জেরেমি হডজ
প্রকাশ : ০৭ জুলাই ২০২৩, ০৩:৫৮ পিএম
আপডেট : ০৭ জুলাই ২০২৩, ০৪:০৫ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
ফরেন পলিসি থেকে

ওয়াগনারের বিদ্রোহে যেভাবে ফায়দা লুটছে ইরান (শেষ পর্ব)

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি। ছবি : সংগৃহীত
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি। ছবি : সংগৃহীত

প্রথম পর্বের লিঙ্ক

উত্তর-পূর্ব সিরিয়ায় ২০২১ সালের এপ্রিলে আদিবাসী নিয়ন্ত্রিত একটি সামরিক গোষ্ঠী যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত কুর্দিস বাহিনীর হামলা থেকে বাঁচার জন্য আবেদন করলে তা এড়িয়ে যায় রাশিয়ানরা। যুদ্ধে হারার পর ঘরছাড়া অবস্থায় আদিবাসী যোদ্ধারা ইরানের জন্য তাদের দুয়ার খুলে দেয়। ইরানের মাধ্যমে তারা নতুন ভারী অস্ত্রশস্ত্র এবং বেতন পান।

দক্ষিণ সিরিয়ায় সিরিয়ান আর্মির অষ্টম ব্রিগেড রাশিয়ার সবচেয়ে বিশ্বস্ত ইউনিট ছিল। যদিও ২০২১ সালের শেষ দিকে মস্কো এই দলটির ওপর হতাশ হয়ে পড়ে। ইসলামিক স্টেটের সঙ্গে লড়াইয়ে যথেষ্ট সংখ্যক সৈন্য পাঠাতে ব্যর্থ হওয়ায় দলটির সৈন্যদের বেতন অর্ধেক করে দেয় মস্কো। ২০২২ সালে তারা দলটির সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে অষ্টম ব্রিগেড সিরিয়ার মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স ডিরেক্টরেটের অধীনে ইরানের অন্যতম ক্ষমতাবান ব্রিগেড হিসেবে কাজ করছে। এই ব্রিগেডটি হিজবুল্লাহ ও অন্যান্য গ্রুপের মাধ্যমে প্রাদেশিক মাদক পরিবহন ও অন্যান্য অপরাধ দমনে সফলভাবে কাজ করছে।

একইভাবে ২০২২ সালের জুলাইতে পূর্ব দেইরে হাসসান আল গাধবানের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্সেসের সৈন্যরা মস্কোর সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করে। ছয় মাস ধরে রুশরা তাদের বেতনভাতা দিতে অক্ষম হলে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ ঘটনার পরেই গ্রুপটি ৪র্থ ডিভিশনের (যেটি সিরিয়ার সর্বোচ্চ অত্যাধুনিক সৈন্যদের ইরান সমর্থিত গ্রুপ) সঙ্গে যোগ দেয়। এই গ্রুপটির প্রধান মাহের আল আসাদ। তিনি সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের ছোটভাই যিনি সিরিয়ার মাদক ব্যবসার শীর্ষে অবস্থান করছেন।

যদি রুশরা সিরিয়ান যোদ্ধাদের আনুগত্য হারায়, তাহলে মস্কো কোনোভাবেই আসাদকে চাপ দিয়ে ক্রেমলিনের মাধ্যমে সিরিয়ান এলাকা ব্যবহার করে ন্যাটোকে হুমকি দিতে পারবে না এবং আফ্রিকাও তাদের বিচরণ বাড়াতে পারবে না।

