিন্তু মাথার খুলিটিতে লম্বা লম্বা চুল। চুলগুলো ধুলো-কাদায় নিয়ে গিয়ে নারী দেহের সাক্ষ্যবহন করে।
আর একটু সামনে এগিয়ে দেখি, বেশ কয়েকজন লোক ঝুঁকে পড়ে কী যেন দেখছে। সামনে চেয়ে দেখি নিচু জলাভূমির ভেতর এক ভয়াবহ বিভৎস দৃশ্য। সেখানে একজন নয় দুইজন নয়, একবারে ১২-১৩ জন সুস্থ সবল মানুষ যেন শুয়ে আছে। তার পাশে আবার দুটো লাশ। একটি লাশের হৃৎপিণ্ড যেন ছিঁড়ে নিয়েছে। সেই হৃৎপিণ্ড ছিন্ন মানুষটি হলো ড. রাব্বী। পাশের একজন বলল মুনির চৌধুরীর লাশও এখানে ছিল। ড. রাব্বির লাশটা তখনো তাজা। জল্লাদ বাহিনী বুকের ভেতর থেকে কলিজাটা তুলে নিয়েছে। তারা জানত তিনি চিকিৎসক ছিলেন তাই তার হৃৎপিণ্ড ছিঁডে ফেলা হয়েছে।
তখনো দলে দলে নারী-পুরুষরা খুঁজে বেড়াচ্ছে তাদের হারিয়ে যাওয়া আত্মীয়স্বজনদের। কিন্তু তার চিনতে পারছে না বিভৎস লাশগুলো। প্রত্যেকটি লাশগুলোর গাঁয়ে তখনো অত্যাচারে দাঁগগুলো ঘায়ের মতো দগ দগ করে জ্বলছে। এমন পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড যে বিংশ শতাব্দীতে ঘটতে পারে তা সভ্য মানুষের বুদ্ধির অগোচরে।
ড. আলিম চৌধুরীর মত চক্ষু বিশেষজ্ঞ একদিনে তৈরি করা যাবে না। আর শহীদুল্লাহ কায়সারের মতো সাংবাদিক ও সাহিত্যিকে ও একদিনে তৈরি করা যাবে না। জহির রায়হানের মতো কথাসাহিত্যিকেও একদিনে তৈরি করা যায়নি। একদিনে তৈরি হয়নি শহীদ ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, শহীদ জ্যোর্তিময় গুহ ঠাকুরতা, ড. আলীম চৌধুরী, শহীদ এয়াকুব আলী, শহীদ সেলিনা পারভীন, শহীদ নজরুল ইসলাম, শহীদ মি. মুজিবুল হক চৌধুরী, শহীদ মশিউর রহমান, শহীদ কবি মেহেরুন্নেছা, শহীদ কবি মেহেরুন নেছা, শহীদ ছায়িদুল হক, শহীদ নির্মল কুমার চৌধুরী,শহীদ সাংবাদিক নাজমুল হক, শহীদ রনদা প্রসাদ সাহা ও পুত্র রবীন সাহা, শহীদ সাংবাদিক নাজমুল হক শহীদ পারু ও চারু।
বাংলা মায়ের কোলে তারা একদিনে বড় হয়ে উঠেনি। বাংলা মা তাই তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হারিয়ে দুঃখে আজও উদাসিনী হয়ে থাকে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যায় সাহায্যকারী দলগুলোর মধ্য জামায়াত ইসলামের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে ঘৃণ্য ও জঘন্য। মওদুদী, গোলাম আযমরা শুধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধীতাই করেনি , লাখ লাখ বাঙালি হত্যার মিশনে নেতৃত্ব দিয়েছে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্বিচার গণহত্যার সহযোগিতা করেই জামায়াত ইসলাম ক্ষান্ত হয়নি, বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করতে তারা গড়ে তুলেছিল - বদর বাহিনী নামে এক সশস্ত্র এক গুপ্ত সংগঠন।
মুজিব বাহিনীর হাতে স্বাধীনতার লগ্নে যেসব বদর বাহিনীর সন্ত্রাসী পান্ডারা ধরা পডেছিল তারা স্বীকার করেছিল যে, ‘আর কয়েকটা দিন সময় পেলে তারা বাংলাদেশের সকল বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করত।
পাক হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর আলবদর বাহিনীর সদস্যরা যখন পালিয়ে গেল তখন তাদের হেড কোয়ার্টারে পাওয়া গেল এক বস্তা চোখ। এদেশের মানুষের চোখ। এদেশের চক্ষু ডাক্তারদেরই চোখ। তাদের চোখকে উপড়ে ফেলা হয়েছে কারণ তারা এ বাংলার মানুষের চোখের চিকিৎসা করত।
আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা মওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে আয়োজিত এক আলোচনাসভায় বলেছিলেন, সেদিন বদর বাহিনীর হেডকোয়ার্টারের পাশে এক বাড়িতে গিয়েছিলাম। তোলাবায়ে আরাবিয়া ও ইসলামী ছাত্র সংঘের ছেলেদের দ্বারা গঠিত এ আলবদর বাহিনী যে অত্যাচার চালিয়েছে তার অনেক কাহিনী শুনেছি।
তিনি আরও বলেছিলেন, ‘খুনিদের এ বাহিনীর নাম দেওয়া হয় বদর বাহিনী। একি কোনো মনঃপুত নাম! যে বদর যুদ্ধ ছিল আদর্শের জন্য ইসলামের প্রথম লড়াই। সেই যুদ্ধের সঙ্গে কী কোনো সংযোগ এ নৃশংসতার মধ্য ছিল।’
তিনি আরও বলেছিলেন, ‘হানাদারদের সহযোগী এ বদর বাহিনী শুধু ইসলাম ও মানবতার শত্রুই ছিল না তারা ছিল জালেম।’
অত্যন্ত শ্রদ্ধাভরে তাই প্রতি বছর ১৪ই ডিসেম্বর আমরা স্মরণ করি বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। তারা আজ বেঁচে থাকলে হয়তো স্বাধীন বাংলাদেশে পরাজিত শক্তি আবার ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সুযোগ পেত না। স্বাধীনতার অর্ধদশক পর বাংলার রাজনীতিতে তাদের উত্থান হত না। তারা বেঁচে থাকলে বঙ্গবন্ধু সরকারের বিপক্ষে ১৯৭২-৭৫ সাল পর্যন্ত করা কোনো ষড়যন্ত্র হয়তো বাস্তবায়ন হতো না। তারা বেঁচে থাকলে বাংলার ইতিহাসকে হয়তো ১৯৭৫ সালের কালো রাতের সাক্ষী হতে হতো না। তারা বেঁচে থাকলে আমাদের অর্জিত স্বাধীনতা হত আরও বেশি অর্থবহ, দুর্নিবার ।
মরণ সাগর পাড়ে তোমরা অমর, আমরা তোমাদের স্মরণ করি।
লেখক : মোতাহার হোসেন প্রিন্স, রাজনৈতিক কর্মী
মন্তব্য করুন