২০১৮ সালে ইসলামিক স্টেটের হারের পর রাশিয়া সিরিয়ার ভঙ্গুর সেনাবাহিনীকে দাঁড় করাতে আক্রমণাত্মক পরিকল্পনা হাতে নেয়। মস্কোর উদ্দেশ্য ছিল, যুদ্ধ-পরবর্তী অবস্থায় রাশিয়া সিরিয়াকে সঙ্গী হিসেবে পেতে চেয়েছিল। রাশিয়ান বলতে পারা সিরিয়ান জেনারেলদের পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিল এবং শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে অনেককে বাদ দেওয়া হয়েছিল। এসময় ইরানি মদতপুষ্ট সৈন্যদের কাছ থেকে সামরিক পরিচয়পত্র ও অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়া হয়। তাদের অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য করা ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারও করা হয়।

এসব কর্মকাণ্ড রাশিয়ান সেনার বিরুদ্ধে ইরানি মদতপুষ্ট সৈন্যদের ভেতর অসন্তোষ জাগিয়ে তোলে, তারা অস্ত্র জমা দিতে অস্বীকৃতি জানায় এবং এর বদলে সিরিয়ার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তাদের অনুপ্রবেশ বাড়াতে থাকে।

২০২০ সাল নাগাদ পুরোপুরি হাল ছেড়ে দেয় রাশিয়া। কোভিড-১৯ মহামারির কারণে অর্থনৈতিক সংকোচন এবং স্থিরতা ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হয়ে রাশিয়া সামরিক ঠিকাদার ও সৈন্যদের নিয়ে অনিয়মিত বাহিনী গড়ে তোলে এবং বর্তমানে নামমাত্র উপায়ে তারা স্বার্থ-সিদ্ধিতে কাজ করে যাচ্ছে।

এই পরিবর্তন তুরস্কের প্রতি রাশিয়ার যুদ্ধংদেহী মনোভাবে আরও তরাণ্বিত করেছে। ২০২০ সালে তুরস্কের বিরুদ্ধে মস্কো দুটি ভিন্ন দ্বন্দ্বের সময় প্রক্সি যুদ্ধে অংশ নেয় এবং এরই ধারাবাহিকতায় নতুন সদস্যের চাহিদা তৈরি হয়। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর এবং ২০২০ সালের আগস্টে তুরস্ক সমর্থিত সরকারের বিরুদ্ধে দলত্যাগী যুদ্ধবাজ খলিফা হাফতারের হয়ে ওয়াগনার এক ডজনেরও বেশি ব্যক্তি মালিকানাধীন নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে হাজারো সিরিয়ান যোদ্ধাদের দলে ভেড়ান।

যুদ্ধের সময় ওয়াগনার দুটি বড় তেলক্ষেত্র ও একটি পেট্রোকেমিক্যাল কমপ্লেক্সের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নেন এবং বিভিন্ন দ্রব্যাদি রপ্তানি করা শুরু করেন। এভাবে ওয়াগনার গ্রুপ বিভিন্ন বাধা-বিপত্তি তৈরি করে জ্বালানি বাজার নিয়ন্ত্রণ করতেন। একই সময়ে ওয়াগনার সমর্থিত সামরিক দলগুলো তুরস্ক সমর্থিত বিদ্রোহীদের সঙ্গে সিরিয়ার ইদলিবে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে এবং এই কারণে আসাদ বড় ধরনের লাভবান হন।

এসব কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতায় রাশিয়া দ্রুত নিজেদের সুগঠিত করতে শুরু করে। এ সময় তারা সিরিয়ার কেন্দ্রে ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। ২০২০ সালের আগস্ট থেকে ২০২১ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত দীর্ঘ আট মাসে সিরিয়ার মরুভূমিতে প্রায় ৪৬০ জন সৈন্য, নাগরিককে হত্যা করে। এ সময় আহত হয় আরও শত শত মানুষ। এসব আক্রমণের বেশিভাগ দেশটির গ্যাস উত্তোলনকারী বিভিন্ন প্ল্যান্ট, তেলক্ষেত্রে চালানো হয় কেননা এসব স্থানে মাসোয়ারা তুলতে যেত ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিরা।

ইসলামিক স্টেটের আক্রমণ সিরিয়া রাশিয়ার মূল উদ্দেশ্যে আঘাত হানে। এর ফলে মস্কোও তার সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে। সুকায়লাবিয়া থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈন্যসহ সিরিয়ার ভাড়াটে যেসব সৈন্যকে লিবিয়ায় পাঠানো হয়েছিল তাদের পুনরায় আনা হয়। সুকায়লাবিয়াহ মরুভূমির পাশে একটি খিস্টান অধ্যুষিত শহর—যেখান থেকে রাশিয়া তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত ভাড়াটে যোদ্ধাদের পেয়েছে। এ সময় রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সিরিয়ান সেনাদের আলটিমেটাম পাঠানো হয়। ‘হয় সৈন্য পাঠাও, নইলে বেতন গ্রহণ বন্ধ করো’, এমনটাই ছিল সেই ঘোষণাতে।

পরে ২০১৭-এর পর থেকে প্রথমবারের মতো মরুভূমিতে যুদ্ধরত রাশিয়ান সৈন্যরা ইরানের ভাড়াটে যোদ্ধাদের এবং আফগান শিয়াদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে যুদ্ধ করে। ২০২১ সালের প্রথম তিন মাসে রাশিয়ার বিমানবাহিনী সমর্থিত যৌথ বাহিনী ইসলামিক স্টেটের যোদ্ধাদের ওপর বোমা ফেলে তাদের ধাওয়া করতে করতে ইরাক ও কুর্দিশ সিরিয়ার উত্তর-পূর্বের দিকে তাড়িয়ে দেয়।

ভাড়াটে যোদ্ধাদের সঙ্গে ২০২০ সাল থেকে গড়ে তোলা এই নেটওয়ার্ক কাজে লাগিয়ে বর্তমানে সিরিয়ার জ্বালানি ও ফসফেট মজুত থেকে লাভবান হওয়া রাশিয়ার মূল লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে। এর ভেতরে ইরান মস্কোর নড়বড়ে অবস্থানের সুযোগ নিয়ে পুরোনো প্রক্সি যোদ্ধাদের ডেকে এনেছে যাদের খরচ চালাতে অক্ষম মস্কো।

ওয়াগনারের দল এবং তাদের অনুগত ভাড়াটে সৈন্যরা শুধুমাত্র বস্তুগত লাভের আশায় যুদ্ধ করেন। অর্থোডক্স খিস্টানদের মধ্যে যারা সুকয়ালাবিয়াহ এবং আশপাশের অঞ্চলে যুদ্ধ করছেন তাদের বেশিরভাগই রাশিয়ার সাথে একধরনের ঘনিষ্ঠতা অনুভব করেন নতুবা ইরানি শিয়া সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা করেন। কিন্তু মস্কো যদি প্রিগোজিনের বাহিনীকে ছত্রছায়া দেওয়া বন্ধ করে দেয় তাহলে ওয়াগনারের সব প্রক্সি যোদ্ধারা বাস্তববাদী সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হবেন।

গত মাসের শেষদিকে যে ৪ ওয়াগনার নেতাকে সিরিয়ায় আটক করা হয়েছে তাদের দুইজন হামেইমিম কেন্দ্রিক, একজন দামেস্ক এবং আরেকজন তেল সমৃদ্ধ অঞ্চল দেইর ইজ্জরের এবং শেষজন সুকয়ালাবিয়াহ অঞ্চলের। তাদেরকে যদি এভাবেই আটকে রাখা হয় তাহলে এসব গ্রুপের জন্য অপেক্ষা করছে ইরানের নানা লোভনীয় প্রস্তাব।

এসব প্রস্তাবনা দেওয়ায় ইরান আসন্ন সময়ে আরও ভালো অবস্থানে যেতে পারে। মাসের পর মাস ধরে চুপিসারে চলা দরদাম এবং জুনের শেষ দিকে অন্তবর্তীকালীন চুক্তির জন্য তেহরানের যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পারমাণবিক চুক্তির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। আস্থা স্থাপনের স্মারক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ইরানি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ২ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার আনফ্রিজ করে সেটা ইরানের হাতে ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে একমত হয়েছে। তেহরান যুক্তরাষ্ট্রের বন্দি নাগরিকদের মুক্তির দেওয়ার বিনিময়ে দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে ফ্রিজ করে রাখা ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ ছেড়ে দেওয়ার জন্য আবেদন জানিয়েছে।

যদিও রাশিয়ার এই দুর্বল অবস্থা সিরিয়ায় প্রিগোজিনকে কোনো দুর্বিনীত পদক্ষেপ নিতে দেবে না। লাভের আশায় সিরিয়ায় রাশিয়ানরা দখলদারিত্ব শুরু করেনি। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে অল্প মূল্যে রাশিয়ানদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে প্রিগোজিনকে ব্যবহার করে ভাগ্যের পরিবর্তন করাটাও রাশিয়ার জন্য দুরূহ কাজ। বর্তমানে এর উল্টোটা হচ্ছে। ক্রেমলিনের সঙ্গে সিরিয়ার দূরত্ব বাড়ানোর ঝুঁকি যখন ক্রমে বাড়ছে তখন, ইরান তার ভাড়াটে যোদ্ধাদের দ্বারা চলমান পরিস্থিতির ফায়দা লুটতে মরিয়া হবে।

মূল লেখা : জেরেমি হডজ, জোমিয়া সেন্টারে নন-স্পেস স্টেট বিষয়ক তদন্তকারী।

ভাষান্তর : সরকার জারিফ।

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ঢাবি উপাচার্যের বক্তব্য ‘বিকৃতভাবে’ উপস্থাপনের প্রতিবাদ কর্তৃপক্ষের

হাজার হাজার মার্কিনি নিচ্ছেন মেক্সিকোর নাগরিকত্ব

যাদের জনসমর্থন নেই, তারাই পিআর চায় : এসএম জাহাঙ্গীর

আরও একটি ট্রফি হাতছাড়া রোনালদোর

জাতীয় সনদে জনআকাঙ্ক্ষা থাকতে হবে : আ স ম রব

ভালো কাজের প্রতিযোগিতার আহ্বান সাদিক কায়েমের

মানুষ কেন হাই তোলে? গবেষণায় জানা গেল নতুন তথ্য

বেগম খালেদা জিয়া আপোষহীন নে‌ত্রী : ফরহাদ মজহার

মওলানা ভাসানী সেতুর বিদ্যুতের তার চুরি, থানায় মামলা

১২ বাংলাদেশি জেলেকে ধরে নিয়ে গেছে আরাকান আর্মি

১০

কাঠগড়ায় টুলে বসলেন মাইটিভির নাসির, ৪০ মিনিট দাঁড়িয়ে ক্ষোভ আনিসুল-মেননের

১১

মির্জা ফখরুলের কাছে যেসব প্রশ্ন রাখলেন ফুয়াদ

১২

মেঘনার দুই ইলিশ বিক্রি সাড়ে ১১ হাজার

১৩

ভারত বুঝতে পেরেছে, চীনের সঙ্গে বন্ধুত্বটা কেন দরকার

১৪

নারী বিশ্বকাপের জন্য বাংলাদেশের দল ঘোষণা

১৫

ভারতে নতুন মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে যে কারণে ‘সাপ’ বলেছিলেন মাস্ক

১৬

গোলকিপারের দুঃস্বপ্নের অভিষেকে ঘরের মাঠে সিটির হার

১৭

জাম্বুরা ফল কারা খেতে পারবেন না, জানালেন চিকিৎসক

১৮

যারা পিআর চায় তাদের উদ্দেশ্য ভিন্ন : সালাহউদ্দিন

১৯

সন্তানকে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে দেওয়া কি জায়েজ

২০
X